প্রশ্ন: হ্যালো অভ্র শুনতে পাচ্ছ?
উত্তর: হ্যাঁ পাচ্ছি, ফারুক দা। বলুন।
প্রশ্ন: আচ্ছা আমি প্রথমেই বলি আমি কিন্তু তোমাকে তুমি বলেই ডাকব। আপত্তি নেই তো?
উত্তর: আরে না না, ধুর, আপত্তি কিসের? বলুন বলুন।
প্রশ্ন: অভ্র, আমি সোজাসুজি প্রশ্নে আসি, হঠাৎ সিনেমা থেকে থিয়েটারে কেন?
উত্তর: না না, ঠিক তেমনটা নয়, থিয়েটার করেছি আমি অনেক ছোট থেকে, ছয় বছর বয়স থেকে, প্রথমে পাড়ায় দুর্গাপূজায় মাচা বেঁধে। তারপর দু-তিনটে গণনাট্য শাখায়, তারপর নিজের দল খোলা। সেখানে নিজের লেখা ও নির্দেশনার নাটক করেছি। তারপর হঠাৎ সব বন্ধ করে সিনেমার ছাত্র হয়ে গেলাম। তার বেশ কিছুদিন পর আবার থিয়েটারে এলাম পৃথ্বীশদার হাত ধরে। এলাম—এর থেকে নিয়ে এল বললে বেশি ভালো হবে।
প্রশ্ন: ও বাবা, তোমার আবার নিজের দল ছিল নাকি?
উত্তর: এই রে, এটা আপনি জানতেন না?
প্রশ্ন: না জানতাম না তো, দলের নাম কী ছিল?
উত্তর: বাউন্ডুলে।
প্রশ্ন: বাহ্, বন্ধ করলে কেন?
উত্তর: এই আপনি একটা আঁশটে গন্ধ পেয়েছেন তো? আমি কিন্তু আগেই বলেছি, আমি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলব না। (হাসি)
প্রশ্ন: (হাসি) আচ্ছা অন্য প্রশ্নে যাচ্ছি। তোমার বয়স এখন মাত্র ২৯, এই বয়সে এত নামডাক, খ্যাতি! কলকাতার প্রায় সব কাগজে তোমার নাম বেরোয়, সিনিয়র সাংবাদিকেরা তাঁদের লেখায় তোমার কাজের প্রশংসা করেন। কেমন লাগে? এত কম বয়সে এত প্রাপ্তি!
উত্তর: ভয় লাগে। খুবই ভয় লাগে। ছোটবেলায় বাবা বলতেন, ‘যেটা খুব তাড়াতাড়ি আসে, সেটা খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়’ সেই ভয়টাই পাই।
প্রশ্ন: এই বয়সে এত ম্যাচুরিটি এল কোথা থেকে?
উত্তর: এই রে, সে আমি কী করে বলি, পরিস্থিতি দায়ী হয়তো।
প্রশ্ন: পৃথ্বীশের সঙ্গে আলাপ কীভাবে?
উত্তর: হোম থিয়েটার নামের একটা প্রজেক্টের আমি সহকারী সম্পাদক ছিলাম। পরিচালক ছিলেন ব্রাত্য বসু, সেখানে পৃথ্বীশদা এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার ছিলেন। ওখান থেকেই আলাপ।
প্রশ্ন: তারপরই ওর সঙ্গে থিয়েটার করা শুরু করলে?
উত্তর: না না, ওটা একদমই অ্যাক্সিডেন্টাল, ২০১৭ সাল, তখন ব্রাত্য বসুর ‘অথৈ জল’ নামের একটা নাটক তৈরি হচ্ছিল। সেই নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা ছিল পৃথ্বীশদার এবং একই সঙ্গে ‘ওঃ স্বপ্ন’ নাটকটি তৈরি হচ্ছিল পৃথ্বীশদার নির্দেশনায়, সেখানে আমি ভিজ্যুয়ালের কাজ করছিলাম। আর ‘অথৈ জল’–এ তখন পৃথ্বীশদার সহকারী হিসেবে কাজ করছিল যে ছেলেটি, সে হঠাৎ চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে যায়, সেই সময় স্যার আমায় বলল, ‘অথৈ জল’–এর সেটটা একটু দেখে দিতে। সেই হলো আমার পৃথ্বীশদার সঙ্গে প্রথম কাজ, তারপর থেকে পৃথ্বীশদার সব কাজেই আমি সঙ্গে থেকেছি। মানে, আমায় রেখেছে।
প্রশ্ন: কিন্তু, নেপথ্য শিল্পীদেরই লোকে চেনে না ঠিক করে। তুমি ছিলে নেপথ্যেরও নেপথ্যে এবং সাত বছর ধরে এই কাজ করেছ। তখন তোমার বয়স হবে ২২।
উত্তর: হ্যাঁ, ও রকমই হবে।
প্রশ্ন: তখন বিরক্ত লাগেনি?
উত্তর: না, লাগেনি। তার কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত, এই বিরক্তি আসে চাহিদা থেকে, আপনি কী চাইছেন? আমি বরাবর নেপথ্য শিল্পী হিসেবেই কাজ করতে চেয়েছি। আমি একটা কাজ করলাম এবং সেই কাজের জন্য আমার শিক্ষাগুরু প্রশংসা পেল অথবা কোনো স্বীকৃতি পেল, এর আনন্দ আলাদা। কারণ, যে আপনার শিক্ষাগুরু, তাঁকে আপনি ওইটুকুই দিতে পারবেন। আপনার কৃতজ্ঞতা, আপনার ট্যালেন্ট আর আপনার পরিশ্রম। কিন্তু সে লোকটা আপনাকে নাম দেবে, পরিচিতি দেবে, খ্যাতি দেবে, পিঠ চাপড়াবে। কিন্তু আপনি তাঁকে এগুলোর কিছুই দিতে পারবেন না। আরেকটা সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, পৃথ্বীশদার সঙ্গে কাজ করলে সংসার চালানোর বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না। মানে অর্থনৈতিক চিন্তাটা থাকে না। কার বাড়িতে কখন কী দরকার, সেটা পৃথ্বীশদা সামলে নেয়। ওটাতে কাজের কোয়ালিটি আসে। পৃথ্বীশদা ওই ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ বিষয়টায় বিশ্বাসী।
প্রশ্ন: ‘বাদাবন’, বহু চর্চিত নাটক এখন, সারা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলায় শো হয়েছে, তোমার কী মনে হয়? এটা কি ওভারহাইপড? মানে ‘বাদাবন’ নিয়ে এই এত লাফালাফিটা কি বাড়াবাড়ি? মানে অনেকেই বলছে আর কী।
উত্তর: কারা বলছে?
প্রশ্ন: না বললেও ভাবছে হয়তো।
উত্তর: ও আচ্ছা, বুঝলাম।
প্রশ্ন: না বলো না, তুমি তো এই প্রজন্মের লোক, শুনি একটু, এটা কিন্তু ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়।
উত্তর: ময়রা কি কখনো তার নিজের দোকানের মিষ্টিকে খারাপ বলে? (হাসি) না, একদমই বাড়াবাড়ি নয়। দেখুন, নাটকটার একটা ফ্যাক্টর তো অবশ্যই নির্দেশক নিজে। পৃথ্বীশদার কাজের একটা পকেট দর্শক আছে। আর এই এতগুলো নতুন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে স্টেজে দাপাদাপি করে, সেটাও একটা ইমপ্যাক্ট ফেলে। আর একটা থিয়েটার তখনই ভালো লাগে, যখন গল্প, অভিনয়, কম্পোজিশন, সংগীত, মঞ্চ-আলো এবং বাকি সবকিছু, মানে যখন একটা থিয়েটার সার্বিকভাবে একই সুরে কথা বলে, তখনই সেটা সম্পূর্ণ থিয়েটার হয়ে ওঠে। সেটা না হলে আপনি টেনেটুনে ১০টা শো করতে পারবেন। ৫০টা কি পারবেন? উত্তর হচ্ছে, না, পারবেন না। আপনার কাজে আপনাকে কোয়ালিটি বহন করতেই হবে, সে আপনি যেই হোন না কেন।
প্রশ্ন: ‘বাদাবন’ তো তোমার প্রথম নিজের কাজ? কাজটা করতে এনজয় করেছ?
উত্তর: হ্যাঁ করেছি, অবশ্যই করেছি, কিন্তু শিক্ষাগুরুর সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করাটা মিস করি।
প্রশ্ন: মঞ্চ-আলো একসঙ্গে করা, এটা কি খুব কঠিন?
উত্তর: না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো নয়। কারণ, আমি যার কাছে কাজ শিখেছি, সে মঞ্চ-আলো একসঙ্গেই করে। আমিও সেটাই শিখেছি।
প্রশ্ন: কাজের সময় শিক্ষাগুরুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?
উত্তর: প্রচুর, তবে সেটা হেলদি। আর পৃথ্বীশদা কাজ নিয়ে আলোচনা করে। তাতে দুজনের বক্তব্যটা সামনে আসে।
প্রশ্ন: ‘বাদাবন’ তো সুপারহিট। পরের প্রজেক্ট কী?
উত্তর: আমি জানি না ঠিক, কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে ফাইনাল হয়নি এখনো।
প্রশ্ন: সিনেমার কাজ এখন বন্ধ?
উত্তর: না না, এই তো সম্প্রতি ব্রাত্য বসুর ছবি ‘হুব্বা’-তে কাজ করলাম, পোস্ট প্রোডাকশন হেড হিসেবে।
প্রশ্ন: তুমি যে দলেই কাজ কর, সেখানকার ছেলেমেয়েরাই বলে, তুমি খুব এনার্জেটিক, তোমার মধ্যে একটা হার না-মানা বিষয় আছে, কিন্তু তুমি খুব রাগী। রেগে গেলে তুমি কাউকে ছেড়ে কথা বলো না। এটা কেন?
উত্তর: এনার্জিটা বোধ হয় বয়সের জন্য এবং নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে। আর টিকে থাকাটাই তো আসল, হার মানি কী করে? হার মানতে আমি নারাজ।
রাগের কথাটা আমি ঠিক জানি না। (একটু চুপ থেকে) থিয়েটার আমায় প্রচণ্ডভাবে এফেক্ট করে ফারুকদা। মানে একটা থিয়েটার তৈরির সময় আমি দেখেছি সেটা আমার ব্যক্তিগত জীবনকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই থেকে হয়তো এ রাগটা বেরিয়ে আসে।
আসলে রাগ যখন কোনো মানুষ দেখায়, তখন তো জোর করে বা প্ল্যান করে দেখায় না, ওটা স্পন্টেনিয়াসলি আসে, সুতরাং আমি ঠিক বা আমি যেটা চাইছি আমার শিল্পের জন্য, সেটা হয়তো আমি পাচ্ছি না, তাই আমার রাগ বেরিয়ে আসছে। কারণ, আমি কনফিডেন্ট যে আমি যেটা ভাবছি, সেটা যদি উপস্থাপিত হয়, তাহলে মানুষের ভালো লাগবে। কিন্তু সেটা আমি পাচ্ছি না। তখন আমি রেগে যাচ্ছি হয়তো। কিন্তু সেটা তো স্বাভাবিক, আমার কাছে রাগটা তখন আর অন্যায় নয়। তাই আমি কখন রেগে যাচ্ছি, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।
প্রশ্ন: শেষ তিনটি প্রশ্ন একসঙ্গে করব। থিয়েটার কেন করো? থিয়েটার থেকে কী বার্তা দিতে চাও সমাজে? তুমি কি থিয়েটার করে সার্থক?
উত্তর: আমি থিয়েটার করি ব্যক্তিগত কারণে। আমার সমাজ বদলানোর কোনো ইচ্ছা নেই। সুতরাং বার্তা দেওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। আমার থিয়েটার করা সার্থক কি না সেদিন বুঝব, যেদিন আমার থিয়েটারের কাজ দেখে একজন অন্তত থিয়েটার করার সিদ্ধান্ত নেবে।