কবে বাংলাদেশকে দেখব বিশ্বকাপে

আজও মনে পরে যদি ফিরে যাই সেই ছোটবেলায়। সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরা আবার স্কুলে যেতে শুরু করেছি। প্রাইমারিতে পড়ি, তবে ঠিক মনে আসছে না কোনো ক্লাসে। টু বা থ্রিতে হবে। আমার জীবনে ঘটেছিল তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। সব ছাত্রছাত্রী, শিক্ষককে একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাইতে হবে। শুধু কি তা–ই? না, আমাকে সবার সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। আমার দিকে সবাই তাকিয়ে, আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় সংগীত গাইবে। কয়েক দিন ধরে রিহার্সাল দিয়েছি। গানটি খুব ভালো মুখস্থ হয়েছে।

প্রাইমারি স্কুলের মোট শিক্ষার্থী হবে প্রায় চার শ। আমাদের গ্রামের স্কুলে তখন কোনো মহিলা শিক্ষক ছিলেন না। সব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকেরা জড়ো হয়েছেন। স্কুলে প্রথম জাতীয় সংগীত গাইতে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের নহাটা প্রাইমারি স্কুলে লাল–সবুজ পতাকা উড়বে, একই সঙ্গে সবাই গাইব—‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ সেদিনের সেই অনুভূতি এখনো হৃদয়ে গাথা আছে। একটু ভয় ভয় করছে, এত বড় একটি গান আমি যদি ভুল করি, তাহলে কী লজ্জাই না পাব, এমনটি মনের মধ্যে কাজ করছে। হঠাৎ ঘণ্টা বেজে উঠল, সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো পৃথিবীর ভালোবাসা যেন উপচে পড়েছে ওই চির প্রিয় মুখগুলোতে। শুধু স্কুল নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে সেই মাঠটি, যা ছিল আমাদের ঠিকানা! স্কুলে তখন ক্রীড়াশিক্ষক ছিলেন না।

তবে যতটুকু মনে পড়ছে, সফদার স্যার নামের একজন শিক্ষক ছিলেন সেদিন সকালে স্কুল মিলনায়তনের দায়িত্বে। তিনি প্রথম বললেন, আরামে দাঁড়াও, পরে বললেন, সোজা হও। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন শুরু করো। স্বাধীন বাংলায় প্রথম আমি সোনার বাংলার গান গেয়েছিলাম সেদিন, ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে, ও মা আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি, সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ পুরো গান গেয়েছিলাম, ভুল হয়নি একটুও। স্কুলের সবার ভালোবাসার ছোঁয়ায় স্নাত হয়েছি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত।

কোমল স্নেহ, স্নিগ্ধ ভালোবাসা আর পরম মমতায় ঘেরা ছিল আমাদের সেই স্কুলের স্নেহ নীড়। জীবনের নির্মল আনন্দ-উল্লাস, বন্ধু বাৎসল্য, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সম্প্রীতি, প্রতিবেশী প্রেম, আত্মীয়দের স্নেহ-মমতা, গুরুজনদের আশীর্বাদ—সবই এসেছে জীবনের অংশ হয়ে, অথচ সময়ের আবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই অমূল্য সময় ছেলেবেলার সেই সুন্দর জীবন। হৃদয়ে বাংলাদেশ সেই থেকে গেঁথে আছে মনে-প্রাণে, ধ্যানে-জ্ঞানে। তাই হয়তো আমার প্রথম লেখা বই, যার নামকরণ হয়েছে মনের অজান্তে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’।

খেলাধুলা আদর্শ নাগরিক হতে সাহায্য করে। আমার নিজের ছেলে ও মেয়ে খেলাধুলা করে, আমি তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত খুব কাছ থেকে দেখছি। আমি দূর পরবাস থেকে ফুটবলার হান্ট একাডেমি করার উদ্যোগ নিয়েছি আমার বন্ধু শামসুদ্দিন সুমীর সঙ্গে। আমার সঙ্গে এখন অনেকেই এ কাজে যোগ দিয়েছেন। এখন দরকার সবার অংশগ্রহণ। আমার লন্ডনপ্রবাসী বন্ধু নাজমুল নানাভাবে আমাকে সাহায্য এবং অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছে।

ভালোবাসা এবং হৃদয় দিয়ে সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। আমরা ৬৮ হাজার গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে চাই, যাতে করে ভালো দক্ষ খেলোয়াড় খুঁজে পেতে পারি। সারা দেশ থেকে যদি একটি দল দাঁড় করাতে পারি, তবে নিশ্চিত আবারও গাইব সবাই সেই জাতীয় সংগীত একসঙ্গে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে লাল–সবুজ পতাকা উড়বে আর আমরা গাইব—‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে’।
লেখাটি শেষ হতেই আজ খবর এসেছে আমার ছেলে জনাথান মৃধা (The 16 nations competing in the 2022 Davis Cup by Rakuten Finals have announced their teams for the Group Stage, which takes place across four European cities, Bologna, Valencia, Hamburg and Glasgow, on 13-18 September.
DAVIS CUP FINALS 2022: TEAM ANNOUNCEMENTS
Sweden: Mikael Ymer, Elias Ymer, Jonathan Mridha, Karl Friberg, Andre Goransson. Captain-Johan Hedsberg.) আবারও সুইডেনের হয়ে খেলবে।
খুব ইচ্ছা ছিল, এখনো আছে—বাংলাদেশের জন্য ছেলে ও মেয়েকে কাজে লাগাব, বিশেষ করে টেনিস ট্রেডিশন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে এবং বিশ্বের টেনিস মাঠে লাল–সবুজের পতাকা উড়বে, কিন্তু সেটাও হলো না। নানা বাধাবিঘ্ন এবং কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে! কি জানি, শেষ পর্যন্ত ফুটবলও কি শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে! কিন্তু আমি তো শুধু স্বপ্ন দেখি না, আমি স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটাই। আমার ছেলে সেই ছয় বছর বয়সে বলেছিল, সে টেনিস খেলতে চায়। তাকে সেই থেকে সাহায্য করে আসছি শুধু তার ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য। হয়তো অনেকের ধারণা, সুইডিশ সরকার সাহায্য করছে তাকে। না, এখানে সে ব্যবস্থা নেই, বিশেষ করে খেলাধুলোর ব্যাপারে। নিজ নিজ চেষ্টা, মোটিভেশন, ডেডিকেশন এবং কঠিন প্রচেষ্টাই তাঁকে সুইডেনের হয়ে খেলার সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বের মধ্যে মাত্র ১৬টি দেশ ফাইনালে, তার মধ্যে রয়েছে সুইডেন, রয়েছে জনাথান মৃধা, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে! জনাথান যদি পারে, কেন পারবে না বাংলাদেশ? পারতে আমাদের হবেই, জাগো বাংলাদেশ জাগো, জয় আমাদের হবেই।