চ্যাটজিপিটিকে কীভাবে দেখছি আমরা, বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চ্যাটজিপিটি যেভাবে দুনিয়াজুড়ে সাড়া ফেলেছে, তাতে এর সঙ্গে আরও নতুন নতুন প্রতিযোগী যুক্ত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হবে, তা নিশ্চিত।
আপনি কাউকে ভালোবাসেন, কিন্তু মনের কথা প্রাণ খুলে লিখতে পারেন না; সে চিঠিও নিখুঁতভাবে লিখে দেবে। আপনার গোপন প্রেমের কথা, হৃদয়ের ব্যথা জেনে যাবে। আপনি কাউকে খুন করেছেন, তদন্ত হবে, জেল না ফাঁসি হবে বা আদৌ কিছু হবে কি না, সব জানতে পারবেন। দুর্নীতি করবেন, সেটাও জানা সম্ভব হবে। যেকোনো সমস্যার সমাধান পাবেন, গরিবকে বড় লোক, দরকার হলে বড়লোককে গরিব করে দিতে পারবে।
আপনি কোডিং পারেন না, শেখাবে, যদি শিখতে চান, দরকারে লিখে দেবে। আপনি আর্টিকেল লিখতে চান, লিখে দেবে। নতুন চাকরির জন্য আবেদন করবেন, কিন্তু সিভি/বায়োডাটা লিখতে পারেন না; বায়োডাটা লিখে দেবে। আপনি কাউকে ভালোবাসেন, কিন্তু মনের কথা প্রাণ খুলে লিখতে পারেন না; সে চিঠিও নিখুঁতভাবে লিখে দেবে।
আরও মজার ব্যাপার কি জানেন? যদি একটি কবিতা শেক্সপিয়ার বা আমার স্টাইলে লিখতে বলেন, সেটাও সুন্দর করে লিখে দেবে, আর এ কবিতা যে অতীতে কেউ লিখেছে, সেটা জানার উপায় থাকবে না, মানে প্লেজিয়ারিসম চেক করার যে সফটওয়্যার আছে, এ ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারবে না। যেকোনো গোপনীয় কোড, যা শুধু আপনার জানার কথা, তা-ও ফাঁস হয়ে যাবে যদি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে (এআই) সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না শেখেন বা যদি কোনো কন্ট্রোল না থাকে।
কী বুঝলেন? ব্যাপারটি ভয়ংকর বা সুন্দর, দুটিই হতে পারে, তা-ই না? এই হচ্ছে বর্তমানের ভবিষ্যৎ। তাহলে ভবিষ্যতের বর্তমান কেমন হবে? মানুষ হয়তো তার ক্ষমতা হারাবে, নয়তো নতুন জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। চ্যাটজিপিটি তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের চেয়ে দ্রুত এবং সঠিক উত্তর প্রদান করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় অগ্রগতির ফসল চ্যাটজিপিটি। এর বিশেষত্ব হলো, এটা মানুষের কথাবার্তা এমনভাবে নকল করে যে এর সঙ্গে চ্যাট করলে যন্ত্র মনে হবে না। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা সব ধরনের বিষয়ে চ্যাটজিপিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণে এর ভাষাগত দক্ষতাসহ সব ক্ষেত্রে আলোচনা চালিয়ে যেতে চ্যাটজিপিটি এখন সক্ষম। এর সৃজনশীলতা শুধু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি আমাদের মতো গল্প, চিত্রনাট্য, এমনকি জটিল সফটওয়্যারের কাজ করতে পারে। একে দিয়ে সীমাহীন কাজ করে নেওয়া এখন সম্ভব এবং বিভিন্ন ধরনের কাজ ইতিমধ্যে সে করে চলছে।
চ্যাটজিপিটি বহু কাজে সফলতার পরিচয় দিলেও এখনো এটি সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়। আমরা নিজেরা যেহেতু ভুল করছি, ঠিক আমাদের মতো চ্যাটজিপিটি বেশ কিছু ভুল করছে। তবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চ্যাটজিপিটি নিজেকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করছে। ফলে যত বেশি আমরা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করব, চ্যাটজিপিটির সিস্টেম তত বেশি উন্নত হতে থাকবে।
চ্যাটজিপিটি অ্যাডভান্স মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের সাহায্যে বিপুলসংখ্যক তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে ভালো ফলাফল প্রদান করছে। ফলে এর সঙ্গে কথা বললে বা প্রশ্ন করলে আমাদের মতো ভেবেচিন্তে উত্তর দিতে পারে। শুধু একবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, আগের আলোচনা মনে রেখে আমাদের মতো দীর্ঘ সময় আলাপচারিতা চালিয়ে যেতেও সক্ষম।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটজিপিটি যেভাবে দুনিয়াজুড়ে সাড়া ফেলেছে, তাতে এর সঙ্গে আরও নতুন নতুন প্রতিযোগী যুক্ত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হবে, তা নিশ্চিত।
চ্যাটজিপিটি আস্তে আস্তে পৃথিবীর সব ভাষা শিখছে। এমন একটা সময় আসছে, দেখবেন চ্যাটজিপিটি এত সুন্দর করে লিখবে, যা অনেক বিদ্বান বা পণ্ডিতও লিখতে পারবেন না। আমাদের মাথায় যত বুদ্ধি আছে, তত বুদ্ধি প্রয়োগ করে একে কাজে লাগাতে পারা সম্ভব। ভাবুন, পৃথিবী কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আর আপনি যদি বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে আপনার মূল্যবান সময় অপচয় করেন, তাহলে আপনি ওখানেই পড়ে থাকবেন, সামনে এগোতে পারবেন না। যে কারণে আপনি পৃথিবীতে এসেছিলেন, সে কারণই যদি না জানেন, তবে কিছু যায় আসে না। তবে যদি জেনে থাকেন, তাহলে চেষ্টা করুন কিছু করতে। কারণ, সবকিছু দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আপনি?
এখন আমি ভাবছি, এত সুন্দর করে বড় বড় নামীদামি শপিং মল থেকে শুরু করে হোটেল, রাস্তাঘাট কত কিছু তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। কী হবে সেগুলোর যখন সবকিছুর কেনাবেচা চলছে অনলাইনে? এ প্রশ্ন মনে এসেছিল করোনার সময়। লকডাউনের কারণে ঘরে বসে অর্ডার দিলেই সব হুড়মুড় করে চলে আসত দরজার সামনে।
অফিস-আদালত বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে আমরা জুমের মাধ্যমে ফোনালাপ, ভিডিওর মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সমস্যার সমাধান করেছি। সবকিছুই ম্যানেজ হয়েছে ফিজিক্যাল মুভমেন্ট ছাড়াই। তখন ভেবেছি, তাহলে এত যুগ ধরে এত কিছু তৈরি করা হলো, সবকিছু কি তাহলে পড়ে থাকবে, নাকি এটাই নিউ নরমাল!
২০২০ সালে কোভিড-১৯-এর কারণে পৃথিবী লকডাউন থেকে শুরু করে শাটডাউন হয়েছিল। বর্তমানে সবকিছু চলছে স্লোডাউনের ওপর। বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট তারপর চলছে যুদ্ধ।
অন্যদিকে বিশ্বের সাধারণ মেহনতি মানুষ নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে, কী হবে তাদের, যদি আজকের তথ্যপ্রযুক্তির জমানায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) স কাজ স্মার্ট উপায়ে করতে সহায়ক হয়! শারীরিক অস্তিত্বহীন এই অ্যাসিস্ট্যান্ট শুধু গ্রাহকের কমান্ড মেনে কাজই করে না, আগে থেকে বলে রাখা হুইপ যথাসময়ে সঠিকভাবে করে রাখে। আবার সেই কাজ সুসম্পন্ন হয়ে গেলে অতীতের করে আসা কাজ সম্পর্কিত কিছু করতে হবে কি না, তা-ও প্রভুকে জিজ্ঞাসা করে নেয়; অর্থাৎ গ্রাহকের সেবায় এই নিবেদিতপ্রাণ সবই করে তার নিজের বুদ্ধি বা মেধা খাটিয়ে। ভার্চ্যুয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক দ্বারা গঠিত এই প্রযুক্তি যা রক্তমাংসের ব্রেন নয়, অথচ সবকিছু করছে। কোনো কোনো দেশ, যেমন জাপান শুরু করেছে মানুষের পরিবর্তে রোবোটের ব্যবহার। কারণ, সমস্যা এসেছে আর মানুষ তার সমাধান করছে, দারুণ।
এখন যদি পণ্যদ্রব্য শেষ হয়ে যায় বা মজুত না থাকে, তবে তো তা উৎপাদন করতে হবে। যেমন বাংলাদেশের পোশাক খাত বিশ্বের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নানা নকশার পোশাক তৈরি করে আসছে কয়েক যুগ ধরে। এখন অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনতে হলে তো তা তৈরি করতে হবে। সেটাও না হয় এআই রোবোট দিয়ে তৈরি করা সম্ভব হবে। নানা ধরনের পোশাক তৈরি করতে দরকার র-ম্যাটেরিয়ালসের এবং তার জন্য কৃষিকাজে লোকের দরকার। তা-ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং এআই রোবোট দিয়ে ম্যানেজ করা সম্ভব হবে। এখন প্রশ্ন তাহলে অভাগা মানুষ জাতি, আমাদের হবে কী? আমরা কী করব? ঘরে শুয়েবসে সময় কাটাব আর অনলাইনে সবকিছু অর্ডার দেব? বাইরে গিয়ে পার্কে ঘুরতে পারব না। মলে গিয়ে শপিং করতে পারব না। গাড়িতে করে যেখানে খুশি যেতে পারব, তবে সে গাড়ি এআই নিজেই চালাবে। উড়োজাহাজে করে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে সুন্দর পৃথিবীকে দেখতে পারব, তবে মানুষের পরিবর্তে এআই পাইলট উড়োজাহাজ চালাবে। এ কেমন অবিচার? এত সুন্দর পৃথিবী হঠাৎ এআই দখল করে নেবে! ভাবনার বিষয়! এদিকে অতীতের মতো দুর্নীতিও করা সম্ভব হবে না। কারণ, অনলাইনে কার্ড দিয়ে পে করতে হয়, ক্যাশ ব্যবহার বিলুপ্তির পথে। আমি কয়েক বছর আগে লিখেছিলাম দুর্নীতিমুক্ত সমাজ পেতে কাগজের নোট বন্ধ করতে হবে। অনেকেই বিষয়টি পছন্দ করেনি তখন। কিন্তু এখন কী হবে?
আকাশে পাখি উড়তে দেখে যেমন একদিন রাইট ব্রাদার্সদের মনে ভাবনা এসেছিল কীভাবে মানুষও আকাশে উড়তে পারে। সেই ভাবনাকে তাঁরা বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। কোভিড-১৯ আমাদের চাপ সৃষ্টি করেছিল নতুন করে ভাবতে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এআই প্রযুক্তির যুগে মানুষের ক্ষমতা বিলুপ্তি হবে যদি আমরা এআইকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই, সে ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রযুক্তিগত সমাধান বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে পোশাকশিল্পও। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের সফলতা ধরে রাখার জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক পটভূমি তৈরি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯-এ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এই দুটি ছিল প্রধান শক্তি, যা বাংলাদেশের পোশাক খাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
এত দিন ধরে যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে পরিচালনা করা হয়েছে, ভবিষ্যতে একইভাবে কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নতুন পন্থার উদ্ভাবন করতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন, উৎপাদনের অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠা, সরবরাহের ক্ষেত্রে বিলম্ব দূর করা, সামগ্রিক ব্যয় হ্রাস এবং গুণগত মানোন্নয়নের দিকে কড়া নজর দিতে হবে। যেকোনো কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নির্ভর করে ধারাবাহিকভাবে ক্রেতাদের প্রত্যাশা পূরণের সক্ষমতার ওপর। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মূলত বড় ধরনের রপ্তানিনির্ভর শিল্প। এর গ্রাহকদের একটি বড় অংশই খুচরা বিক্রেতা। এদের বেশির ভাগই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এর পাশাপাশি লাতিন আমেরিকা ও অতিসম্প্রতি তৈরি হওয়া বেশ কিছু উদীয়মান বাজারে বৃহত্তর রিটেইল চেইনের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রি করছে। সে ক্ষেত্রে সেরা সব সরঞ্জাম, যেমন কাইজেন, লিন, সিক্স সিগমা, টোটাল প্রোডাকটিভিটি ম্যানেজমেন্ট (টিপিএম), থিওরি অব কনস্ট্রেইন্টস (টিওসি), অ্যাডজাস্ট-ইন-টাইম (এআইটি) পদ্ধতিগুলো এআইকে ব্যবহার করে শিল্পকারখানার উৎপাদনের মান আরও উন্নত করা দরকার। নতুন করে করোনার চেয়ে ভয়ংকর কিছু বা এআইয়ের চেয়ে আরও স্মার্ট যে কিছু আসবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সমস্যা জীবনে আসবে, তার সমাধান এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সুশিক্ষা, আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
আমি মনে করি, শুধু পোশাকশিল্প, এআই রোবোট বা অনলাইন বিজনেস নয়; নতুন প্রযুক্তি যেন আরও ভালো তথ্য ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে এবং সেটা যেন মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একই সঙ্গে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে দেশের জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আশু প্রয়োজন। সৌর ও বায়ুশক্তি উৎপাদনে এআই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের অবকাঠামো মজবুত করুন, পাশাপাশি কৃষি খাতে মনোযোগী হোন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে গাছ লাগান দেশব্যাপী। এখনো বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তায় এ খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাগো বাংলাদেশ জাগো, নতুন করে ভাবো।