নতুন ধানের গান
মাঠে মাঠে পাকা ধানের রাশি রাশি সোনালি হলুদ রং। কিষানির মুখে হাসি। প্রকৃতিতে শরতের মেঘমুক্ত আকাশ আর নির্মল বাতাস। সকাল ও সন্ধ্যায় গ্রামগুলো ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশার কোমল চাদরে। বেলা একটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুয়াশার চাদর সরিয়ে উঁকি দেয় লাল টুকটুকে সূর্যমামা। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। তবে এ ঠান্ডাতে গরম পোশাক না পরে বাতাসটা গায়ে লাগাতেই যেন আনন্দ। সকালে শিশিরে স্নান সেরে তরুলতা জেগে ওঠে। শিশিরভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটলে মনের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। অন্যদিকে সময় ঘনিয়ে আসছে সর্বজনীন শারদীয়া দুর্গাপূজার। ঠিক এমনই একটা পরিবেশ বিরাজ করছে এখনকার বাংলাদেশে।
মাঠে মাঠে সারিবেঁধে চলছে পাকা ধান কাটা। কাটার পর ধানগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বিছিয়ে রাখা হয় শুকানোর জন্য। তারপর শুকিয়ে গেলে সেগুলোকে আঁটি বাঁধা হয়। সকালের রোদে শিশির শুকিয়ে যাওয়ার পর আঁটি বাঁধার কাজটা শুরু করা হয়। এ আঁটি বাঁধার প্রক্রিয়াটা একটা শিল্প আর কৃষক তার নিপুণ শিল্পী। প্রথমেই হাতের মধ্যে ছোট একগোছা পছন্দসই ধান তুলে নেওয়া হয়। তারপর যে ধানগুলোর আঁটি বাঁধা হবে, সেগুলো নেওয়া হয়। এরপর আগের ধানের গোছাটাকে কবজির মোচড়ে ঘুরিয়ে আঁটি বেঁধে ফেলা হয়। পুরো ব্যাপারটা ঘটে চোখের পলকে। আমি অনেকবার দেখেছি, কিন্তু বুঝে উঠতে পারিনি। এই আঁটি খোলা কিন্তু খুবই কঠিন। এরপর ছোট ছোট আঁটিগুলোকে একত্র করে বড় বড় আঁটি বাঁধা হয় পরিবহনের জন্য।
ইতিমধ্যেই ধান কুড়ানিরা চলে আসে দলে দলে। তারা কৃষকের ফেলে আসা ধানগুলো কুড়ায়। অনেকেই আবার খেতের মাঝের ইঁদুরের গর্তগুলো খুঁড়তে শুরু করে। কারণ ইঁদুর গর্তে ধান জমিয়ে রাখে। আর পাখপাখালির খুশিও টের পাওয়া যায় তার আনন্দধ্বনিতে। তারা এক আঁটি থেকে অন্য আঁটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বসে আর খুটে খুটে ধান খায়। ফিঙে, শালিক, ধানশালিকের কলকাকলিতে খেতগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে।
একটু পরেই ক্যাঁ-কুঁ একঘেঁয়ে স্বরে উপস্থিত হয় গরুর অথবা মহিষের গাড়ি। গাড়োয়ান মহিষ দুটিকে পাশে কোথাও বিশ্রামে রেখে শুরু করে গাড়িতে ধান তোলা। গাড়ি ভরে এলে মাঝ বরাবর একটা শক্ত বাঁশের মাধ্যমে বেঁধে ফেলা হয়। এই বেঁধে ফেলার বিষয়টা আরও আনন্দের। গাড়োয়ান একটা করে শব্দ বলেন আর কৃষকেরা দড়ি ধরে টান দেন সঙ্গে আরেকটা করে শব্দ বলেন। যেমন শুরুটা হয় এমন, গাড়োয়ান বলেন আল্লাহ আল্লাহ, কৃষকেরা বলেন রসুল বলো। এরপর সেই ধানের গাড়ি বাড়ির আঙিনায় এসে ধানগুলো পালা করে রাখেন।
এরপর খুব ভোরে উঠে সেগুলো মাড়াই করা হয়। আগে গরুর পাল দিয়ে মাড়াই করা হতো, যেটাকে বলা হয় ‘মলন মলা’। আর এখন যান্ত্রিক কলের সাহায্যে মাড়াই করা হয়। একটানা ঘররঘর শব্দ করে চাকাটা ঘুরে চলে। তার ওপর ধানের আঁটিগুলো উল্টে পাল্টে ধরলেই কিছুক্ষণের মধ্যে সব ধান আলাদা হয়ে সামনের মাটিতে পড়ে। এরপর কুলার সাহায্যে ধান থেকে ধানের পাতা বা অন্যান্য অংশকে আলাদা করা হয়। আলাদা করার পর সেগুলোকে সংরক্ষণের জন্য আবার শুকাতে দেয়া হয়। ইতোমধ্যেই কিষানি আঙিনায় বসে যান ধান সেদ্ধ করতে। আর বাচ্চারা চুলার পাশে বসে বসে ওম নেয়।
অন্যদিকে চলে খেজুরের গাছ কাটার তোড়জোড়। তবে এ কাটা মানে গাছ কেটে ফেলা না। গাছের গলার কাছটা পরিষ্কার করে সেখানটা একটা নির্দিষ্ট মাপে কাটা। এভাবে বেশ কয়েকবার কাটার পর সেখানে থেকে সংগ্রহ করা হবে খেজুরের টাটকা রস। এই রস টাটকা খেতে যেমন মজা, তেমনি বিভিন্ন পিঠাপুলির সঙ্গেও যায়। আবার অনেক সময় এই রস জ্বাল দিয়ে আরেকটু গাঢ় করে সেটা দিয়ে পায়েস রান্না করা হয়। আর আরও একটু জ্বাল দিলেই এটা হয়ে যায় গুড়। অনেকেই গুড় থেকে আবার পাটালি তৈরি করেন। পাশাপাশি এ সময় খেত থেকে আখও তোলা হয়। আখ মাড়াই করে রস পাওয়া যায়। আর সেই রস থেকে পাওয়া যায় নতুন গুড়।
নতুন ধান, নতুন গুড় দিয়ে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। গ্রামের মেয়ে, বউয়েরা তখন বাবার বাড়িতে যান নাইয়রে। ধান তোলার ক্লান্তি শেষে যেন একটু জিরিয়ে নেওয়া। তখন বাড়িগুলোতে যেন চাঁদের হাট বসে। শহর থেকে চলে আসে চাকরিজীবী ছেলেমেয়ে এবং তাদের সন্তানসন্ততি। প্রবাসী ছেলেমেয়েগুলো চেষ্টা করে এসময় দেশে আসার। গ্রামে গ্রামে তখন অনেক রকমের উৎসব চলে। যাত্রাগান, পালাগান চলে প্রায় সারারাত ধরে। এ সময় দেখা যেতো বায়োস্কোপওয়ালাকে। এখন আর দেখা যায় না তেমন একটা। লেইস ফিতা লেইস ধ্বনি তুলে হাজির হয় চুড়ি–ফিতেওয়ালা। সবাই তখন দলবেঁধে এসব আনন্দ উপকরণ কেনে।
এভাবেই শরৎ এবং হেমন্তকাল গেয়ে যায় নতুন ধানের গান। পাশাপাশি খেতে খেতে চলে চৈতালি ফসল রোপণও। অনেকটা জৌলুশ হারিয়ে ফেললেও গ্রামবাংলার নতুন ধানের গানের পরিবেশটা মোটামুটি এখনো এমনই আছে। এখনো নতুন ধান উঠলেই বাংলাদেশের মানুষ তাই গ্রামমুখী হয়। নতুন করে অনুভব করে শেকড়ের টান। প্রবাসী প্রজন্মও দেশে যেয়ে একাত্ম হয় নতুন ধানের এ উৎসবে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আবহমানকাল ধরে চলে আসা নতুন ধানের গানের এ উৎসব চলবে যতদিন পৃথিবী টিকে থাকবে।