হ্যালোইনে ‘ট্রিক অর ট্রিট’–এর আনন্দে মাতোয়ারা শিশুরা
প্রতিটি উৎসবেরই দুটি দিক থাকে। একটা ধর্মীয়, আরেকটা আনন্দের। কিন্তু দিন শেষে আনন্দের দিকেই পাল্লাটা ভারী হতে দেখা যায়। ‘হ্যালোইন’ উৎসবের পটভূমি কী? সেটা উদ্যাপন করা কতখানি জায়েজ? এমন অনেক বিষয়ে তর্ক আছে। কিন্তু এর সঙ্গে যে আনন্দ জড়িত, সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিবছরের মতো এবারও অস্ট্রেলিয়াতে গত ৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে।
অফিস থেকে ঠিক পাঁচটায় বেরিয়ে গেলাম। গ্রিন স্কয়ার স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। দেখলাম, কয়েকজন কিশোরী হ্যালোইনের বাহারি সাজে সেজে খুনসুটি করছে। দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কৈশোরের দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে গেল। কৈশোর তো এমনই বাঁধভাঙা উল্লাসের সময়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়—
‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’
মিন্টো স্টেশনেও দেখা পেলাম কিছু তরুণ তরুণীর। তারাও হ্যালোইনের সাজে সেজে ঘোরাঘুরি করছে। এরপর বাসায় পৌঁছেই ছেলেটার পোশাক বদলে হ্যালোইনের পোশাক পরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাসায় যেহেতু হ্যালোইনের কোনো রকম সাজসজ্জা ছিল না, তাই বাচ্চারা কেউ কড়া নাড়ছিল না। আমি তাদের ডেকে ডেকে বিভিন্ন রকমের চকলেট দিচ্ছিলাম। চকলেট পেয়ে ‘হ্যাপি হ্যালোইন’ বলে যে হাসি তারা দিচ্ছিল, সেটা অমূল্য।
আমরা প্রথমেই বাসার বিপরীত পাশের বাসায় গেলাম। তারা একটা বড় ট্রে ভর্তি করে বিভিন্ন চকলেট আর ক্যান্ডি নিয়ে বাচ্চাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের পাশাপাশি আরও দুটি বাচ্চা হাজির হলো মাসহ। বাড়ির কর্তী বললেন, তোমাদের যতগুলা করে খুশি নিয়ে যাও। বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গে চকলেট নিল। এরপর আমরা পাঁচজন বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পাড়ার মধ্যে।
প্রতিটি বাসার সামনেই চমৎকার সব সাজসজ্জা। অনেকেই বাসার সামনের গাছগুলোও সাজিয়েছেন। আর বাড়ির আঙিনা সাজিয়েছেন কবরের আদলে। অনেকেই তাঁদের বাড়ির দরজায় হ্যালোইনের ফিতা দিয়ে সাজিয়েছেন। অনেকের বাসার আঙিনায় পা রাখলেই স্বয়ংক্রিয় পুতুলগুলো হ্যালোইনের বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল। এ ছাড়া ছিল বড় বড় মিষ্টিকুমড়ার আদলের পুতুল। অনেকেই হ্যালোইনের সমস্ত চরিত্র একত্র করে বাড়ির আঙিনা সাজিয়েছেন।
পরবর্তী বাসায় গিয়ে আমরা আরও দুটি বাচ্চাকে পেয়ে গেলাম তাদের বাবাসহ। এ ছাড়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিল প্রতিবেশী মিশু ভাই এবং তার তিন সন্তান। এরপর আমরা হইহই করে পুরো এলাকা চষে ফেললাম। আমরা সেসব বাসাতেই কড়া নাড়ছিলাম, যেসব বাসায় হ্যালোইনের সজ্জা ছিল। এ ছাড়া অবশ্য অনেক বাসার সামনেই অনেকেই গামলাভর্তি চকলেট–ক্যান্ডি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাচ্চাদের দেওয়ার জন্য। একবার এক বাড়িওয়ালার পীড়াপীড়িতে আমরা বড়রাও বাচ্চাদের মতো ললিপপ নিলাম। মনে হচ্ছিল, যেন আমরা আমাদের কিশোর বয়সে ফিরে গিয়েছি।
একটা বাসার সজ্জা আমাদের খুবই পছন্দ হলো। বাড়িওয়ালা পুরো বাসা হ্যালিনের শিকল দিয়ে ঘিরে রেখেছিল। আর প্রতিটি খুঁটির মাথায় ছিল একটা করে মাথার কঙ্কাল। আর সেই শিকলের মধ্যে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, ড্রাকুলারা। এমনকি বাচ্চা ভূতও বাদ পড়েনি। এ ছাড়া বাড়ির দেয়াল, গোট—সব জায়গায় ছিল ভূতের সজ্জা। বাড়ির আঙিনায় ছিল একটা ভূতের কবরস্থান। আবার সেটাকে পাহারা দিচ্ছে একটা ভূত, সঙ্গে ছিল তার পোষা কুকুরভূত দুটোও।
এভাবে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে বাচ্চাদের হাতের বালতিগুলো বিভিন্ন ধরনের চকলেট, ক্যান্ডি ও ললিপপে ভরে গেল। তখন বাচ্চাদের চোখেমুখে যেন সূর্যের হাসি খেলা করছিল। সন্ধ্যার সময় আমরা পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাসায় এসে টেবিলে চকলেট সাজিয়ে আমাদের ছেলেটা বিশ্বজয়ের হাসি দিল। আসলে উৎসবগুলো আসে মানবতার জয়গান গেয়ে, আনন্দের বার্তা নিয়ে। ধর্ম–বর্ণ–বয়সনির্বিশেষে সবাই সেই আনন্দের মিছিলে শামিল হয়। এভাবেই আমরা আরও একবার প্রমাণ করি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।