মানুষের খোঁজে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শফিক সাহেবের বয়স অনেকটাই হয়েছে বলা যায়। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কাজ করছেন। আর কিছুদিনের মধ্যেই অবসর নেওয়ার কথা। এই কাজের ব্যস্ততা ছেড়ে কীভাবে অবসর কাটাবেন, সেই চিন্তাটা মাথায় আসতেই একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। অনেক দিন বাসা থেকে কাজ করেন বলে অফিসে তেমন যাওয়া পড়ে না। অনলাইনেই সব মিটিং সারেন। কিন্তু আজ তিনি অফিসে যাবেন মনস্থির করায় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছেন। অফিসে গিয়েই ক্যাফেতে নাশতাটা সারবেন। তা ছাড়া অনেক দিন পরিচিত কারও সঙ্গে তেমন দেখা হয় না! এই উসিলায় দেখা হয়ে যাবে!

এই ষাটোর্ধ্ব জীবনে তিনি অনেক কিছুই দেখেছেন। শৈশবে বেড়ে উঠেছেন গ্রামের প্রকৃতির মাঝে—সন্ধ্যা নামত ঝিঁঝি পোকার ডাকে। গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি—হারিকেনের আলোতে পড়াশোনা শেষে রাতের খাবার খেয়েই ঘুম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে হেঁটে তিন মাইল পেরিয়ে স্কুল। সময়ের পরিক্রমায় এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে...ঘরে ঘরে এসেছে বিদ্যুৎ, টেলিভিশন, কয়েন টেলিফোন পেরিয়ে সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের বদৌলতে সমগ্র পৃথিবী এখন সবার নখদর্পণে। মানুষের মন এখন অনেক কিছুই চায়। তারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। ইদানীং আবার নতুন কি যেন একটা শোনা যাচ্ছে—আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মাথায় আর কিছুই ধরে না।

জ্ঞান ফিরে শফিক সাহেব দেখেন একটা বিশাল ময়দানের মধ্যে রোবোটিক চেয়ারে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! অনেকটা গাড়ির নম্বর প্লেটের মতো কপালে একটা ট্যাগ লাগানো HUM-576. তাঁর আশেপাশে প্রচুর মানুষ। কেউ গাইছে গান, কেউ দিচ্ছে বক্তৃতা

এক ছেলে আর এক মেয়ের ছোট পরিপাটি সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই বড় হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মোবাইলের এই যুগে বেশির ভাগ সময় অনলাইনেই নিজেদের ব্যস্ত রাখে। জিজ্ঞেস করলেই বলে আজ পরীক্ষা, কাল অ্যাসাইনমেন্ট—ক্লাসমেটদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়! আজকাল খাবার টেবিলেও সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। সবাই ভার্চুয়াল পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত। শফিক সাহেবের মনে পড়ে যায় স্কুল ছুটির দিনগুলোতে সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে খোলা আকাশের নিচে পাটি বিছিয়ে কী আড্ডাতেই না সবাই মেতে থাকত। সামনে থাকত বেতের ঢুলিতে মুড়ি আর গুড়। অন্যদিকে চলত হেঁসেলে পিঠা বানানোর ধুম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি সেই আনন্দ অনুধাবন করতে পারবে? যাক! এত চিন্তা করে কী হবে? অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে...

শফিক সাহেব বাসে করে অফিসে পৌঁছলেন প্রায় ৮টার দিকে। জিনিসপত্র টেবিলে রেখেই ছুটলেন অফিস রেস্টুরেন্টের দিকে। কিন্তু ঢুকতে গিয়েই যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। চারদিকে সুনসান নীরবতা। চেয়ার–টেবিল কিছুটা থাকলেও কোনো মানুষ নেই। অথচ এক বছর আগেও এই সময়টায় রেস্টুরেন্ট মানুষে গিজগিজ করত। সেই প্রাণচাঞ্চল্য কোথায় গেল? তবে কি রেস্টুরেন্টটা বন্ধ হয়ে গেছে? এসব হাবিজাবি চিন্তা করতে করতেই ফিরে আসবেন ভাবছিলেন। হঠাৎ দেখলেন দূরে এক কোনায় একটা পরিজের বাটি আর কিছু স্যান্ডউইচ দেখা যাচ্ছে। আগে পুরো টেবিলজুড়েই বিভিন্ন আইটেম সাজানো থাকত। তিনি কাছে গিয়ে এক বাটি পরিজ নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে তাকালেন—কেউ নেই। আগে ওখানে দুজন সার্ভিস দিতে গিয়ে একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা...কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কাউন্টারে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে সামনে রাখা কম্পিউটারের অ্যাপ ব্যবহার করে নিজে নিজেই পেমেন্টের কাজটি করতে হবে। যাই হোক দাম মিটিয়ে একাকী নাশতা করে অফিসে নিজ চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আশেপাশে দুই–একজন পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল...সবাই প্রচণ্ড ব্যস্ত...অনেকটা হায়–হ্যালো সেরেই তিনি কাজে নিমজ্জিত হয়ে গেলেন।

শফিক সাহেবের হাতে আজ খুব একটা কাজ নেই। তাই কয়েকটা জরুরি মিটিং শেষ করে অফিস টাইম শেষ হওয়ার কিছুটা আগে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলেন। বাসায় কিছু বাজার সদায় করা দরকার। যাওয়ার পথে একটা সুপার মার্কেটে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে কাউন্টারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই দেখেন কাউন্টারে কেউ নেই। অগত্যা অটোমেটিক মেশিনে দামের ট্যাগগুলো স্ক্যান করে, দাম মিটিয়ে মার্কেট থেকে বের হয়ে এলেন। বাসায় যেতে যেতে কত কথাই–না চিন্তা করলেন। আচ্ছা! এই যন্ত্রগুলো কবে মানুষের মতো অনুভূতিশীল হবে। একবার মনে আছে—শফিক সাহেব মনের ভুলে বাতাবি লেবু কিনে কামরাঙার প্রোডাক্ট কোড স্ক্যান করেছিলেন। দাম প্রায় ২০ গুণ বেশি ছিল। শফিক সাহেব ব্যস্ততায় দাম খেয়াল করেননি। জিনিসগুলো কাউন্টারে দিতেই ওখানে বসা ছেলেটি একবার শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে নিজেই উঠে গিয়ে একটু দূরে থাকা মেশিন রিডারে সঠিক কোড স্ক্যান করে এনেছিল—তারপরে হেসে বলল: বাতাবি-লেবুর কেজি এত বেশি না। শফিক সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছেলেটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বাজার থেকে ফিরেছিলেন। কিন্তু এই মেশিনগুলো তো ভুলকে সঠিক ভেবেই ছাড়পত্র দিয়ে যাবে। হয়তো দুয়েক দিনের মধ্যে আরও উন্নত মেশিন দেখা যাবে। মানুষের মতো চোখ অর্থাৎ ক্যামেরা দিয়ে এআইয়ের মাধ্যমে জিনিস স্ক্যান করে ভুল শুধরে দেবে। কিন্তু মানুষের মতো অনুভূতিশীল...আচ্ছা! এই যন্ত্রের মালিকেরা যখন পুরোনো মেশিন বদলে নতুন মেশিন বসায় তখন কি তাদের মন বিষণ্ন হয়? নাকি নতুন মেশিন বসানো আর মুনাফার আনন্দে সব ভুলে যায়! এসব আবোল-তাবোল ভেবে কী লাভ!! তার চেয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েই মনে হয় শান্তি!!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শফিক সাহেব ঘরে এসেছেন কিছুক্ষণ হয়। ছেলেমেয়েদের ঘরে একটু উঁকি দিয়ে দেখেন তারা ফোনালাপে ব্যস্ত। স্ত্রী যেন ফেসবুকে গবেষণা করছেন। শফিক সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করতেই কোনো রকমে উত্তর দিয়ে আবার গবেষণায়। সবাই নিজ ভূমে থেকেও পরবাসী... হয়তো লিখছে—এই জানিস, তোর ভাই না অফিস থেকে ফিরেই কী যে সব বোকা বোকা প্রশ্ন করছে! এর উত্তর তো সবাই জানে...হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ...আজকাল মোবাইল মেসেজিংয়েই অনেক সময় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে জরুরি কথাবার্তা সারা হয়। শফিক সাহেব রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন টেবিলে খাবার ঢাকা আছে। অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে গরম করে খেতে বসলেন। খেতে খেতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া হতো। তার খাবারের প্রতি অনীহার কারণে মা সারাক্ষণ এটা ওটা প্লেটে দিয়ে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তদারকি করতেন। খাবারের শেষে বাবার চোখ এড়িয়ে পানি না খেয়েই নিজ ঘরে ফিরে যাওয়া ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। আচ্ছা, বাবার কি মাছির মতো পুঞ্জাক্ষী ছিল!! এসব ভাবতে ভাবতে খাবার শেষ করে বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসার প্রস্তুতি নিলেন। বন্ধু সালাম সাহেবের বাড়ির পাশে একটা ট্রেইল আছে। দুই বন্ধু মিলে ট্রেইল ধরে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা।

শফিক সাহেব বাসা থেকে বের হয়ে সালাম সাহেবের বাড়ির দিক হাঁটছেন। পথে অনেক মানুষ। অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভাবতেন যে হয়তো তাঁকে উদ্দেশ করে কিছু বলা হচ্ছে। পরে খেয়াল করে দেখতেন যে কানে হেডফোন লাগিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছে। আচ্ছা এদের সবাই কি বুনো পথে হাঁটতে গিয়ে গাছের ডালে কিচিরমিচির করা পাখিগুলোর লাফালাফি কখনো খেয়াল করে? বা স্কুইরেলটা কীভাবে মনের আনন্দে গাছতলায় বসে ছোট ছোট দাঁত দিয়ে কিছু খাচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতেই শফিক সাহেব হঠাৎ কিছুটা অসুস্থতা অনুভব করলেন। বুকের পাশে একটু ব্যথা করছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ইমার্জেন্সিতে ফোন করতেই ওপাশ থেকে এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এজেন্ট কিছু তথ্য জানার জন্য ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে। শফিক সাহেবের মাথায় তখন কিছুই ঢুকছিল না। তিনি হঠাৎ করেই—আমি মানুষ চাই, মানুষ চাই...চিৎকার করতে করতে পথে পড়ে গেলেন...

জ্ঞান ফিরে শফিক সাহেব দেখেন একটা বিশাল ময়দানের মধ্যে রোবোটিক চেয়ারে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! অনেকটা গাড়ির নম্বর প্লেটের মতো কপালে একটা ট্যাগ লাগানো HUM-576. তাঁর আশেপাশে প্রচুর মানুষ। কেউ গাইছেন গান, কেউ দিচ্ছেন বক্তৃতা, আবার অনেকে অনেকটা উদ্‌ভ্রান্তের মতো একমনে হেঁটে যাচ্ছেন, দূরে একজন একটা বোর্ডে কী যেন আঁকিবুঁকি করছেন আর সামনে কয়েকজন বসে তা একমনে শুনছেন। পাশ দিয়ে একজন যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শফিক সাহেবকে দেখেই হাঁত নেড়ে বললেন—আমি HUM-420. তিন বছর যাবৎ এখানে আছি। কার্ড খেলতে জানেন? দেখা হবে বলেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন...শফিক সাহেব মৃত্যুর পরে হাসরের ময়দানের কথা পড়েছেন...পুলসিরাত পেরিয়ে জান্নাত-জাহান্নাম। কিন্তু এখানে জমায়েত হওয়া অনেক মানুষই (HUMan) হয়তো মানব সৃষ্ট ভার্চুয়াল পৃথিবী থেকে পাকাপাকিভাবে বিদায় নিয়ে এসেছেন। তাঁরা আর সেখানে ফিরে যেতে চান না...আছেন আজীবন অপেক্ষায়...

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]