শিক্ষার্থী ভিসা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে আমেরিকার সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা না নিপীড়ন
২০২৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখন থেকে যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী (F 1), পেশাগত প্রশিক্ষণার্থী (M 1) বা সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিতে (J 1) অংশ নিতে চান, তাঁদের ভিসা আবেদনের সময় গত পাঁচ বছরে ব্যবহৃত প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ইউজারনেম জমা দিতে হবে। শুধু তা–ই নয়, এসব অ্যাকাউন্টকে রাখতে হবে ‘পাবলিক’, যেন যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলার অফিসাররা আবেদনকারীর অনলাইন উপস্থিতি খতিয়ে দেখতে পারেন। এই সিদ্ধান্ত শুধুই প্রশাসনিক নয়; এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং বৈশ্বিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে গভীর নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটকে প৶শ্নের মুখে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এই নীতির পেছনে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র যুক্তি দেখাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সময় উগ্রবাদী বা সহিংস মনোভাব ছড়ানো হয়, যা সময়ের সঙ্গে বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ইসরায়েল–গাজা যুদ্ধ, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া অবস্থানের প্রেক্ষাপটে মুসলিম দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব বেড়েছে। এ মনোভাবের প্রকাশ যদি কারও ব্যক্তিগত ফেসবুক বা টুইটার অ্যাকাউন্টে থাকে, সেটিও এখন তাঁকে ‘পটেনশিয়াল থ্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত করার উপকরণ হতে পারে।
এ ছাড়া এই সিদ্ধান্তের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৮ সালে, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ‘Extreme Vetting’ নামে এক বিশেষ অভিবাসন নিরাপত্তানীতি চালু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে প্রায় প্রতিটি ভিসা প্রার্থীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহের নিয়ম চালু করা হয়। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে তা কিছুটা শিথিল হলেও এখন তা আবার আগের চেয়েও কঠোরভাবে ফিরছে। এবার শুধু পর্যবেক্ষণ নয় বরং অ্যাকাউন্ট খোলা রেখে তা পাবলিক করার শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যা একপ্রকার জবরদস্তিমূলক ডিজিটাল স্বচ্ছতার দাবিতে পরিণত হয়েছে।
তবে প্রশ্ন হলো, এই ধরনের নজরদারি কি সত্যিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, না বরং এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার পরিপন্থী এক দমননীতির সূচনা করছে? বাস্তবে এই নতুন নীতির ফলে শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা বাধ্য হচ্ছেন অতীতের পোস্ট মুছে ফেলতে, নিজেকে সেন্সর করতে, এমনকি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে নীরব থাকতে। মার্ক টোয়েন যথার্থ বলেন, সবাইকে এক মাপে মাপা বা দুর্বলদের কারণে শক্ত ও সচেতনদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া অন্যায়।
কারও যদি ধর্মীয় চিন্তাভাবনা, সামাজিক প্রতিবাদ অথবা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকে, তাহলে সেটিই তাঁর ভিসা বাতিলের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এটি শুধু এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয় বরং হাজারো আবেদনকারীর জন্য একটি ভয়াবহ বাস্তবতা।
আরও উদ্বেগজনক হলো, এই নীতি বাস্তবে কীভাবে প্রয়োগ হবে, সেটি পরিষ্কার নয়। বিদেশি ভাষায় লেখা পোস্ট, সাংস্কৃতিক রেফারেন্স বা কৌতুকমূলক বক্তব্য—এসব যদি ভুল ব্যাখ্যা করা হয়, তবে নির্দোষ অনেক মানুষও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ পর্যায়ে পেতে পারেন। আবার এ পুরো প্রক্রিয়ায় যে বৈষম্য নিহিত, তা–ও অস্বীকার করার উপায় নেই। বাস্তবে এটি মুসলিম, আরব, ইরানি, দক্ষিণ এশীয় ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবের সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর বেশি করে প্রয়োগ হবে, যার ফলে একরকম ডিজিটাল প্রোফাইলিং তৈরি হবে।
এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ইউরোপে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন এই পদক্ষেপকে ‘অত্যধিক ও ভীতিকর নজরদারি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আয়ারল্যান্ডের ছাত্রসংগঠন এএমএল এটিকে ‘মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন’ বলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নীতিকে ফাস্ট অ্যামেন্ডমেন্ট First Amendment (মতপ্রকাশের অধিকার) পরিপন্থী বলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী নাগরিকদের কিছু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে, যেমন
১. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
২. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
৩. ধর্ম পালনের স্বাধীনতা
৪. শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হওয়ার অধিকার
৫. সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর অধিকার
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কি বিশ্বজুড়ে আরও নজরদারিমূলক অভিবাসন নীতিকে উৎসাহিত করবে? যদি যুক্তরাষ্ট্র এই নজির স্থাপন করে, তবে ইউরোপ, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোও হয়তো অনুরূপ পথে হাঁটবে আগামী দিনে। এতে যে ‘বৈশ্বিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়’ ব্যাহত হবে, তা বলাই বাহুল্য। অতীতে শিক্ষার্থীরা বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই জাগরণ যুক্তরাষ্ট্রের এই সেলফ-সেন্সরশিপের (স্ব–আরোপিত বিধিনিষেধ) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন গণ–আন্দোলনে তরুণ শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যেমন ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও শিক্ষার্থীরা সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন। তাই আজকের বিশ্বায়নের সমাজে শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা বিশেষ জরুরি, কারণ, তাঁরা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি।
আমরা যে যুগে বাস করছি, সেখানে তথ্যের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার এবং ব্যক্তি গোপনীয়তা—এই তিন স্তম্ভ গণতন্ত্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার বিপরীতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা যদি না থাকে, তাহলে বহুমতের বিশ্লেষণের আড়ালে গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্রের লেকচার দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র যদি এখন একটি ভিসা পাওয়ার বিনিময়ে মানুষকে খোলা বইয়ের মতো করে নিজের চিন্তা, অভিমত ও ব্যক্তিগত জীবন উন্মোচনে বাধ্য করে, তবে সেটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, এটি সমগ্র গণতান্ত্রিক সভ্যতার জন্য একটি ভয়ংকর নজির সৃষ্টি করে।
এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ ও অনলাইন পর্যবেক্ষণ শুধু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াই নয় বরং সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা যায় ‘চিন্তার সংকোচন’ (cognitive constriction)। একজন শিক্ষার্থী বা গবেষক যখন জানেন, তাঁর অনলাইন অভিব্যক্তি একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের কড়া পর্যবেক্ষণে রয়েছে, তখন সে আত্মসংযমী (self-censoring) হয়ে পড়েন অথবা ভয় পান নতুন বা মৌলিক কিছু ভাবতে। আর এভাবে ধীরে ধীরে সমাজে গড়ে উঠে ভয়ভিত্তিক মতাদর্শগত পরিবেশ, যেটিকে নরওয়েজিয়ান সমাজতাত্ত্বিক জোহান গাল্টুং ‘সাংস্কৃতিক সহিংসতা’ (cultural violence) হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেখানে কোনো শারীরিক দমন নেই কিন্তু মনোজাগতিকভাবে মানুষকে দমিয়ে রাখা হয়।
চিন্তার মুক্তি না থাকলে জ্ঞানচর্চা মুখ থুবড়ে পড়ে এবং একটি সমাজ তার সৃজনশীল শক্তি হারাতে শুরু করে। প্রযুক্তি যদি মানুষের সম্ভাবনাকে মুক্ত না করে বরং তাকে শৃঙ্খলিত করে, তাহলে তা শুধু মানবাধিকার নয়, মানবতার পরাজয় বলেই গণ্য হবে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]