নিউমেরিক্যাল নম্বর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শফিক চকচকে লাল রঙের টাই পরেছে আজ। সাদা শার্টের সঙ্গে লাল টাই। লিফটের স্টিল দরজায়, ক্যানটিনের সাদা গ্লাসের আবছা অবয়বে কিংবা রেস্টরুমের বিশাল আয়নায়, যেখানেই নিজেকে দেখা যাচ্ছে, শফিক নিজেই পুলকিত হচ্ছে নিজেকে দেখে। সুদর্শন লাগছে তাকে।

ছোটকাল থেকে মায়ের আদরের ছিল শফিক। মা–বাবা শ্যামলা হলেও তার গায়ের রং ছিল ফরসা গোছের। অল্প বয়সে শফিক মাকে হারায়। আজও অবচেতন মনে তা মেনে নেওয়া হয়নি শফিকের। তার বাবা লতিফ মাহমুদ রামপুরায় থাকেন তার ছোট ভাইকে নিয়ে। ছোট ভাই এসএসসি দিয়েছে। ফলাফল হয়তো ভালোই হবে। ফোন করবে করবে বলেও শফিক এই দুই সপ্তাহেও ফোন করেনি তার বাবাকে। হয়তো ফোন করলে ধরবেন। শফিকের সালাম শুনেই কেটে দিবেন। দুই–তিন সেকেন্ডসের নিয়মিত অপমানে শফিকের মন প্রায় উঠে গেছে পরিবার থেকে। তার মন অনেক ওপরে ওঠার যুদ্ধে শামিল হয়েছে জায়গা বদল করে। আর শফিকের এই চাকরি নিয়েই তার বাবার সব আপত্তি। সে একজন বড় মাপের সচিবের পারসোনাল সেক্রেটারি। সারাদিন মুখে হাসি নিয়ে তার একের পর এক মিথ্যা বলা, বানোয়াট কথাবার্তা সাজানো আর কুৎসিত ভয়ংকর ঘটনাকে তুচ্ছ করে দেখাতে হয় শফিকের। সবকিছুর পেছনে থাকবে একটাই কারণ। সচিব সাহেব যাতে কমফোর্ট ফিল করেন তার সমাধানে। যেভাবেই হোক খুশি করতেই হবে। টুকিটাকি অনেক কিছু আদতে লেখা থাকলেও, অলিখিত জব ডেসক্রিপশন এই এইটাই। শফিকের জব ডেসক্রিপশন এর ঠিক উল্টো মেরুতে তার বাবার আদর্শ আর সহজ জীবনের নিয়ম। দূরত্ব তাই বেড়েই চলেছে প্রতিদিন।

শফিক লাল টাইকে ওপর থেকে নিচে হাত দিয়ে আলতো ঘষতে ঘষতে সচিবের মিটিংরুমের দিকে যেতে লাগল।

স্যার, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?

ও! শফিক এসেছ? এই তো ভালো আছি।

রুমে শুধু সচিব সাহেব আর তার পিয়ন মঈন। মঈন থাকা আর না থাকা একই কথা। তার কাজ হলো সারাদিন চুপচাপ অফিসের টুকটাক কাজ করা, চিঠি খুলে পড়তে পড়তে সাজিয়ে রাখা, চা–নাশতা কিংবা খাবার আনা–নেওয়া জাতীয় কাজকারবার করা। অনেক চতুর হলেও মঈন অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন না স্যারের সামনে। দরকার কী? টাকা পাচ্ছে মাস শেষে ভালো। সচিবের পিয়নের ইনকাম অনেক ভালো। কথা বলে তার ব্যাঘাত ঘটানোর মতো বোকা মঈন নয়।

আলহামদুলিল্লাহ স্যার। শুনে ভালো লাগল স্যার।

দেশের যা অবস্থা, তাতে প্রতিদিন সকালে ভয় লাগে শফিক।

কী বলেন স্যার? ভয় কেন লাগবে? দেশে ঠিকই আছে। দেশে সবাই সুখী মানুষ স্যার।

একদম নিয়ন্ত্রিতভাবে গাল চেপে একটা স্মাইল দিল শফিক। এই স্মাইল কোনোভাবেই হাসি নয়, আবার এমনো নয় যে সে না বুঝে কিছু বলেছে টাইপের অঙ্গভঙ্গি। এটা নীরব হাসি। শফিক এই হাসিটা দিল, যাতে করে একধরনের ভালো লাগা প্রকাশ পায়, কিন্তু ফাতরামি টাইপের না দেখায়। এই ধরনের ১০/১৫ পদের স্মাইল, হাসি শফিকের রপ্ত করা আছে। সময় বুঝে এগুলো দিতে হয়। সব কটিই পরীক্ষিত বলা যায়। সচিব সাহেব এর মুখভঙ্গিতেই সে তার প্রমাণ পেয়েছে এবং নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে সময় অসময়ের প্রয়োজনীয় স্মাইল কিংবা হাসিগুলো।

প্রেস ব্রিফিং আছে একটু পর। আজকের আপডেট কী?

স্যার, গত ২৪ ঘণ্টার সার্কেলে টোটাল মারা গেছেন ৩৯ জন! আর আক্রান্ত হয়েছেন ৩২৬ জন স্যার।

হুম! নম্বর কনফার্ম করছে আর কেউ?

না স্যার, আপনার অনুমতি পেলেই প্রেস ব্রিফিংয়ে ফাইনাল নাম্বার সাবমিট করা হবে।

হুম! এতজন মরল গতকাল? অন্য রোগে মরছে, নাকি ভাইরাসে? জানো তো ঠিকঠাক? নাকি আন্দাজে সব বসায়ে দিচ্ছে সবাই?

না না স্যার। একদম পাক্কা খবর স্যার।

কথা বলার সময় শফিকের ফোনে কল এল। শফিক দেখল রিয়াজ সাহেব মহামারীর জন্য গঠিত সেন্ট্রাল অফিস থেকে ফোন দিয়েছেন। স্যার! রিয়াজ সাহেবের ফোন স্যার। ধরব?

হুম হুম ধরো। আমাকে ক্যান জিজ্ঞাসা করতেছ?

হ্যালো? হুম.....আচ্ছা...... হুম । হুম, হ্যাঁ, আচ্ছা, জ্বি আচ্ছা, এগুলো দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখল শফিক।

সংখ্যা একটা বেড়েছে স্যার। সে ক্ষেত্রে ৪০ হচ্ছে স্যার, ৩৯ নয়। আজ ভোর ৮টার দিকে আরেকজন মাইনাস হইছে স্যার। খিলগাঁওর ফরাজী হাসপাতালে স্যার, যা কি না কাট অফ টাইম ৯টার আগে।

মাইনাস? এগুলো কি বলো শফিক?

সরি স্যার। আপনার ওপরে প্রেশার এল দেখেই একটু আপসেট হয়ে বলে দিয়েছি স্যার। মাফ করবেন স্যার।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হুম...আচ্ছা আচ্ছা। এখন অ্যাড করে দাও তাইলে হিসাবে। ফাইনাল প্রিন্ট দাও। সাইন করে দিলে পাঠায়ে দাও ফর প্রেস ব্রিফিং।

স্যার, এই শেষ এন্ট্রি টা অ্যাড কইরেন না স্যার।

কেন? অ্যাড করব না কেন?

না মানে…স্যার, অন্যাভাবে নিবেন না স্যার। আপনি অনুমতি দিলে আমার পারস্পেকটিভটা বুঝিয়ে বলি স্যার?

হুম… বলো!

অ্যাড করলে রাউন্ড ফিগার ৪০ হয়ে যাবে স্যার। রাউন্ড ফিগার বললে মানুষজন সন্দেহ করবে। রাউন্ড ফিগার ভালো লাগে স্যার ছোটখাটো লেনদেনে, কেনাকাটায়। ১০১ কিংবা ১৩১ টাকা হলে কোনো না কোনো পক্ষ ১ টাকা ছেড়ে দেয়। রাউন্ড করতে পারার একটা আরাম পায় সাধারণ মানুষেরা স্যার। কিন্তু এই মহামারি মৃত্যুর বিষয়ে কেমন যেন ফেক ফেক ফিগার লাগে। মানুষ একই সঙ্গে অনেক আবেগপ্রবণ এবং বদ স্যার। হিউম্যান সাইকোলজি কিংবা পাবলিক সেন্টিমেন্ট ঠিক রাখতে হবে স্যার আমাদের। সামনের বছর তো স্যার নির্বাচন। সব মিলিয়ে...

হুম...তো কি করতে বলছ তুমি?

স্যার ৩৯ থাক। এইটা অ্যাড করার দরকার নাই স্যার। সংখ্যায় একজন কম হলে স্যার কিছুই হবে না, কিন্তু জনগণের মানসিক শান্তি কিংবা আপনার প্রতি সমর্থন কিন্তু স্যার একটি মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি। একটা নিউমেরিক ফিগার আপনার অবস্থান কাঁপাতে পারে স্যার। বিশাল স্বার্থে তাই এভাবে চেপে যাওয়াটা কোন অন্যায় না স্যার।

হুম...সচিব সাহেব চোখ বুঝল হুম বলে। শফিক জানে সচিব সাহেব খুশি হয়েছেন এই অসাধারণ যুক্তিতে। সচিবের মুখের রিলাক্স ভাব শফিক চেনে। জয়ী ভঙ্গিতে শফিক সালাম দিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে।

প্রেস ব্রিফিং হয়ে গেছে একটু আগে। একটু ব্রেক নিতে ক্যানটিনে বসে আছে শফিক। সামনের মাসে একটা নতুন গাড়ি কিনবে ভাবছে। একটা ড্রাইভার রাখবে। শফিকের একাউন্টে গত বছরেই বিশাল অঙ্কের টাকা জমা হয়েছে। সচিবের ছেলেপুলে নেই। শফিক দুই হাতে কমিশন পাচ্ছে সব কাজেই। এমন না যে তাকে অনেক চালাকি করতে হচ্ছে। সচিব সাহেব নিজে হাতেই দিয়ে দেন। শফিক তরতর করে উঠেছে গত ২ বছরেই।

ভাবতে ভাবতে অনেক সময় চলে গেল। শফিক তার ট্রাউজারের ডান পকেট থেকে ছোট একটা বাটন ফোন বের করল। এটা তার ব্যক্তিগত মোবাইল। শুধু পরিবার, বন্ধু এবং কিছু মানুষ এর কাছে এই নম্বর আছে। ২৪/৭ এটা সাইলেন্স এ থাকে। একদম ব্যক্তিগত সময়ে যদি ইচ্ছা হয়, তাহলেই সে দেখে কেউ ফোন দিল কি না। কখনো ইচ্ছা হলে ছোট ভাই কিংবা বন্ধুদের কিংবা বাবার সঙ্গে ২/৩ সেকেন্ডের সালামের কথোপকথন করা হয়। শফিক দেখল রুমি ভাইর ৫টা মিসকল। রুমি শফিকের খালাতো ভাই। খিলগাঁও থাকেন। পরিপাটি সংসার। শিক্ষকতা করেন আর পাশাপাশি কিছু চ্যারিটি প্রজেক্ট এও জড়িত। রুমি ভাইকে গ্রাম থেকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন শফিকের বাবা ইন্টার এর পরে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ভালো জায়গায় গিয়েছেন। কখনো শফিককে কিছু বলেননি, তবে এড়িয়েই চলেন গত কিছু বছর ধরে। হয়তো শফিকের বাবার মতো মতাদর্শে। যা–ই হোক, তাতে শফিকের কিছুই যায় আসে না। সে কোন অন্যায় করছে না। সে না করলে অন্য কেউ করবে। কেউ না করলেও ওপরের কাজ হতেই থাকবে।

শফিক ফোন দিল।

কেমন আছেন ভাইয়া? সরি ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। খেয়াল করিনি (রুমি ভাইকে ফোন দিয়ে শান্তভাবে কথা বলছে শফিক)

তুমি কোথায়?

অফিসে ভাইয়া।

শফিক। আমি তোমার অফিসের দিকেই আসতেছিলাম। আমি রাস্তায়। ফোন ধরছো না দেখে কোনো উপায় না পেয়েই …।

শফিকের রাগ উঠে গেল অকারণেই। ফোন না ধরলেই কি চলে আসবে কেউ? ভেবেছিল একটু আগেই অফিস ছাড়বে আজ। এখন উটকো ঝামেলা এসে হাজির হচ্ছে। রাগ আর বিরক্তের ওপরে নিয়ন্ত্রণ রেখেই শফিক বলে উঠল…।

ফোন দিয়েছেন ভাইয়া বুঝলাম, ধরতে পারিনি কারণ বিজি ছিলাম। কল ব্যাক তো করব ফ্রি হয়ে ভাইয়া। তা–ই না? তার ওপরে আমার আজ অনেক টাইট শিডিউল। ফোনেই বলেন না ভাইয়া। আসাই কি লাগবে?

শফিক। একটা খারাপ সংবাদ আছে। ফোনে পাচ্ছিলাম না। বিপদের মধ্যে বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত? তাই রওনা দিয়েছিলাম তোমার অফিসের উদ্দেশ্যে …।

শফিক চুপ করে আছে। কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো তার। ন্যানো সেকেন্ডে সে টেড় পেল তার বুক ধরফর করছে।

কি হয়েছে ভাইয়া?

শফিকের অশান্ত লাগছে। রুমি ভাইর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সে ব্যাগ নিয়ে লিফটের দিকে নিচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

শফিক… ( রুমি ভাই চুপ। রাস্তার কোলাহোল আর শহরের ব্যস্ততা ছাপিয়ে শফিক পরিষ্কার শুনতে পেল উনি ফুঁপিয়ে কাঁদছে)

ভাইয়া! এই ভাইয়া। কী হইছে? বলেন না ভাইয়া!

তোমার আব্বু! খালুজান! খালুজান নাই শফিক!

শফিক পরিষ্কার বুঝল কি শুনেছে সে। তবু কেমন যেন অচেনা লাগল অনুভূতিটা। কোন কথা বলতে পারছে না। ওপাশের গুমোট ফুঁপানো কান্নার শব্দ আর নিস্তবতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে চলেছে এ পাশের দেহটাকেও।

সামলিয়ে উঠে রুমি শান্তভাবে আবার বলতে লাগল...।

খালুজানের শরীরটা ৩/৪ দিন যাবৎ ভালো যাচ্ছিল না। তোমার ছোট ভাই রফিক গতকাল আমাকে জানায়। আমি বাসায় নিয়ে আসলাম বিকেলেই। কিন্তু অবস্থা খারাপ দেখে পরে রাতেই আমি খিলগাঁওর হাসপাতালে খালুকে নিয়ে যাই। রাতে ডাক্তাররা সেভাবে খারাপ কিছু ভাবেননি। মনে সাহস এসেছিল সবার। উনিও স্বাভাবিক ছিলেন। ভোরেই নাকি শরীর অবনতির দিকে যেতে থাকে। রফিক অনেক কাঁদছিল ফোন দিয়ে। আমি মিলাতে পারছিলাম না। তাই আমি তোমাকে একবার ফোন করি যেতে যেতেই। ধরোনি। হাসপাতালে যেতে যেতে ৯টা বেজে যায়। গিয়ে আর পাইনি শফিক…(রুমি ভাই হাউমাউ করে কাঁদছেন। চিৎকার করছেন প্রায়। শফিক চুপ করে আছে।)

ভোর ৮টার দিকে চলে গেছেন রে শফিক। পাই নাইরে শফিক। পাই নাই আমি গিয়ে…(রুমি ভাইর কথা অস্পষ্ট হয়ে গেছে এই পর্যায়ে। উনার গোঙানি শোনা যাচ্ছিল।)

শফিক রে, ভাইরে, তোর আব্বা, তোর আব্বা রে শফিক। উনি না থাকলে…আমিও থাকতাম না আজকে। আমার খালুজান না থাকলে আমি রাস্তায় কুত্তাও থাকতাম না রে শফিক। শফিক রে, কিছুই তো দিলাম নারে খালুজানরে। বলতেও তো পারি নাই সাহস করে কিছু কোনো দিন। কেমনে জানামু এখন? (রুমি ভাই চিৎকার করছেন। গোঙাচ্ছেন। হাঁসফাঁস করছেন। ফোনের এপাশে যা কি না দ্বিগুণ ভয়ানক শোনাচ্ছে।)

এভাবে কয়েক মিনিট গেল হয়তো। শফিকের তখন সময়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একটু সময় গেলে পরে, শান্ত হয়ে রুমি ভাই বলতে লাগল।

ভাইরাসজনিত সব সিনড্রোম ছিল তোর আব্বুর। পরে তা ডাক্তাররাও কনফার্ম করেন। আর খালুর তো হার্টের একটু প্রবলেম আগেই ছিল। ড্রামাটিক্যালি ফল করে ওনার সিচুয়েশন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু ওলট–পালট হয়ে গেল।

শফিক একদম চুপ করে শুনছে।

তুমি আসো শফিক। আমি হাসপাতালের দিকে যাই তাহলে?

জি ভাইয়া…আসতেছি।

ফোনটা কোনোমতে পকেটে ঢুকিয়ে শফিক কিছু যেন ভাবতে লাগল। ঠিক এমন সময়ে সচিব সাহেবের পিয়ন মঈন সামনে এসে বিগলিত হাসি দিয়ে বলল ‘শফিক সাহেব। নিউমেরিক্যাল ফিগারের মার্ভেলাস এক্সপ্লেনেশন দিয়ে আজকে আপনি দেখাইলেন। ট্রিমেন্ডাস বস! হা হা হা...। ইউ আর সিম্পলি জিনিয়াস’।

শফিক চুপ করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। শফিক চোখের পাতা ফেলছে না। ফেললেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তিলে তিলে গড়া সাম্রাজ্য। শফিকের কাছে সেই নিউমেরিক্যাল নাম্বার এখন আর নাম্বার এক নয়।

মঈন সাহেবের সামনে থেকে কিছু না বলেই মুখ ঘুড়িয়ে শফিক ক্যানটিনের এক কোনায় চলে গেল। একটু একা থাকতেই হবে এখন। ঠিক করে দাঁড়াতে পারছে না। দুর্বল লাগছে।

শফিকের সামনে বিশাল কাচের দেয়াল। ওপাশেই খুব ব্যস্ত শহরের হুড়োহুড়ি। শব্দহীন এই শহরের দৃশ্য দেয়ালের এ পাশে দাঁড়িয়ে দেখলে শিহরণ জাগে শফিকের। কিন্তু শফিক কিছুই দেখছে না ঠিকমতন। ঝাপসা লাগছে। কুয়াশা নাকি আজ অনেক?

শফিকের মাথা দপ দপ করছে। হাত–পা ঝিম ধরে গেছে। শফিক কি ভাববে বুঝতে পারছে না। কি করবে, তা–ও জানে না। আছড়ে আছড়ে পরছে শফিকের ভাবনাগুলো। খালি মনে হচ্ছে সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আব্বার চেহারা মনে পড়ছে না কোনোভাবেই শফিকের। কি অবাক করা বিষয়। শেষ কবে দেখেছিল আব্বাকে? এই তো ছয়–সাত দিন আগেই তো? শফিক তো সপ্তাহে কম করে এক দিন হলেও যেত। অন্ধকারে গলির মোড়ের চা–দোকানে কিংবা কালো গাড়ির কাঁচের এ পাশে বসে সব সময় আব্বাকে দেখে আসত। আব্বা না তাকালেও আব্বার চেহারা দেখতে ভালো লাগত। আব্বার পরনে সাদা–কালো চেকের একটা পুরোনো ফতুয়া ছিল শেষদিনে। মসজিদে যাচ্ছিল। ফতুয়াটা শফিক কিনে দিয়েছিল এক ঈদে। টিউশনির টাকা দিয়ে। পুরোনো হয়ে গেলেও আব্বার ফেলেন নাই ফতুয়াটা। শফিকের যে কি খুশি লেগেছিল।

শফিকের মাথা দপ দপ করছে। হাত–পা ঝিম ধরে গেছে। শফিক কী ভাববে, বুঝতে পারছে না। কী করবে, তা–ও জানে না। আছড়ে আছড়ে পরছে শফিকের শত শত চিন্তা আর ভাবনাগুলো। একপর্যায়ে শফিক আর সামলাতে পারল না। মাথা ঘুরে পরে গেল সামনের থাকা টি টেবিলের ওপরেই।

সব ঘোলা। চারদিকে অনেকজন। সবাই অনেক কিছু যেন বলছে। একদম অল্প অল্প দেখতে পাচ্ছে শফিক। শুনতেও পাচ্ছে না। কেউ একজন বলল মনে হয়…।

এই শফিক। শফিক। শুনতে পাচ্ছো? এই শফিক?

শফিক বুঝল সচিব সাহেব তাকে ডাকছেন। তার গালে পানি ছিটিয়ে আলতো চাপড় দিচ্ছেন। শফিক সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হতে। সচিব সাহেব প্রশ্ন করছেন। উত্তর দিতে হবে। উত্তর না দেওয়া অসম্মানের। খানিকক্ষণ সময়ের পর শফিকের মনে হলো, সে এখন উত্তর দিতে পারবে। অস্ফুটভাবে শফিক বলল…।

স্যার? ওনাকে যে দেখতে যাইতাম, ‘আমি যে ভালোবাসতাম। আব্বা কি জানত স্যার?’

*লেখক: মাঈনুল ওয়াদুদ সুমন, ডার্টফোর্ড, যুক্তরাজ্য