অসাধারণ বাঙালি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রিসেপশন রুম খুব যে ছোট, তা নয়, তবে রোগীর সঙ্গে আত্মীয়স্বজন এলে বসতে চেয়ার খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি সিরিয়াস কোনো কেস এলে কম সিরিয়াস রোগীর চেয়ারটুকুও ছেড়ে দিতে হয়! যেমনটা আমি দিলাম দুবার। রোগটা অনেক দিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি। জনসম্মক্ষে অসংকোচ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা হতো না। তবে আর কত? শেষটা দেখে নেওয়া উচিত।

এ হাসপাতালে ডার্মাটোলজিস্ট নেই। তারা আমাকে তাদের আরেকটা বড় শাখায় ট্রান্সফার করল। ওই ট্রান্সফার অ্যাপ্রুভাল আসতে আসতেই দুই ঘণ্টা! বসে বসে কিছুক্ষণ গেমস খেললাম। বিরক্ত এসে গেল একপর্যায়ে। মুঠোফোনে ডেটা নেই। ডেটা ছাড়া মুঠোফোন হচ্ছে হুদাই একটা ফালতু মেশিন!

অ্যাপ্রুভাল নিয়ে ঠিকানাসমেত হাঁটা ধরলাম তাদের বড় শাখায়। হাঁটতে মোটেও ভালো ঠেকছে না। হাত-পা কেমন খসখস করছে। একজনকে জিজ্ঞেস করায় বলল, ১০ মিনিটের পথ। তাই হেঁটে চললাম। আনুমানিক ৪০ মিনিট হাঁটার পর বুঝলাম—লোকটা হয়তো গাড়ির হিসাবে ১০ মিনিট বলেছিল। আমি তো গাধা! তবু এ গাধা কিন্তু রিসেপশনে ইনস্যুরেন্সের কথা তুলতে ভোলেনি। পকেটকাটা থেকে রক্ষা পেয়েছে অনেকটাই।

এখানে এসে সেই আবার রিসেপশনে ভিড়! অপেক্ষা। তারপর ট্রান্সফার আপ্রুভাল দেখালাম। রিসেপশনে বসে থাকা ভারতীয় মেয়েটা গলা উঁচিয়ে আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছে। তারা খুব কাজে আসে সাধারণ বাঙালিদের জন্য; অন্তত ভাষাগত সমস্যা থেকে। আমি কিন্তু সাধারণ বাঙালি নই! চটাং চটাং বেশ বলতে পারি আরবি। কখনো কখনো কিতাব থেকে ধার করা শুদ্ধ শব্দগুচ্ছ ছুড়ে মারি। তখন শেখদের চেহারা অনেকটা আলুথালু দেখায় বৈকি। মজা পাই বেশ!

উর্দু ভাষাও নখদর্পণে। এই এক ভাষায় পাকিস্তানি, নেপালি আর ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে আড্ডা বেশ জমে কখনো কখনো। আরবিতে মিসরীয় আর ইয়েমেনিদের সঙ্গে খোশগল্প মিস হয় না খুব। মিসরীয়রা আবার দু-একটা ইংরেজি ছুড়ে, যেগুলো বুঝতে অনেকটাই চাপ প্রয়োগ করতে হয় মস্তিষ্কে।

‘হ্যালো ফ্রেন্ডস’–কে যখন ‘য়ালো ব্রেন্স’ বলে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইবে, তখন তার দিকে আকর্ষিত হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না প্রায়ই। ধীরে ধীরে যখন তাদের ভাষার ধরন বুঝে যাবেন, তখন আবার এই সমস্যা থাকবে না।

থার্ড ফ্লোরে আমার চিকিৎসক। পাঁচ মিনিট ধরে সিঁড়ি খুঁজছি ওপরে ওঠার! লিফটে তো বয়স্করা উঠবে। বেঁচে থাকলে সামনের মাসে পঁচিশে পা দিতে ইচ্ছুক যুবকের বুঝি লিফটে চড়া মানায়? সিঁড়ি না পেয়ে চেহারায় খানিকটা হতাশা ফুটে ওঠার কথা, কিন্তু তার আগেই সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটা বলে উঠল, বারাদার! এরকাব আসানসির। (ভাই, লিফটে চড়ুন)

আসলে আমি অসাধারণ বাঙালি সাজতে গিয়ে অনেক জায়গায় সমস্যায় পড়ি। কোথাও কোথাও বাহ্যিক আবহের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না যেন। যেমনটা খাপ খায়নি এই হাসপাতালে। অসাধারণ বাঙালি হতে গিয়ে যুবকের রোল প্লে করতে গেলাম, তারপর ডট ডট ডট। যদিও অপমান বোধ করি, তবে শিখে চলছি প্রতিনিয়ত। এসবের ভিড়ে একটা জিনিস আমাকে স্বস্তি দেয়, এখানে কেউ কারও ব্যাপারে খুব একটা নাক গলায় না। অনিচ্ছাকৃত বা না জেনেশুনে কোনো ভুল করলে সবাই আপনাকে চিড়িয়াখানার জন্তু মনে করে তাকিয়ে থাকবে না। খুব বেশি পরামর্শ দেবেন না। কারণ, তারা উপলব্ধি করে, কখনো কখনো এমন কঠিন মুহূর্তে নিজেরাও পড়ে। মানুষ তো কোনো নির্দিষ্ট রোবটিক গণ্ডির আওতাভুক্ত না।

এই হাসপাতালে রোগীদের জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই। নেই বলতে সেকেন্ড ফ্লোর পর্যন্ত নেই। স্টোররুম থেকে শুধু কর্মচারীদের জন্য একটা সিঁড়ি আছে শুনেছি। অদ্ভুত ঠেকল বিষয়টা।

কিছুদিন আগেও একটা অদ্ভুত বিষয় ঘটেছে আমার সঙ্গে, নির্ঘাত গাড়ির নিচে পিষে যাওয়া থেকে রক্ষা পেলাম। বেঁচে ফিরলাম। অদ্ভুত ঠেকল বিষয়টা।

থার্ড ফ্লোরে অনেক অনেক কামরা। কোনো রোগী নেই, রোগী দূরে থাক একটা মানুষও নেই এখানে। যতক্ষণে ডাক্তার সাহেবার (নারী ডাক্তার) রুম খুঁজে পেলাম, ততক্ষণে উনি বেরিয়ে আসছেন আজকের মতো। আগামীকাল আসতে বললেন। আমাকে আসতে হবে, কারণ আমি অসাধারণ বাঙালি, উচ্চবাচ্য বা অধৈর্য হলে চলবে কী করে?
*হাসান কামরুল, মধ্যপ্রাচ্য