প্রস্থান
সময় সকাল সাতটা। খুব তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে উঠলাম উদ্দেশ্য জোগজাকার্তা। ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষা শহর বলে যার খ্যাতি পৃথিবীতে। তাই দ্রুতবেগে হোটেলের লবিতে এলাম। লবিতে আসতেই হঠাৎ থমকে গেলাম। কালো টি–শার্ট আর প্রিন্টের পায়জামা পরিহিত দণ্ডায়মান স্বর্গের অপস্বরি। আসলে পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষকে দেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় বা জায়গার দরকার পড়ে না। প্রথম দেখাতেই কেন যেন এ মেয়েটির ওপর মায়া পড়ে গেল। নিজের জড়তা কাটিয়ে বুকে সাহস নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। পরিচয়ের মাধ্যমে শুরু হলো কথোপকথন। সামনের মানুষটির কাছ থেকে তার নামটি প্রথম শোনামাত্রই মনের মধ্যে গেঁথে রইল। ডোরা কিস, হাঙ্গেরির বাসিন্দা, সম্পর্কে আমার ক্লাসমেট।
সকাল ১০টায় আমাদের ফ্লাইট। যথাসময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরও শত চেষ্টার ফলেও বিমানে সহযাত্রী হিসাবে তাকে আমি পাইনি। তারপর ঘটে গেল আরও অনেক কিছু। বাদ যাক আর কিছুদিনের ইতিহাস। হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি এক দিনের আনন্দভ্রমণের আয়োজন করা হলো।
দিনটি ছিল আমার জন্য বিশেষ রকমের শুভ। কারণ, আমার জন্মদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মাইক্রো বাসে করে আমাদের ভ্রমণ শুরু। এবার আমার পাশের সহযাত্রী তিনি। নিজেকে কেমন যেন ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। ডোরা দেখতে যেমন মিষ্টি, ওর গায়ের গন্ধটাও মিষ্টি। যথাসময়ে যাত্রা শুরু হলো। শহর পেরিয়ে গ্রাম, গ্রাম পেরিয়ে দিগন্তজোড়া পাহাড়ের সারি। এরই মধ্যে আমি আবিষ্কার করলাম আমার কাঁধে মাথা দিয়ে ডোরা পরম আরামে ঘুমাচ্ছে। ২৭ বছর বয়সে এই প্রথম আমার কাঁধে কেউ তার মাথা রেখেছে। এ স্মৃতিকে সারা জীবন স্থায়ী করে রাখার জন্য বিনা অনুমতিতেই মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দী করে ফেললাম। আর ঘুমন্ত রমণী এতটাই সুন্দর হতে পারে, আজ তা নিজের চোখে দেখলাম। ঘণ্টা দুইয়ের যাত্রাশেষে কোনো এক অজানা পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের যাত্রাবিরতি, উদ্দেশ্য সকালের খাবার খাওয়া এবং জিপে করে পাহাড় ভ্রমণ। আর এরই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটল আমার ভালোবাসার মুহূর্তের।
সকালের খাওয়া শেষে জিপে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হলো। দুজন বসেছি পাশাপাশি। জিপ আমাদের নিয়ে চলেছে দূরন্তগতিতে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চিকন রাস্তা। মাঝেমধ্যে হালকা ঝাকুনিতে ডরির হাত ওর নিজের অজান্তেই আমার হাতকে স্পর্শ করছে। এভাবেই আমাদের নিয়ে জিপ পৌঁছালো নাম না–জানা এক পাহাড়ের চূড়ায়। চারিদিকে পাইনগাছের সারি। এরই মধ্যে আমরা দুজন। আমি ডরিকে হঠাৎ করেই বললাম, ‘পাহাড়ের ওপর থেকে সব কিছুই নয়নাভিরাম। তুমি আর আমি পাশাপাশি পৃথিবীতে আর কোনো দিনই এত সুন্দর সময় হয়তো বা আর আসবে না।’
ডরি চুপ করে রইল। কোনো উত্তর না দিয়েই অন্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিল। আমি কিছুই বুঝলাম না।
তবে এতটুকু বুঝলাম যে আমি যত বড় শিকারি হই না কেন, এত সহজে সে আমার কাছে ধরা দেবে না।
পাহাড়ের বিকেলটা সত্যিই অসাধারণ। হঠাৎ সূর্যটার অস্ত যাওয়ার সময় হলো। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসঙ্গে সূর্যাস্ত দেখা। জীবনে এরচেয়ে আর হয়তো কোনো সুন্দরতম সময় আছে বলে আমার মনে হয় না।
আমি ডোরাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তোমার কবিতা তেমন লাগে?’
প্রতি উত্তরে ডোরা বলল, ‘ভালই লাগে।’
তাই আর দেরি না করেই বলা শুরু করলাম নেরুদার কবিতার কিছু লাইন—
‘My heart moves from cold to fire
I love you only because it’s you the one I love.
…
Maybe January light will consume
My heart with it’s Cruel
Ray, stealing my key to true calm.’
কবিতার মধ্যে নিজের অজান্তেই এই প্রথমবার আমি ডোরার হাত স্পর্শ করলাম। তাতে ডোরার অসম্মতি ছিল না। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর নীরব নিস্তব্ধতায় পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে এল। পাশ থেকে ভেসে আসছে দূরের ঝরনার পানির মৃদু শব্দ।
সারা দিনে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরে সবাই ক্লান্ত। পরের দিন দুপুরে আমাদের একসঙ্গে ক্লাস। যা–ই হোক ক্লাসে আমি সব সময় ডোরার সামনাসামনি বসার চেষ্টা করি। যাতে করে ওর দিকে অন্তত কারণে–অকারণে তাকানো যায়। আর এই সামনাসামনি বসার কারণে আমাদের মধ্যে প্রায়ই কথা–কাটাকাটির সৃষ্টি হয়, যার কারণে আমাদের শিক্ষকেরাও মাঝেমধ্যে চিন্তায় পড়ে যান। তবে একটি বিষয়ে আমাদের দুজনের ভীষণ মিল। দুজনেই কফি পান করতে খুব পছন্দ করি। প্রতিদিন শিক্ষকেরা পাঠদান করেন। আর আমি প্রতিদিনই একটু একটু করে ডোরার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছি। একটি মেয়ের মধ্যে যে সব গুণ থাকা দরকার, তার সব গুণই তার মধ্যে বিদ্যমান। রান্নার ব্যাপারে ডোরা খুবই পটু। আমাদের রান্নার ক্লাসে সেই সেরা। আসলে প্রেমে পড়লে নাকি মানুষের পাগল হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আমার বেলায় কী হয়েছে, আমি জানি না। আসলে মানুষ জাতি বড়ই অদ্ভুত। নিজে কী আশা করে, তা সে নিজেই জানে না। গত কিছুদিন আগে যাকে চিনতামই না, আজ তাকে দিনে একবার না দেখলে পেটের ভাত হজম হয় না। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শূন্যভাব অনুভূত হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় এখন বর্ষাকাল। দুই ঋতুর এই দেশের মানুষ সত্যিই অসম্ভব রকমের ভালো। আর আমার ১০ মাসের শিক্ষাজীবন প্রায়ই শেষের পথে। বন্ধুমহলের কল্যাণে ডোরার জানতে বাকি নেই আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আজকাল প্রেম পড়লে নিজের থেকে আর বলার দরকার পড়ে না। এদিকে ডোরার সঙ্গে আমার ১৫ দিন কোনো সাক্ষাৎ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারলাম, সে কোনো এক ইন্দোনেশিয়ান ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। হয়তো আমাকে ভালোবাসার কোনো কারণ ডোরা খুঁজে পাইনি আর তাই নিজের ব্যর্থতা নিবারণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম থেকে কিছুদিনের জন্য প্রস্থান করলাম।
লেখক: মো. আরফান রাশেদ, কমিউনিকেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ বিভাগ, ইউনিভার্সিটিস আহমেদ দাহলান, যাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া