এক জীবনে বহু জীবন

কৈশোরের খেলার সাথিদের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়া এসেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোটানি পোর্টের পাশে অবস্থিত কেলগস ফুড কোম্পানিতে একটা ক্লিনিং জব পেয়ে গেলাম। তখনকার হিসাব ছিল টাকার প্রবাহ থাকতে হবে। কারণ, সঙ্গে করে পরিবার নিয়ে এসেছি। আর টাকার প্রবাহ থাকলে অন্যান্য কাজও ঠিকঠাক হবে। কাজটা করতে গিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ ছিল না; বরং আমি খুবই উপভোগ করতাম আর সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতাম আমাকে এমন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এমন সুযোগ তো সবাই পায় না।

সেই কাজটা করতে গিয়ে কত রকমের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো। কেউ এসেছেন নৌকায় করে, কেউ আছেন এসাইলাম ভিসায়, কেউবা ছাত্র। ছাত্র হিসেবে এ দেশে এলে কি পরিমাণ হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়, সেই প্রথম জানলাম। সহকর্মীদের সঙ্গে আমার সব সময়ই সদ্ভাব হয়ে যায়। তাঁদের সঙ্গেও খুবই সুসম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। তাঁরাও আমাকে খুবই সাহায্য করতেন। অনেক সময় কাজ পড়ত ভবনের ছাদে।

লেখকের শৈশবের খেলার সাথি আজাদ
ছবি: সংগৃহীত

ওখান থেকে বোটানি পোর্ট দেখা যেত, যেখান দিয়ে ইংরেজরা এ দেশে ঢুকেছিল। তখনো এগুলো নিয়ে তেমন কিছু জানতাম না। তারা কি পরিকল্পনা করে এসেছিল, নাকি সাগরে ভাসতে ভাসতে এসে পড়েছিল? আমিও তেমন কোনো কিছু না ভেবেই এসে পড়েছিলাম অন্য গোলার্ধের সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দেশে। জীবন নিয়ে আমার নীতি খুবই সহজ। আমি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই, তারপর সেটার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিই।

এরপর জীবন চলছে, সিভিলের জব পেলাম। বছর ঘুরতেই সেটা বদলে বর্তমানের কোম্পানিতে যোগ দিলাম। আবার আমার কর্মক্ষেত্র সেই বোটানি এলাকা। তিনতলায় আমার ডেস্ক। আমার ডেস্ক থেকেই সিডনি বিমানবন্দরে বিমান টেকঅফ এবং ল্যান্ডিংয়ের শব্দ শোনা যায়। দেখা যায়, সারা দিন ধরে কত প্লেন আসছে আর যাচ্ছে। অবশ্য আমাদের তাকিয়ে থাকার অবসর নেই। আমরা শুধুই শুনি। কত মানুষ নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে এ দেশে আসে। কারও স্বপ্ন পূরণ হয়, কারোটা হয়তোবা হয় না, কিন্তু জীবন বয়ে চলে নদীর মতো।

মানুষের জীবন আসলে একটা আশ্চর্য বিষয়। কী জন্যই–বা আমাদের পৃথিবীতে আগমন। কোথায়ই–বা আমাদের গন্তব্য। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই–বা কী? এমন হাজারো ভাবনা আর প্রশ্ন নিয়ে জীবন কেটে যায়। এরপর আমরা একসময় মহাকালের স্রোতে হারিয়ে যাই। এরপর কেউ আমাদের মনে রাখল কি রাখল না, আমরা ইতিহাসের অংশ হলাম কি হলাম না, সেগুলোর কোনো কিছুই আর আমাদের কোনো কাজে আসে না। কিন্তু তবু আমরা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে জীবনকে অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা করি।

সপরিবার লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া বিভিন্ন মনীষী এবং ধর্মগুরু জীবনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন। আমরা সেগুলো নিয়েও ভাবি। অনেকেই সেগুলোর অনুসারে নিজের জীবনকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সেগুলো থেকে সামান্য বিচ্যুতি আবার আমাদের মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কি অদ্ভুত এক টানাপোড়েন নিয়ে আমরা সারাটা জীবন কাটিয়ে দিই। আজ জীবনের অর্ধেক বেলা পার করে এসে অনেক কিছুই বুঝতে পারি সহজে।

এর মধ্যেই জীবনে এসেছে পরবর্তী প্রজন্ম। তখন মনে হয়, তাহলে কি বংশ রক্ষা করাই আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য? ছেলেমেয়ে দুটো বড় হয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। তাদের অনেক প্রশ্ন। মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন আর অভিযোগ করে। আমি শুধুই শুনি। মন্তব্য করি সামান্যই। কথা শেষ করে সে বলে, তোমাকে কোনো কিছু বলার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, তুমি কোনো কিছু নিয়ে মন্তব্য করো না।

উত্তরে আমি বলি, দেখো, পৃথিবীর কোনো কিছুই ধ্রুব নয়। সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আজ যেটা ভালো, কাল সেটা মন্দ। আজ যেটা ঠিক, কাল সেটা ভুল। এমনকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসও বদলে যায়। তুমি শুধু জীবনের প্রবাহটার সঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাও। আর চেষ্টা করবে তোমার জীবনের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক, তাদের মনে রাখার।

তোমার বন্ধুদের মধ্যেই দেখবে অনেক মতবাদের মানুষ আছে। কিন্তু তুমি যদি তাদের তোমার বন্ধু ভাবো, তাহলে কখনো তাদের ছেড়ে দিয়ো না। আর একটা কাজ কোরো না সেটা হলো, শিকড়কে ভুলে যেয়ো না। কারণ, শিকড়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তোমাকে সব সময়ই আত্মবিশ্বাসী করবে। তুমি যদি জীবনে কখনো খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাও, তাহলে শিকড়ের কাছে ফিরে ফিরে আসবে এবং নিজেকে আবারও নতুন করে চিনতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে আমি আমার নিজের জীবনের কথা বলি।

আমি বলি, দেখো, আমার জন্ম বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত একটা গ্রাম চর ভবানীপুরে। চর হলো নদীর বুকে জেগে ওঠা স্থলভূমি। অনেক সময় নদী গতিপথ পরিবর্তন করলেও বিপরীত পাশে চর জেগে ওঠে। তোমরা যেটাকে বলো ‘রিভার ল্যান্ড’। সেই এলাকায় নাগরিক জীবনের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ছিল একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার খেলার সাথি ছিল আমাদের বাসার কাজে সাহায্যকারী আমারই সমবয়সী একটি ছেলে। কিন্তু আমাদের দুজনের বয়স একই হওয়াতে আমাদের বোঝাপড়াটা ছিল চমৎকার।

সেই চর এলাকা থেকে এসে আমি আজকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছি। তুমি নাগরিক জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছো। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু মানুষের বদান্যতার কারণে। আমি তাই কখনোই মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাই না। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার মতের মিল নেই, কিন্তু আমি তাদের কাউকে ছেড়ে দিইনি। আমি চেষ্টা করি তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখার। এটার বাস্তব উদাহরণ দেওয়ার জন্য গতবার দেশে গিয়ে তাদের আমাদের গ্রামের বাড়ি চর ভবানীপুর নিয়ে গিয়েছিলাম। দেখা করিয়ে দিলাম আমার শৈশবের খেলার সাথি আজাদের সঙ্গে।

আজাদ গ্রামসম্পর্কে আবার চাচাও হন। আমাকে কাছে পেয়ে তাঁর কী উচ্ছ্বাস! আমি বললাম, এটাই আসল আনন্দ। আমি সমাজের একেবারে তলানি থেকে উঠে আসা মানুষ। এরপর বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়েছি। তারপর বাংলালিংকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এমনকি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিও করেছি। তাই বলতে পারো, জীবনের প্রায় সব কটি অধ্যায় আমি দেখে ফেলেছি। আমি জানি, মনের শান্তি কোথায়।

আমি জীবনকে তাই বলি, এক জীবনে বহু জীবন। মানে একটিমাত্র জীবনেই আমি অনেক পর্যায়ের জীবন দেখে ফেলেছি। চরম দারিদ্র্য দেখেছি। এমনও অনেক দিন গেছে একবেলাও খেতে পাইনি। আবার এখন আমাদের বাসাতেই প্রতি সপ্তাহে কত খাবার নষ্ট হয়। এখন তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারো, কেন আমি তোমাদের খাবার নষ্ট করতে দিই না। কারণ, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ক্ষুধার চেয়ে বড় সত্য আর নেই। আমার দাদি মানে তোমার গ্রেট গ্রান্ড মা বলতেন, ‘ভাতের কুড়কুড়ি কি যৌবনের কুড়কুড়ি।’