ভিনদেশি এক তারা

রমজান মাস এখন। সারা চেষ্টা করে, ইফতারের আগেই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আসতে। ইফতারটা শান্তিমতো বাসায় বসে না খেলে ভালো লাগে না যেন। ও রিসার্চ করে স্টকহোমের ক্যারলিন্সকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিয়াম ওর হাসবেন্ড। পিএইচডির একটা স্কলারশিপ নিয়ে সারা এসেছে এ দেশে। সিয়াম চিকিৎসক, পড়ছে এফসিপিএসের জন্য। সারার পিএইচডি শেষ হলেই ও সরকারি চাকরিতে ফিরে যাবে। সিয়াম আপাতত পড়ছে। টোনাটুনির ছোট্ট একটা সংসার ওদের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নামমাত্র দামে দিয়েছে সারাকে। কাজে প্রচণ্ড মন দিয়েছে সারা, যেন আড়াই থেকে তিন বছরে পিএইচডিটা সেরে দেশে ফিরতে পারে ও। এর বেশি ছুটি পাবে না। বাসে–ট্রেনে করে ছুটির দিনে তবু ওরা ঘোরে। রিয়া বা সেলে জিনিস পেলে সবার জন্য টুকটাক কেনে।

ক্যারলিন্সকার মুক্তি আপু রাশভারী একজন চিকিৎসক। এ দেশে সেই ছোট্টবেলায় এসেছেন, সুইডিশ মা–বাবার কাছে মানুষ, চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু বাংলা বলার চেষ্টা করেন শুদ্ধভাবে। সবার কাছে ভীষণ রাশভারী একজন। কিন্তু সারা বোঝে, দেশের যে কাউকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় সংগঠক। দেশের যেকোনো প্রয়োজনে ফান্ড সংগ্রহে তিনি আছেন। শীতের কাপড়, খাবার ওষুধসহ কত কিছু জাহাজে পাঠাতে সাহায্য করেন, অথচ দেশে যেতে চান না কখনো। সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরে সারার সে কথা জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। কিন্তু একদিন বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় ওদের কথা শুনে সেই যে উনি পরিচয় করে নিয়েছিলেন, সেই থেকে সবকিছুতেই বড় বোনের মতো ওদের আগলে রেখেছেন।

গতকাল ছিল স্বাধীনতা দিবস। সারা আর সিয়ামের খুব মন খারাপ, স্মৃতিসৌধে যাওয়া নেই, শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান নেই, এ কেমন স্বাধীনতা দিবস? এমন সময় মুক্তি আপুর ফোন পেল ওরা, ‘সিয়াম, সারা চলে এসো, ইফতার আর সাহ্‌রি খেয়ে বাসায় যেয়ো। তোমাদের জন্য একটা চমক আছে আপুর বাসায়।’ ওরা গেল। আপুর বাসায় একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছেন, কারও বাবা। কোরআন তিলাওয়াত আর শহীদদের জন্য দোয়া শেষ হতে হতে ইফতারের সময় হয়ে গেল। নামাজ পড়ে সবাই ইফতারের জন্য বসল। মুক্তিযোদ্ধা চাচা কেন যেন মুক্তি আপুর মুখের ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না। ব্যাপারটা অদ্ভুত। সারা বলল, ‘সিয়াম, চাচা এত অদ্ভুত ভালোবাসার চোখে তাকিয়ে আছেন কেন বলো তো!’

চাচা মুক্তি আপুর কাছে গিয়ে বললেন, ‘মামনি তোমার মায়ের নাম কি কণিকা ছিল? বাবার নাম জাভেদ?’ মুক্তি আপু থমকে দাঁড়ালেন, তারপর কান্নাভরা চোখে জানতে চাইলেন, ‘ও দুটো নাম আপনি কী করে জানলেন চাচা?’ তিনি বললেন, ‘ওরা যে আমার আত্মার অংশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আর পরে সহকর্মী ছিলেন রে মা। তোর মুখ হুবহু তোর মায়ের মুখ। ২৫ মার্চ এক বছরের শিশু তোকে ফেলে রেখে ওদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। মা রে, তুই যে বেঁচে আছিস তা তো জানতাম না।’

মুক্তি আপু অনেক কাঁদছেন। তাঁর সুইডিশ মা–বাবা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। কী এক কারণে ওনারা বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। মা–বাবাহীন ছোট্ট শিশুকে নিজের করে ফিরেছেন। কিন্তু মুক্তিকে সব সময় জানিয়েছেন, দেশের জন্য শহীদ হওয়া মা–বাবার সন্তান তিনি। দেশের প্রতি অনেক দায়িত্ব তাঁর।

এ ঘটনার পর তিনটা বছর পেরিয়েছে। সারা আর সিয়াম দেশে ফিরে যাচ্ছে। দিনটা কাকতালীয়ভাবে ২৬ মার্চ। ওদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেশে যাচ্ছে এক ভিনদেশি তারা মুক্তি। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে এক মাস কাজ করবে, তারপর সুইডেনে ফিরবে।