আজ নীরুর জন্মদিন

রাত ১২টা ১ মিনিটে ফোন করে নীরু বলল, এই যে নিশাচর সাহেব, আমার জন্মদিন শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি উইশ করো। চাই, প্রথম উইশটা তোমার হোক। তুমি তো আর এ জীবনে মনে রাখতে পারবে না, তাই আমাকেই বেহায়ার মতো ফোন করে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে।

আমার বনেদি ভুলোমন। ঘণ্টার হিসাবই ঠিক থাকে না। আর জন্মদিন তো আসে বছরে একবার। মনে রাখার মতো এত কঠিন কাজটি আমি কখনোই করতে পারি না। নীরু নীরবে মেনে নিয়েছে। আচ্ছা, তার প্রশ্রয় কি আমাকে দিনে দিনে আরও বেপরোয়া করে তুলছে? নাকি কর্তব্যজ্ঞানহীন!

আমি তড়িঘড়ি করে উইশ করলাম। হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার নীরু। আল্লাহ তোমার মন এ ধরণির সমান বড় করে দিন। মনের সব চাওয়া পূর্ণ করে দিন। তুমি হলে এক অসাধারণ প্রণয়িনী। এ গ্রহের একমাত্র ব্যতিক্রমী নারী। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত।

নীরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এমন অসাধারণ কে হতে চায়! আচ্ছা শোনো। বার্থডেতে আমাকে কী দিচ্ছ তুমি?

আমি খানিক চিন্তা করে বললাম, মঙ্গল গ্রহে একখণ্ড জমি। চাঁদেও নিতে পার। মনে হয় চাঁদে ভালো হবে। ধবধবে আলোতে...

আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে নীরু বলল, আমি যদি একটা কিছু চাই, দেবে?
আমি তো তোমাকে যন্ত্রণা ছাড়া তেমন কিছুই দিতে পারিনি। শুধু মুখ থেকে একবার বের করে দেখ। এ গ্রহে না পেলে অন্য গ্রহ থেকে হলেও এনে রাখব তোমার পায়ের কাছে।

শোনো। কষ্ট করে এত দূরে যেতে হবে না। তোমার কাছে শুধু একটা দিনই চাই। খুব সুন্দর একটা দিন। একসঙ্গে পথে পথে ঘুরব। কিন্তু কোনো উল্টাপাল্টা করতে পারবে না।

কিন্তু আমার তো ঘুম থেকে উঠতে দুপুর হয়ে যায়। এটা একটু কনসিডার করা যায় না?
আচ্ছা ঠিক আছে, বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দিলেই হবে। তুমি তো নিশাচর, তাই সকালে খালি রাখছি, যেন বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে পার। দয়া করে তোমার অতি জরুরি কিন্তু ফালতু কাজগুলো পরের দিনের জন্য তুলে রেখো।

নীরুর কথা শুনে আমার বেশ মায়া হলো। এত চমৎকার একটা মেয়ে কেন যে আমার মতো একটা বাউন্ডুলে ছেলের প্রেমে পড়তে গেল! অধিকারকে কত ছোট একটা আবদার বানিয়ে সেটা আবার চেয়ে নিতে হচ্ছে। প্রেমিকের ছন্নছাড়া স্বভাবের অভিজ্ঞতা তো আর কম হলো না!

পরদিন বিকেলে আমি সঠিক সময়ে পৌঁছালাম। এই প্রথম আমার সময়জ্ঞান দেখে কি না, তার চেহারায় অদ্ভুত সুন্দর হাসির আভা ফুটে উঠল।

নীরু নীল শাড়ি পরেছে। চোখে গাঢ় করে কাজল টানা। হাতে দোলনচাঁপা ফুল যত্ন করে ধরা। ফুলগুলো একটু আগে আমিই দিয়েছি।


নীরুর সামনে ফুচকার প্লেট। ঝাল ঝাল ফুচকা মুখে দিয়ে আমার কুঁচকানো পাঞ্জাবির দিকে একবার তাকাল। কিছু জিজ্ঞাসা করল না। এটা নিয়ে অবশ্য তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তবু বললাম, আসার আগে পাঞ্জাবি পরে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছিলাম। সমস্যা নেই তুমি পাশে থাকলে আমার দিকে কারও নজর পড়ে না। জগতের সব আলো ঘিরে রাখে তোমাকে।

ফুচকার দোকানে মেয়েদের ভিড় অতি সহজাত। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। ফুচকার সঙ্গে নারীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। ফুচকা ও আইসক্রিম—এই দুই জিনিস খাওয়ার সময় মেয়েদের চেহারায় আহ্লাদি ভাব ঝলমল করে সৌন্দর্য মনে হয় বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

খেয়াল করলাম নীরু কটমট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হঠাৎ ফুচকার প্লেট সরিয়ে রেখে খপ করে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। কী এমন কারণ, বুঝতে পারলাম না।

আমি জানতে চাইলে চেহারায় চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, তুমি কি এসব ইচ্ছা করে করছ?
আমি আবার কী করলাম?

আমাকে চটিয়ে মজা পাও? ওই দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী দেখছ?
অহ আচ্ছা! সামনের টেবিলের মেয়েটিকে দেখছিলাম।
কী!

হুম। তোমার পেছনে কোনার দিকে বসা মেয়েটা।
নীরু ধাতস্থ হয়ে আহত গলায় বলল,
সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ। যত কঠিনই হোক, তোমার সত্য বলার স্বভাবটা আমার ভীষণ পছন্দের। তো মেয়েটি কি খুব বেশি সুন্দর?
হুম, বলতে পার।

সুন্দর মেয়ে দেখলে এভাবে তাকিয়ে থাকা কবে থেকে শিখলে?
আমি তো মেয়েটির সৌন্দর্য দেখিনি। অদ্ভুত কিছু দেখছিলাম।
নীরু চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর শীতল গলায় বলল, সুন্দর আর অদ্ভুত পেয়ে গেছ। প্রাণভরে দেখ সমস্যা নেই। আমি তো সাদামাটা। কিন্তু আমার পাশে বসে অন্য মেয়ের দিকে নজর দিয়ে আমাকে অপমান করলে, এটা কি বুঝতে পারছ? তোমার জন্য সেটাও নাহয় মেনে নেব, কিন্তু ভদ্রতা বলে তো একটা কথা আছে। লোকে কী বলবে?

নিজেকে সাদামাটা বলে চট করে তুলনায় চলে যাওয়া নীরুকে বললাম,
প্রণয়িনীর সঙ্গে জগতের কারও তুলনা হয় না। তারা সব তুলনার ঊর্ধ্বে। তোমার সঙ্গে কারও তুলনার প্রশ্নই ওঠে না। আমি ভেবেছি ব্যাপারটা তুমি ধরতে পারবে। কারণ তোমার সেন্স অব হিউমার প্রকট। এখন মনে হচ্ছে, সেটা কোয়ারেন্টিনে আছে। ফিরে এলে নিশ্চয় ধরতে পারবে, তোমাকে অপমান করছি কি না।

আজ কিন্তু কোনো উল্টাপাল্টা না করার কথা ছিল। তুমি সেটা শুরু করেছ। এবার বল, মেয়েটিকে তুমি কবে থেকে চেন?

এই ধর এক বা দেড় মিনিট থেকে।

কী এমন দেখলে এই এক দেড় মিনিটে? আমাকেই ইগনোর করে দিতে হলো?
দ্বিতীয় কথার উত্তরে বলব, তোমার আত্মবিশ্বাস দেখে আমি হতাশ। আর প্রথম কথাটার উত্তর হলো, মেয়েটা কিছুটা অগোছালো অথবা অসতর্ক। যদিও সেটা সে জানে না বলে পাবলিক প্লেসে আত্মবিশ্বাসী চেহারা নিয়ে বসে আছে। এ কারণে নজর সেদিকে যাচ্ছে।
তুমি কি আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছ?

মোটেই না।

আমি সেজেগুজে শাড়ি পরে বসে আছি, আর তুমি তাকিয়ে আছ অন্য মেয়ের দিকে। এটা আসলে কী?

কারণ তোমার কপালের টিপ সঠিক জায়গায় আছে।

মানে কী?

মানে খুব সাধারণ। মেয়েটির কপালের লাল টিপ নেমে ভ্রুর ওপর লেপটে আছে। মেয়েটি এখনো জানে না বলে আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছে। এটা হতেই পারে, কিন্তু বারবার নজর যাচ্ছিল সেদিকে।

নীরু দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকল। আমিও গেলাম পিছে পিছে। মেয়েটি যদি এরই মধ্যে টিপ যথাস্থানে বসিয়ে দেয়, তবে নীরুর কাছে আমি ছোট হয়ে যাব।

না, আমাকে আর বিপদে পড়তে হলো না। টিপটি এখনো ভ্রুর ওপরেই আছে। পাশাপাশি বসার কারণে মেয়েটির সঙ্গে থাকা সম্ভাব্য বোন বা বান্ধবীর নজরেও আসেনি।

নীরু মেয়েটির সামনে দাঁড়াল। মুঠোফোনের ক্যামেরাটা অন করে মেয়েটির সামনে ধরে বলল, ঠিক করে নিন। এলোমেলো টিপ পরে আপনি ঝামেলা বাঁধিয়েছেন। মেয়েটি টিপ ঠিক করার আগে কেমন খোলসে ঢোকা চেহারা নিয়ে একবার ডানে-বাঁয়ে তাকাল।
নীরু ফুলগুলো তুলে নিয়ে বের হতে উদ্যত হলো।

আধখাওয়া ফুচকার প্লেট টেবিলে পড়ে আছে। খাওয়ার ইচ্ছাটা মরে গেছে হয়তো আমার কারণেই। না হলে এত প্রিয় খাবার কেউ রেখে যায়!

বাসায় আমার ছোট বোনকে ফুচকার প্লেটে সাঁতার কাটা মরা মাছি ফেলে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখেছি। সেটা জায়েজ করতে সে একটা হাদিসও মুখস্থ করেছে।

হাদিসটি হলো— ‘মাছির এক পাখনায় জীবাণু, অন্য পাখনায় প্রতিরোধক্ষমতা থাকে। তরল খাবারে মাছি পড়লে দুই পাখনাই ডুবিয়ে দিতে হয়। তাতেই জীবাণুমুক্ত হয়ে ওঠে।’
তাকে অবশ্য অন্য কোনো খাবারে এটা প্রয়োগ করতে দেখিনি। কেবল ফুচকা ছাড়া।
নীরুকে এখন সরাসরি খেতে বললে সে কোনোভাবেই রাজি হবে না। একটু অন্যভাবে বলে দেখতে পারি।

চলে যাওয়ার সময় বললাম, ফুচকা আর খেতে ইচ্ছা করছে না তোমার, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কি ইচ্ছা করছে জান? তুমি ঝাল ঝাল ফুচকা খাবে আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকব। ইচ্ছাটা কি পূরণ হওয়ার মতো?

নীরু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, তারপর আবার এসে বসল। নতুন ফুচকার অর্ডার করল। আমার দৃষ্টি নিবন্ধ হলো তার ওপর। সে আস্তে করে টিপটা এলোমেলো করে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি না দেখার ভান করেও ফেঁসে গেলাম। সেও মুখ টিপে হাসছে। সে চাইছে আমি টিপটা ঠিক করে দিই। কিন্তু আমি না বোঝার ভান করলাম।

আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কোনো তাড়া নেই, গন্তব্য নেই। কোনো দিকে নজর নেই। নীরু বলল, তোমার অপ্রত্যাশিত কাণ্ডগুলো প্রশ্রয় দিতে দিতে এখন পেইন হয়ে ফিরে আসছে। তোমার মধ্যে কোনো বোধোদয় নেই। অথচ আমি ছোটখাটো সুন্দর বিষয়গুলো নিয়ে খুশি থাকতে চেয়েছি।

আমি বললাম, এখন কি বিষয়গুলো হারিয়ে গেছে?

উঁহু। ঠিক তা না। হারিয়ে গেলে এত দূর আসা হতো না। যেমন ধর, একটু আগে আমাকে ফুচকা খাওয়াতে তোমার বুদ্ধিদীপ্ত চেষ্টাটা তার আগের ঘটনার ক্লান্তি কাটিয়ে দিয়েছে।

আমি জবাব দিলাম না।

সে বলল, আমি কেন তোমার উল্টাপাল্টা কর্মকাণ্ডগুলো সহ্য করি, জান?
আমি ফিরে তাকালাম।

কারণ, যত কঠিনই হোক, তুমি আমার সঙ্গে কখনো মিথ্যা বল না। অবলীলায় সত্য বলে যাও। হয়তোবা মিথ্যা বলতেও শেখনি। এ জগতে সত্য আঁকড়ে থাকা মানুষের সংখ্যা খুব কম। তোমার এ অভ্যাসটা আমার ভীষণ পছন্দের।
আমি বললাম, তোমার ধারণা ভুল। আমিও প্রচুর মিথ্যা বলি।
কোনটা বলেছ শুনি? না তাকিয়েই বলল নীরু।

এই তো একটু আগে। পাঞ্জাবি পরে ঘুমিয়েছি বলেছিলাম না? আসলে মিথ্যা বলেছি। পাঞ্জাবিটা আমি আগেও পরেছিলাম বলে কুঁচকানো ছিল।

নীরু একটুও চমকাল না। খুব শান্ত, স্থির অথচ দৃঢ় গলায় বলল, আসল সত্যটা আগেই বলেছ। এখন মিথ্যা বলে আমাকে ভুল প্রমাণ করতে চাইছ। পাঞ্জাবির বোতামের ঘরে লন্ড্রির সুতা এখনো লেগে আছে। আগে পরলে নিশ্চয় চোখে পড়ত।

আমি চুপ করে থেকে আলতো কামড় বসিয়ে সুতাটা ছিঁড়ে নিলাম।

সন্ধ্যা নেমেছে। সড়কবাতি জ্বলে উঠেছে রাস্তায়। আমরা হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাচ্ছি। নীরু বলল, তুমি চাইলে আমার হাতটা ধরতে পার। আমি হাতটা ধরার আগে তার সামনে দাঁড়ালাম। আলতো ছোঁয়ায় টিপটি কপালের যথাস্থানে বসিয়ে দিলাম। নীরুর চেহারায় হাসির রেখা। খানিক চুপ করে থেকে বলল, রেস্টুরেন্টে ঠিক করে দাওনি কেন?

আমি হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, তুমি মনে মনে চেয়েছিলে বলে।

জগতে এমন কোনো প্রেমিক আছে নাকি, প্রেমিকার এই অল্প চাওয়া ইচ্ছা করে এড়িয়ে যায়?

হয়তো আমি একজনই আছি। কারণ, আমি সত্যিকারের প্রেমিক হতে পারিনি।
যারা মন পড়তে না পেরে কী করবে বুঝতে পারে না, তারা ইনোসেন্ট। কিন্তু তুমি পড়েই উল্টাপাল্টা কর। বুঝেও অবুঝের ভান কর।

কপালের একটা টিপ তোমার মতো মেয়ের কোনো পার্থক্য গড়ে দিতে পারে না। আমার এ বিশ্বাস ধরে রাখতেই তখন ঠিক করে দিইনি। তুমি জাগতিক সৌন্দর্যের ঊর্ধ্বে।
পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আইসক্রিম খেলাম। তারপর আবার হাঁটছি গন্তব্যহীন পথে। রাস্তার কোনো সাইনবোর্ড পড়ছি না। এদিক-ওদিক তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছি না। শুধু নিজেদের মধ্যে বিচরণ করছি।

নীরু বলল, এভাবে সারা রাত হাঁটতে পারলে দারুণ হতো। কোথাও বসে গল্প করতে করতে ভোর দেখতে ইচ্ছা করছে।

আমি বললাম, এক রাতের জন্য আমার মতো নিশাচর হয়ে যাও। রাত জেগে সকালে ঘুমালে দারুণ সব স্বপ্ন দেখা যায়।

তুমি দেখ বুঝি?

হুম। আজও দেখলাম দারুণ একটা স্বপ্ন। শুনতে চাও?

বল।

দেখছি রাতে ঘুরতে ঘুরতে আমি বিরাট এক বড় লোকের বিয়ের আসরে ঢুকে পড়েছি। লাইটের আলোতে ঝলমল করছে। আমি ছাড়া সবার গায়ে দামি পোশাক। একজন আমাকে বেশ খাতির করে বসিয়ে দিল খাবার টেবিলে। নানান পদের খাবার। আমি প্লেটভর্তি কাচ্চি নিলাম। এত মজার কাচ্চি আমি জীবনেও খাইনি। খাবার শেষে বোরহানি খেয়ে স্টেজের দিকে গেলাম। গান চলছে হাই ভলিউমে। পারফর্ম করছে বিটিএস। পাশেই বর-কনের স্টেজ। খেয়াল করে দেখলাম এক রাজপুত্র বরের পাশে কনের সাজে...

কনের সাজে বসে আছি আমি।

নীরু আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল।

আমি বললাম, একদম ঠিক। তার মানে তুমিও একই স্বপ্ন দেখেছ।
নীরু বলল, আমি বানানো স্বপ্ন দেখি না। কাচ্চি তোমাকে আমি এখনই খাওয়াব। জন্মদিনের ট্রিট। আগেই ঠিক করে রেখেছি।

আমি চুপ করে আছি। নীরু বলল, তুমি মিথ্যা বল না এ কথা তোমাকে বলা আমার ভুল হয়েছে। এখন তুমি গল্প ফাঁদছ।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে নিলাম। মেনু পছন্দ করতে সময় লাগল না। কাচ্চি অর্ডার করা হলো।

খেতে খেতে নীরু বলল, তোমার স্বপ্নের গল্পে কি শুধুই কাচ্চি ছিল নাকি অন্য কোনো মেসেজও দিতে চেয়েছ?

আমি কোনো জবাব দিলাম না। আসলে কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না। জবাব খুঁজে না পাওয়ার চেয়ে বড় অস্বস্তি আর কিছুতে নেই। স্বপ্নের বিষয়টা স্পর্শকাতর। বেশি নাড়াচাড়া করা ঠিক হবে না। নীরু ধরতে না পারলে সমস্যা ছিল না। এ মেয়ে কীভাবে যেন সব মুখস্থ বলে দেয়।

নীরু আমাকে উদ্ধার করল পরবর্তী প্রশ্নে গিয়ে। বলল, কাচ্চি কেমন লাগছে?
হুম, দারুণ মজা।

খাওয়া শেষ হলে ওয়েটার বিল দিয়ে গেল। আমি পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রেখে বললাম, বাকিটা তুমি দাও। বলা হয়নি মানিব্যাগের ভেতর রিকশাওয়ালাকর্তৃক বারবার পরিত্যক্ত হওয়া মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে একটা দশ টাকার নোট।

নীরু ধরেও দেখল না। বিল পরিশোধের পর আমার পার্সটা হাতে নিল। খুলবে কি খুলবে না করে তার ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল। বলল, এটা আমি নিয়ে যাই।
রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে আমরা ফুটপাত ধরে আবার হাঁটছি। হাঁটছি বলতে আয়েশি ভঙ্গিতে পা ফেলছি।

নীরু বলল, আমাকে নিয়ে তুমি কত কবিতা লিখতে। এখন একটাও লেখ না। কারণটা কী? অথচ ফেসবুকভর্তি তোমার কত কবিতা।
আমি চুপ করে আছি।

আজ জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে নিয়ে একটা কবিতা আশা করেছিলাম। না পেয়ে আমি হতাশ।
আমি আবারও চুপ থাকলাম।

কিছু বলার নেই তোমার? নীরু ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইল।

আমি খানিক সময় নিয়ে বললাম, প্রেমের প্রথম সকালে আবেগের ফল্গুধারা বয়ে যায়। দুপুরে এসে কিছুটা স্থিরতা আসে। প্রেম হলো প্রার্থনার মতো। পাওয়ার আকুতি গভীর। পেয়ে যাওয়া মানে সিদ্ধি। আকুতি থেকে কবিতা হয়। সিদ্ধি থেকে আসে স্বস্তি। তুমি পাশে আছ, তাই কবিতা নেই।

নীরু অপলক তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের কোনায় জমে গেল কুয়াশা। ধরা গলায় বলল, আমার প্রতি তোমার আর যা-ই থাকুক, প্রেম নেই। অনুভূতি ছাড়া প্রেম থাকতে পারে না।

তার কাঁধের ব্যাগ হাতড়িয়ে আমার মানিব্যাগটা বের করে গুঁজে দিল হাতে। তারপর একটা রিকশা ডেকে উঠে গেল চোখের পলকে। আমি তাকিয়ে রইলাম তার চলে যাওয়ার দিকে। রিকশা মিশে গেল ভিড়ে।

আমার ভেতরটা নড়ে উঠল। বিকেল থেকে যে স্বপ্নঘোরজগতে ছিলাম, সেখান থেকে হুট করে ফিরে এলাম এই প্রাত্যহিক জীবনে। জায়গাটা এখন খেয়াল করে দেখলাম। রিকশা, ফুটপাতে হকার, দোকানপাট, নাগরিক ব্যস্ততার মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
নীরুর কটমট দৃষ্টি দেখে আমার কিছুই হয়নি, তার রাগ, মান, অভিমানে এমনকি তাকে হারানোর ভয়েও আমি বিচলিত হইনি, কেবল আমার ভেতরটা ছিঁড়ে যায় তার চোখের জল দেখলে। অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই মেয়ের চোখের কোনায় জমে থাকা একটি মাত্র বিন্দু।

আমি নীরুকে নিয়ে অনেক দিন কোনো কবিতা লিখিনি। কেন লিখিনি, আমি সত্য কথাটাই তাকে বলে দিয়েছি। আমি নীরুকে কখনো মিথ্যা বলি না। নীরু আমার পাশে ছিল বা অধিকারে আছে, এই তৃপ্তিতে হয়তো আমার ভেতর থেকে কবিতা আসেনি। এখন মনে হচ্ছে সে আলোকবর্ষ দূরে। একটা কবিতা লেখা উচিত। আমি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে লিখছি। মুঠোফোনে টাইপ করছি।

আচ্ছা আগের কথাগুলো দিয়ে কি একটা কবিতা হয়?
আমি তার দৃষ্টি ভয় পাই না, তাকে হারানোর ভয়েও বিচলিত নই, চোখের জলে...না, হচ্ছে না।

আকাশের চাঁদও যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে দুঃখবিলাসী আলো। আমি হাঁটছি নীরুর বাসার দিকে।

এই পথ আমার পরিচিত। হাঁটতে হাঁটতে লিখছি আমার অনুভূতির কথা। মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা অনুভূতি। আমি কাছাকাছি চলে এসেছি। দেখা যাচ্ছে দোতলায় নীরুর বারান্দা। একটা টেক্সট করে দাঁড়িয়ে আছি বারান্দা বরাবর।

তুমি চলে গেলে আলিঙ্গন করে নিঃসঙ্গতা
ঝুপ করে নেমে আসে রাত
ক্লান্ত পায়ে চলি ফুটপাত ধরে
মাথার ওপর থালার মতো বিরহী চাঁদ।
কাছে পেলে প্রাণ জুড়ে দূরে গেলে পোড়ে
কাছে দূরের খেলায় দগ্ধ হতে হতে দিবানিশি
অবশেষে বুঝি তোমাকেই ভালোবাসি।

নীরু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাতে মুঠোফোনের আলো জ্বলছে। মনে হয় অণুকবিতাটা পড়ছে। আমি জানতাম সে বারান্দায় আসবে। সে বোধ হয় নিশ্চিত ছিল, আমি নিচে এসে দাঁড়াব।

আমার ইনবক্স কাঁপিয়ে একটা মেসেজ এল। নীরুর মেসেজ। লিখেছে—রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে না। একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যাও। খবরদার হেঁটে যাবে না। তোমার মানিব্যাগে রিকশাভাড়া রেখেছি। কবিতার জন্য ধন্যবাদ।

টাকাটা খরচ করা যাবে নাকি বাঁধাই করে রাখব ভাবছি।

ভাবতে ভাবতে আমি হাঁটছি। নীরু তাকিয়ে আছে আমার চলে যাওয়ার দিকে। এই পথ, এই শহর, এই রাত আমার ভীষণ প্রিয়। চোখ বন্ধ করলেই ঘ্রাণ পাই। পরিচিত ঘ্রাণ। আমি হাঁটছি...
নীরু কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে?