আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়...
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়...
রহমান মৃধা, সুইডেন
এ রকম অদ্ভুত কাণ্ড সুইডেনে আমার ৪০ বছরের জীবনে এই প্রথম ঘটল গতকাল রাতে। সময়টা ছিল রাত ২টা ৩০। হঠাৎ সবকিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। চারদিকে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ঘটনার গুরুত্ব অনুমান করতে গিয়ে ভাবলাম, সাইবার অ্যাটাক হবে না তো?
টেলিফোন টেবিলেই ছিল। এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোন করলাম ১১২, সুইডেনের জরুরি সেবা নম্বর।
ফোনের অপর প্রান্তে অপারেটর ধরতেই বললাম, ‘এ কী মারাত্মক ব্যাপার!’
অপারেটর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘সবকিছু অন্ধকার!’
অপারেটর বললেন, ‘কারণ?’
আমি তখন উত্তরে বলি, ‘কারেন্ট চলে গেছে!’
অপারেটরের কণ্ঠে এবার ধোঁয়াশা, ‘কারেন্ট? কে সেটা?’
‘বিদ্যুৎ!’
‘সেটা আবার কে?’
‘লাইট!’
এতক্ষণে অপারেটরের কণ্ঠে একধরনের স্থিরতা এলো। কিন্তু সেই স্থিরতা আর বেশিক্ষণ থাকল না। গলায় যেন একধরনের রোমান্টিক ভঙ্গি নিয়ে তিনি বললেন, ‘ওহ, বুঝেছি! আপনার “সমকামী” অভিমান করে বাসা থেকে চলে গেছে?’
তৎক্ষণাৎ আমার রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। বললাম, ‘এই মেয়ে! এসব কী বলছো? বিদ্যুৎ চলে গেছে, তাই সব অন্ধকার।’
ওই পাশ থেকে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘সরি। বুঝতে পারিনি। একটু ধরুন। আমি একজন নার্সকে দিচ্ছি।’
কিছুক্ষণ পর নার্স ফোন ধরলেন। পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি সমস্যা?’
আমি নতুন করে পুরো ঘটনা বললাম। তখন তিনি বললেন, ‘দেখুন, এটি জরুরি সেবা। এখানে আমরা কেবল অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ ও বড় ধরনের দুর্ঘটনায় সাহায্য করি। আপনাকে ১১৩১৩-তে কল করতে হবে।’
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘১১৩১৩? এটা আবার কী?’
নার্স বললেন, ‘১১৩১৩ সুইডেনের জাতীয় তথ্যসেবা নাম্বার। সমাজে ঘটে যাওয়া যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি বা দুর্ঘটনা নিয়ে তথ্য জানার জন্য এটি।’
এতক্ষণে সময় হয়ে গেছে রাত তিনটা। ফোন করলাম ১১৩১৩-তে। ফোন ধরলেন এক ভদ্রলোক।
‘কি সাহায্য করতে পারি?’
আমি বললাম, ‘আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। কিছুই চলছে না।’
তিনি বললেন, ‘রাত ২:৩০ থেকে আপনার এলাকায় একটি টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে। টেকনিশিয়ান কাজ করছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এই কথার মধ্যেই পাশের ঘর থেকে আমার স্ত্রী মারিয়া বলতে শুরু করল অন্ধকারে বসে কার সঙ্গে কথা বলছ?
আমি বললাম, ‘১১৩১৩-এর অপারেটরের সঙ্গে।’
মারিয়া বলল, ‘কেন? কী হয়েছে?’
আমি জানালাম, ‘কারেন্ট নেই!’
মারিয়া এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। শীতের রাতে ঘর অন্ধকার আর ঠান্ডা। কিন্তু আমার এই বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত ফোনালাপ তার ঘুম ভেঙে দিয়েছে।
সে বলল, ‘তাহলে তুমি এতক্ষণ জেগেই ছিলে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, লিখতে লিখতে এমনটা হয়েছে।’
মারিয়া তখন বলল, ‘ঠিক আছে, রাতের ১৫টা যখন বেজেই গেছে, তাহলে আমি বরং চা বানিয়ে আনছি।’
মুহূর্তের মধ্যেই সে চা নিয়ে হাজির। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই মনে পড়ে গেল এক বছর আগের পুরোনো একটি ঘটনা।
কোপেনহেগেনে বন্ধুত্বের স্মৃতি
আমার বাল্যবন্ধু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল একবার ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে একটি সেমিনারে এসেছিল। দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমরা দেখা করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এক দিনের জন্য কোপেনহেগেনে যাব। সেই এক দিন সময় যেন আমাদের যৌবনের স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। আমরা দুই বন্ধু একসঙ্গে মিলে যতটুকু সম্ভব সময় কাটানোর কাটালাম।
রমজান মাস ছিল তখন। খাওয়াদাওয়া শেষে রাত ১২টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু হঠাৎ সেহরির সময় অ্যালার্ম বেজে উঠল। নাজমুল রুমের লাইট অন করল, কিন্তু বাতি জ্বলে না।
‘দোস্ত, বাতি জ্বলে না কেন?’
আমি নিজেও অবাক। ভাবছি ঘটনা কি? এমতাবস্থায় সে তখন বলল, ‘নিশ্চয় হোটেলের মালিক সময়মতো বিল দেয়নি। তাই বিদ্যুৎ কেটে দিয়েছে।’
তার কথা শুনে হাসতে শুরু করলাম। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এমনই। রিসেপশনে ফোন করলে জানাল, সামান্য টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে এটা হয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে গেল।
গতকাল রাতের বিদ্যুৎ–বিভ্রাটে সেই স্মৃতিগুলো আবার ফিরে এল। মারিয়ার পাশে বসে চা খেতে খেতে সেই পুরনো স্মৃতিগুলো তার সঙ্গে শেয়ার করলাম, যেন পুরো ঘটনাগুলো চোখের সামনে একেক করে ভেসে উঠল।
শেষরাতে গানের সুর
স্মৃতির জানালা খুলে মারিয়াকে দেখে মনও বেশ ভালো হয়ে গেল। মাঝরাতে শীতের সকালে এক চাদরের মাঝে দুজনে বসে চা পান করতে করতে বাকি রাতটিকে শেষ করে দিলাম। হঠাৎ মনে হচ্ছিল বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের সময় প্রকৃতির নিস্তব্ধতার সঙ্গে ঠান্ডার কষ্ট, অন্ধকারের গভীরতা এবং মানুষের নির্ভরতার টানাপোড়েনকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারার মতো একটি অনুভূতি। ঠিক তেমন একটি মুহূর্তে ঘড়িটি জানিয়ে দিল নারিয়াকে তার অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি সোফা সেটে আনমনে ভাবতে শুরু করলাম, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে গাওয়া এবং প্রণব রায়ের কথাগুলো—
‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয়,
চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায়
বাতায়ন খুলে দিও…’
মাঝরাতের বিদ্যুৎ–বিভ্রাট কেবল একটা ঘটনা নয়, পুরোনো দিনের স্মৃতি, ভালোবাসার অনুভূতি আর জীবনের ছোটখাটো আনন্দের এক মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়ে রয়ে গেল।
*লেখক: রহমান মৃধা, লেখক