একজন নারীর এগিয়ে যাওয়া

আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক সূচক বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনমানসিকতারও উন্নয়ন হয়েছে। নারীদের এগিয়ে যেতে এখন আর এত বেশি বাধার মুখে পড়তে হয় না বা অন্য কারও কথা শুনতে হয় না। অথচ আশির দশকেও আমরা অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করতাম, অনেক ধরনের আজেবাজে কথা নারীদের শুনতে হতো। যেমন, নারীরা এটা করতে পারবেন না, ওটা করতে পারবেন না, এখানে যেতে পারবেন না, ওখানে যেতে পারবেন না। কিন্তু এখন অন্তত নারীদের এসব কথা শুনতে হয় না। তাঁদের প্রতি তাঁর নিজের পরিবারের সদস্যদের ভাবনা এখন অনেক বদলেছে। কারণ, একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন তাঁর নিজ পরিবারের সমর্থন। তা ছাড়া চলার পথে বা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও এখন কিছুটা বদলেছে।

তবে একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টা একটি পুরুষের মতো অতটা সাবলীল নয়। মাতৃত্ব, সন্তান, সংসার, পরিবার—এই বিষয়গুলোর সঙ্গে একজন নারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসবের জন্য একজন নারীকে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়। তাই একজন নারী চাইলেই এসব ভুলে বা ছেড়ে থাকতে পারেন না। থাকলেও তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে, যা কখনোই কেউ শুনতে পায় না। প্রকৃতি একজন নারীকে এভাবেই তৈরি করেছে। একজন নারীর একটি বিশেষ দিক হলো, তিনি চাইলে একা সবকিছু সামলিয়ে যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারেন। অনেক সময় নিরুপায় হয়ে নারীরা কঠিন চ্যালেঞ্জও গ্রহণ করে। একজন নারীর সফলকাম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, তিনি যে কাজটিই করেন, সেটি অনেক ডেডিকেশন দিয়েই করতে পারেন, যদি তিনি মন থেকে চান।

আজ আমাদের দেশে যেসব নারী স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এগিয়েছেন বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাঁদের অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হয়েছে। তাঁদের কারোরই চলার পথ খুব সহজ ছিল না। তবে যেসব নারী তথাকথিত সব বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যান, দিন শেষে তাঁরাই সাফল্য পান। ইতিহাস তো তা-ই বলে।

আমাদের দেশে নারী জাগরণের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন সমাজ তাঁকে কখনোই বরণ ডালায় নন্দিত করেনি। বরং সমাজের তীব্র লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও তিক্ততার মধ্যে তাঁর সংগ্রামী যাত্রাপথ নিদারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নারী পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত এবং তাঁর উত্তরসূরি ফয়জুন্নেছা, জোবেদা খাতুন, সুফিয়া কামাল—তাঁদের জীবনকাহিনি জানলে নারী জাগরণের সঠিক চিত্র পাওয়া যায়। তাঁরা নারীশিক্ষা ও অধিকারের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।

নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ভিত রচনা করেছেন। তাই তো ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে আজীবন লেখা থাকবে।

নারীদের এগিয়ে যেতে হবে প্রথমত তাঁর নিজের জন্য। নিজেকে একজন সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তাঁর মাতৃত্ব, সন্তান, সংসারকে নিজের তাগিদে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এসবের একান্ত দাবিদার মূলত একজন নারী। কারণ, এগুলোর মূল কারিগরই হচ্ছেন নারী। এটা নারীর আবেগের জায়গা। এগুলো একজন নারীকে পরিপূর্ণ করে। পুরুষেরা এসবের অংশীদার হলেও এগুলো লালন করেন একজন নারী।

তাই নারীদের এমন অবস্থানে যেতে হবে, যেন পুরুষেরা চাইলেই তাঁকে অবজ্ঞা করতে না পারেন। কোনো ধরনের হুমকি, ভয় দেখাতে না পারেন। আমাদের দেশে অনেক নারী এখনো মুখ বুজে অনেক কিছু মেনে নেন। অত্যাচার সহ্য করেন। তাঁদের অন্তরাত্মার কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না। এখান থেকে নারীদের বেরিয়ে আসতেই হবে। তবে নারী স্বাধীনতার নামে বা নারী অধিকারের নামে এমন কিছু করা যাবে না, যেগুলো নারীদের আত্মসম্মানকে পদদলিত করে।

আমাদের দেশে নারীরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় খুবই ভালো করছে। রাজনীতিতে নারীরা বেশ এগিয়েছেন। তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়লেও নারী নেতৃত্ব এখনো অপ্রতুল। কর্মক্ষেত্রে সফল নারীর সংখ্যা আশাব্যঞ্জক নয়। তবে নারী উদ্যোক্তা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে অনেক নারী অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফর্মে খুবই ভালো করছেন। নারীরা এখন বুঝে গেছেন, নিজের পায়ের মাটি শক্ত করা কতটা জরুরি। গ্রামেগঞ্জে নারীরা স্বাবলম্বী হওয়া শুরু করেছেন।

নারীরা এখন চার দেয়ালে বন্দী কোনো শোপিস নন বা কবি-লেখকের রসাল কবিতা বা উপন্যাসের মূল উপজীব্য নন। নারীদের প্রকাশ্যে হেয় করতে এখন অন্তত চিন্তা করতে হয়। তবে সুযোগ পেলে নারীদের ওপর তথাকথিত পুরুষেরা বলপ্রয়োগ করতে চান, তাই নারীদের উচিত কখনোই পুরুষকে সেই সুযোগ না দেওয়া। নিজেকে অসহায় না ভাবা। সর্বদা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলা।

*লেখক: আসমাউল হুসনা, পিএইচডি ফেলো, স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়েশিয়া, মালয়েশিয়া ও সহযোগী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, পবিপ্রবি, বাংলাদেশ