লাল দোপাট্টা–শেষ পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আম্মিজান, আমারে ডাকছেন?’
‘জি নবাবজাদী, এত্ত বড় ধামড়ি মাইয়া হইছস, কই আমরে নাস্তা রেডি করতে হাত লাগাইবো, তা না উনি বিয়ান বেলা ফুড়ুৎ, কই গেছিলি?’
‘কই আবার গেলাম, গলির মোড়ে ছেফালীর লগে এট্টু কতা কইবার লাগছিলাম, আম্মিজান কী করন লাগবো কন দেহি, রুটি লাগামু তাওয়ায়? চান্ডি ফুটছে নি।’
‘হ, দে। আর শোন, চায়ের পাতিলও চড়ায় দে, আমি এট্টু পান মুখে দিয়া আইতাছি।’
দুই দিন পর শুক্রবার সকাল।
‘কি রে ছিমুইল্লা ছুক্কুরবার সকাল সকাল যে?’
শিমুল এসেছে এলাকার বড় ভাই সিরাজের কাছে তার মোটরসাইকেলটা ধার নিতে। সিরাজ ভাই বাইকটা দিলে পারুলরে নিয়া বাইকে কইরা ছিনেমা দেখতে যাবে, পারুল তখন তার অনেক কাছে বসবে। ভাবতেই শরীরে কেমুন ঝাঁকি লাগছে।
‘বড়ভাই বিকেলে এট্টু বাইকডা দেওন লাগবো, সন্ধ্যার মধ্যেই দিয়া যামু’
‘ কিল্লাই?’
‘ছিনেমা দেখতে যামু।’
‘তা যাবি, মোটরসাইকেল লাগবো কিল্লাই?’
শিমুল কিছু বলল না, একটু হাসল শুধু।
‘ওহ, বুচ্ছি! আইচ্ছা, বাদ জুম্মা আয়া লইয়া যাছ। আর শোন, ছাতটার ভিতরে দিয়া যাইস কইলাম, আটটায় নয়া ঢাকা যামু।’
‘জি ভাইজান, আমি জুম্মা পইড়া আইসা নিয়া যামু।’
শিমুলের খুশিতে নাচতে মন চাইছে।

দুপুর পর আয়নার সামনে পারুল চুলে বেণী করছিল, ছোট বোন বকুল জিজ্ঞাসা করল, ‘কিধার যাও এইবেলা, হুনি?’
অনামিকার ডগা দিয়ে চোখে কাজল দিতে দিতে পারুল বলল, ‘ছেফালীর লগে ছিনেমা দেখতে, আম্মিরে কইবি না কইলাম।’
‘হ, আমি জানি ছেফালী কেডা।’
পারুল অন্য চোখে কাজল দেওয়া বাদ দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল বকুলের দিকে, ‘ওই ছেমরি তুই কি জানস? খালি বেশি কতা কয়।’
‘এই যে ছেফালী আছলে ছিমুল ভাই।’
‘চুপ, একদম চুপ ছেমরি, যা কইছস ভুইলা যা, আর একবার ও কইবি না। আম্মিজানের কানে গেলে মাইরা ফেলবো আমারে।’
‘হুনবো না কেউ, তুমি যাও।’
‘রোজ যখন ফিল্ডিং মারবার যাও, তখন আম্মিজানরে কে আগলায় থোয়, একবার ও মাথাত আসে না? এমনই ডুবা ডুবছো।’
পারুল লাল দোপাট্টা গায়ে চড়াতে চড়াতে ফিক করে হেসে দিল, ‘আইচ্ছা যাই, তোর লাগি কি আনমু ক?’
‘কিচ্ছু লাগতো না, ঘুষ খাই না, যা করছি মায়া কইরা করছি, তোমাগো দুই জনের শাদি মোবারক হইলে জব্বর মানাইবো, দুজনেই বিউটিফুল।’
পারুল হাসল, গজদাঁতের হাসি।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মোড়ের মাথায় শিমুল জিনসের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে দাঁড়ানো, পারুলকে আসতে দেখে ধাক্কা খেল, ‘কী সোন্দর দেখতে মাইয়াডা, এক্কেরে লাল পরীর লাহান লাগতাছে।’
পারুল বললো, ‘কই! গাইলি না তো, তেরা লাল দোপাট্টা।’
‘তোরে দেইখা জবান বন্ধ হইয়া গেছেগা, মাছাল্লাহ কী সোন্দর রে তুই!’
‘হইছে, চল যাই। তাড়াতাড়ি ফিরা লাগব বাড়িত।’
‘ল যাই, সিরাজ ভাইয়ের বাইক আনছি, জোরছে চালাইলে ডরাইস না, আমারে শক্ত কইরা ধরিস।’
‘জোরছে চালাবি কিল্লাই? আস্তে যাবি।’
ওরা মোটরসাইকেল এ করে রওনা হলো, পৌঁছানোর পর শিমুল পপকর্ন আর পেপসি কিনে নিয়ে ঢুকল সিনেমা হলে, সিনেমা প্রায় শুরু। শিমুল পারুলের কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, ‘তোরে আইজ বেশি বিউটিফুল লাগতেছে।’
পারুল গজদাঁতের হাসি দিয়ে বললো, ‘আমি কেমুন দেখতে, সেইডা আমি জানি। এখন ছিনেমা দেখপার দে, পিরিত পরে দেখাইস।’
শিমুল কপাল কুঁচকেয় বলল, ‘তুই কি আমারে বিয়ার পরেও তুই কইরা কবি?’
‘নাহ, আপনি করে বুলাবো, স্বামী সম্মানের জিনিস, আম্মিজান বলছে। খুশি হইছোস?’—বলেই হাসি।
‘ছেমড়ি তুই ভালো হইলি না, ছিনেমা দেখ।’
কিছু সময় পর...
‘কিরে কানতাছোস কেন?’
‘নায়িকার কষ্ট দেইখা, তুই বুঝবি না। আইচ্ছা দুনিয়া ভরা মাইনছের খালি কষ্ট, ছিনেমায় এট্টু শান্তি দেখান যায় না?’
‘কষ্ট লাগলে দেহন লাগতো না, চল যাই, তোর কান্দাকাটি দেখবার পারুম না।’
পারুল মুখ গোমড়া করে উঠে দাঁড়াল। অন্ধকার চারপাশে। শিমুল পারুলের হাত ধরে বের হয়ে এল, তখনো সন্ধ্যা হয়নি।
‘আইসক্রিম খাবি?’
‘না, বাড়িত চল, বকুলে ফোন দিসিলো, মেসেজ দিয়া রাখছে। তাড়াতাড়ি যাইবার কইছে, আম্মিজান আমার খোঁজ করতাছে।’
‘ভাবছিলাম আর একটু থাকমু, দুইডা বাতচিৎ করমু, আইচ্ছা চল তাইলে।’
‘না, আরেক দিন বাড়িত চল।’
‘আইচ্ছা চিন্তা করিস না, শক্ত কইরা ধরিস কইলাম, তাড়াতাড়ি যামু।’
শিমুল বাইক স্টার্ট দিল। হাওয়ার গতিতে চলছে।

পারুল পেছন থেকে শক্ত করে শিমুল কে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, ‘রাস্তাডা যদি না ফুরাইত।’
শিমুলের হঠাৎ কি হলো সে জানে না, পুরো শরীর শিহরণ বয়ে গেলো, সামনে কিছু দেখছে না, মনে হলো আকাশে ভাসছে, প্রচণ্ড জোরে শব্দ হলো। দুজনেই ছিটকে পড়ল রাস্তার এক পাশে, কিছু বুঝবার আগেই ওপর দিয়ে একটা লোকাল বাস গেলো।
আশপাশে মানুষ জমে গেছে। লাল কামিজ, লাল দোপাট্টা, সাদা শার্ট, পিচঢালা পথ লাল রক্তে মাখামাখি।
শিমুল রক্তাক্ত চোখ বন্ধ করার আগে পারুল বলে ফিসফিস করে একবার ডাকলো। পারুলের নিথর ঠোঁট আর গজদাঁত যেন হেসে উত্তর দিল, ‘কইছিলাম না, হাম সাথ সাথ মারেঙ্গে!’