লালবাগের লালমিয়া: শেষ পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

স্কারবোরো মলের কফি হাউস টিমহর্টনে কিছু সময় কাটানোর জন্য আমরা বসলাম কফি নিয়ে। আমি বললাম, কেমন লাগছে কানাডা? সবকিছু মানিয়ে চলতে পারছেন তো? লালমিয়া কখনোই সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সে বলল, একটা বিষয় লক্ষ করছেন। বললাম কী বিষয়?

সে বলল, আমরা যারা বাংলাদেশ থাইক্যা কানাডায় আয়া পড়ছি, আমাগো অ্যাডজাস্ট হইতে সময় লাগে ক্যান? লালমিয়া প্রশ্নের পর প্রশ্ন, প্রশ্নের পাশে প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন—এসব খুব বেশি করে। আমি বললাম, আমি কিছুই জানি না, আপনি বলে যান। সে বলল, আমাগো দ্যাশ আর কানাডা—সবকিছুই বিপরীত। জিমুন মনে করেন, এইহানে আমরা গ্রীষ্মে বেড়াইবার যাই, বাংলাদেশ বেড়ানোর সময় অইতাছে শীতকালে।

দুই দ্যাশ পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থিত, বাংলাদেশে রাইত, ক্যানাডায় দিন। এইহানে গাড়ি চলে রাস্তার ডাইনে আর বাংলাদেশে চলে বাঁয়ে। আমাগো রোজা আর ঈদের সুম হগল জিনিসের দাম বাইড়া যায় গা, আর এইহানে ক্রিসমাসের সুম হগল জিনিসের দাম কইম্যা যায় গা। হের লাইগ্যা আমাগো অ্যাডজাস্ট করন একটু সমস্যা। যুক্তি অকাট্য।

লালমিয়ার মজার কথাবার্তায় সময় কেটে যায়। একসময় সে বলে, বাইজান, একখান উপকার করন লাগব। বললাম, কী উপকার? সে বলল, চিকিৎসকের কাছে তার অসুখের কথা খুলে বলতে পারে না ভাষাগত সমস্যার কারণে। তারপর বলল, এই দ্যাশের ডাক্তর সর্দি-গর্মি হইলে এন্টিবাইটিক দিবার চায় না।

হ্যের লাইগা বাংলাদ্যাশ থন গাট্টি ভৈর‌্যা নানান রকম এন্টিবাইটিক লইয়া আইছি। আমি বললাম, প্রয়োজন ছাড়া কেন আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেবে? সে আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, কী যে কন না, সর্দি-গর্মি হইলে এন্টিবাইটিক ছাড়া কি আর কাম হইবোনি! তাই সর্দি-গর্মি হইলে আর ডাক্তরের কাছে যাই না। আমি বললাম, তাহলে যেকোনো অসুখের জন্য ডাক্তারের কাছে না গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই তো ভালো হয়ে যাবেন। সে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, বাইজান মনে কয় আমার উপ্রে গোস্‌সা ওইছেন? আমি রাগ দমন করে বললাম, না, রাগ হই নাই।

নির্দিষ্ট দিনে লালমিয়ার বাড়ি গেলাম মর্নিংসাইড অঞ্চলে। অনেক বিশাল বাড়ি। পেছনের দেয়াল উচ্চতায় কমপক্ষে ১০ ফুট। আমি বললাম, পেছনে না আপনার অতি ঘনিষ্ঠ পাকিস্তানি পরিবার থাকে? আপনি তো বলেছিলেন আপনাদের বাড়ির কোনো সীমানা থাকবে না! এখন এত উঁচু দেয়াল? লালমিয়া আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। আমি আর চাপাচাপি করলাম না। আমি জানি, সময়ে সে-ই আমাকে বলবে। লক্ষ করলাম, ওই পাকিস্তানি পরিবার আজকের নৈশভোজে নিমন্ত্রিত নয়।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

পুরান ঢাকার আরেকটি ঐতিহ্য হচ্ছে খাবার। বিখ্যাত বিরিয়ানি, তিহারি ও বাকরখানি। টেবিলে একের পর এক খাবার আসতে লাগল। অন্তত ৫০ জনের খাবার। নিমন্ত্রিত অতিথি ২০ জন। শুনলাম অনেকেই শেষ মুহূর্তে নিমন্ত্রণ বাতিল করেছে। এতে লালমিয়ার মন খারাপ। কারণ, কিছু লোককে নিমন্ত্রণ করেছিল বিশেষ কারণে। তারা আসেনি। কারণটা জানা গেল না। পরে নিশ্চয় সে বলবে। এক ভদ্রলোককে দেখলাম বেশ তৎপর। যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’-এর ‘খোসলা’ চরিত্র পড়েছি, আজ যেন চাক্ষুষ দেখলাম।

সে অযথা ব্যস্ত, বিশেষ করে নারীদের ফাইফরমাশ নিয়ে। কার কী লাগবে, কার সাজগোজ সুন্দর হয়েছে, তা নিখুঁতভাবে বর্ণনা ও প্রশংসা। কারও মুখ দিয়ে কিছু বেরোনোর আগেই লুফে নিয়ে আনন্দচিত্তে তা সম্পাদন করছে। এ যেন ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ ধরার জন্য সদাপ্রস্তুত। সে দৃশ্য আমার বেশ ভালোই লাগছিল।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন বাকি পরিবারগুলো এল না, তখন খাবার পরিবেশন করা হলো। যাহোক, টেবিলে এত পদের খাবার দেখে এ গল্পের খোসলার মন অস্থির হয়ে উঠল, সবার আগে সে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনো নিমন্ত্রণে লোক বেশি হলে সাধারণত ডিসপোজিবল প্লেটে খাবার খেতে দেওয়া হয়। এখানেও তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমি ওই ভদ্রলোকের খাবার নেওয়া দেখছিলাম। প্লেট উপচে পড়ছে, তার মুখ দেখে মনে হলো, সে প্লেটের ওপর বিরক্ত, সেখানে আরও জায়গা থাকলে হয়তো আরও কিছু পদ নেওয়া যেত। তার এ অবস্থা দেখে একজন বলেই ফেলল, ভাই, এগুলো শেষ করে আবার নেন, আপনার প্লেট তো খাবারের ভারে ভেঙে যেতে পারে।

তার কথায় সে অবাক হলো, তারপর মুচকি হেসে খাবারের প্লেটের নিচে হাত না রেখে, প্লেটের দুই পাশে ধরে বসার স্থানে যাওয়ার পথে খাবারের ভার সহ্য করতে না পেরে কাগজের থালা ভেঙে সব খাবার মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল। তার দুই হাতে ধরা রইল থালার প্রান্তের দুই টুকরা। এতে সে বেশ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত খাবারের ওপর পা পড়ল, তারপরই চিতপটাং। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। তার এ অবস্থা দেখে ভদ্রতা ভেঙে দু–একজন উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। হাসি খুবই সংক্রামক, ফলে যারা ভদ্রতা বজায় রেখে দাঁত চেপে হাসি থামিয়ে রেখেছিলে, তারা আর চুপ থাকতে পারল না। লালমিয়া খুবই অতিথিবৎসল। হাসিমুখে বলল, কারবারডা দেখছেন! আমার বাইত্তে আমার মেহমান পইড়া গেল!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাইসাব, শরমের কিছু অয় নাইক্যা। যান, বাথরুমে গিয়া ফেরেশ হইয়া আহেন। আমি পরিষ্কার কইরা দিতাছি। অবশেষে আমরা সবাই রাতের খাবার খেলাম, খুব তৃপ্তির সঙ্গে। যে হারে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে, তাতে দুই সপ্তাহে ওজন যে কমপক্ষে সাত থেকে আট কেজি বাড়বে, সন্দেহ নেই। তাতে কী? ‘পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’ তা ছাড়া আমিও বেশ ভোজনবিলাসী, সে কারণে আমার আধা কুমড়ার মতো ছোট্ট ভুঁড়ি গজিয়েছে। সেটাই এ কয় দিনে আকারে একটু বড় হবে। এ দেশে খাবারের পরপরই নিমন্ত্রিত অতিথিরা চলে যান। লালমিয়ার অনুরোধে আমাকে বসতে হলো। আমিও বসতে আগ্রহী, কারণ আমাকে পাকিস্তানির ঘটনা জানতে হবে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লালমিয়া ও তার স্ত্রী সবকিছু গুছিয়ে আমাদের কাছে বসলেন। শুরু হলো পাকিস্তানির কথা দিয়ে। তার বর্ণনায় যা বুঝলাম, পাকিস্তানিরা খুবই স্বার্থপর। লালমিয়া তাদের সব কাজ করে দিত আনন্দের সঙ্গে। মাঝেমধ্যেই বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, মিষ্টান্ন রান্না করে পাঠাত তার স্ত্রী। এমনকি তার ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসত। এতে তারা তাদের কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে যেতে পারত। কোনো এক দিন বিশেষ কাজে তার ছেলেকে আনতে পারবে না—এ কথা সপ্তাহখানেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। এরপর তারা লালমিয়াকে বেশ গালমন্দ করেছে এবং বলেছে তাদের বাসায় যেন আর কখনোই না আসে।

সব বর্ণনার পর লালমিয়া বলল, আপনার কথা মান্যি করলে এই চোট পাইতাম না। হ্যারপরই উঁচা কইরা ব্যাড়া দিছি। তার কথায় মনটা একটু খারাপ হলো। তারপর বলল, লোকজনরে এত পেয়ার করি, কিন্তুক হ্যারা আমারে নিজেগো স্বার্থে কামে লাগায়। আইজ যে পরিবাররে দাওয়াত করছিলাম, হ্যারা আহে নাই ক্যান জানেন? আমি মাথা নাড়লাম, সে বলল, আমার বসার ঘরের কিছু জিনিস নাড়াচাড়া করার লাইগ্যা আমি হ্যাগো সাহায্য চাইছিলাম, হ্যারা ডরাইছে। আহে নাইক্যা। তার মন খারাপ দেখে মনে হলো তাকে যদি কোনো সাহায্য করতে পারতাম, তাহলে বেশ ভালো লাগত। লালমিয়া আমার মনের কথা পড়ে ফেলল, বলল, বুধবারে আমার একখান কাম কইড়্যা দিবেন? আমি খুশি মনে বললাম, অবশ্যই! কী কাজ বলেন। সে বলল, বুধবার পারিবারিক ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সেখানে আমাকে দোভাষীর কাজ করতে হবে। আমি বললাম, এখানে তো বাংলাভাষী। দুই বাংলার বেশ কয়েকজন ভালো ডাক্তার আছে। তাদের কাছে গেলেই তো আর আমাকে দোভাষীর প্রয়োজন নেই। সে বলল, বাঙালি ডাক্তর দেহনের লাইগ্যা কানাডা আইছি নাকি?

তাইলে তো দ্যাশে গেলেই বালা। আমি বললাম, আমি তো জানি আপনি ইংরেজিতে খারাপ না। আপনি বাজারঘাট করছেন, কানাডীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন, তাহলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে সমস্যা কোথায়? লালমিয়া বলল, হুনেন বাইসাব, আমি যে ইংরেজি কই, তা হ্যারা বুজবার পারে না, আর হ্যারা কী কয়, তা কইলাম আমি বুজবার পারি না। ইংরেজি কইলাম ইমুন একখান পেজগি ভাষা, আপনার লগে খালি বিশ্বাসঘাতকতা করব। একক্যারে পের্ত্যেক পদে পদে। আমি অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী?

বিশ্বাসঘাতক! ঠিক বুঝলাম না। সে বলল, আপনারা ওইলেন গিয়া বেশি শিক্ষিত, আপনাগো সমস্যা ওইবার পারে না, তয় আমাগোর মতো অল্প শিক্ষার মানুষের পদে পদে বিপদ। হ্যাগো ইংরেজির কুনো ঠিকঠিকানা আছে? পোলাগো কইতে অইবো ‘হি’ আর মাইয়াগো কইতে ওইবি ‘শি’। এই ‘হি’ আর ‘শি’–এর জ্বালায় আমার হিসি আইয়া পড়ে। তারপর অন্য অনেক প্যারা, জিমুন ধরেন ‘Durham region’। আমি একজনরে কইলাম আমি ডারহাম রিজিওনে থাকি। ওমা, হ্যায় কিছুই বোজে না! আমি যহন লেইখ্যা দিলাম, হে কয়, ও বুজবার পারছি ডুরাম রিজিওন। কনছেন দেহি, পরিষ্কার ইংরেজিতে লেখা ‘ডারহাম’ হ্যাতে কয় ‘ডুরাম’। হয় ‘ডারহাম’ না অইয়া ‘ডুরহাম’ ওইবার পারে, কিন্তুক ‘ডুরাম’ ক্যামতে অয়? খামাখা একখান বাড়তি অক্ষর লাগায়া কালির খরচ বাড়াইলি ক্যান?

হেরা বাড়তি কতা কয় না, তয় বাড়তি অক্ষর লাগাওতে ওস্তাদ।
সাইকোলজির আগে খামাখা একখান ‘পি’ লাগাইসে, হেই ‘পি’ কুনো কামে লাগে না। তাই ইংরেজি কওন বাদ দিবার চিন্তাভাবনা করতাছি। তয় ইংরেজির কিছু বিষয় হ্যারা এক কথায় কাম হারছে, আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল, জিমুন ধরেন হ্যারা কাজিন দিয়ে পুরা গুষ্টি একলগে বাইন্দা হালাইছে। আমাগো খালাতো, মামাতো, ফুফাতো চাচাতো ভাইবোনদের আলাদা কইরা বুজাইতে অয়। আইচ্যা, আমার মনে কাজিনের ল্যাহান বাংলা শব্দ মাথায় ঘুরপাক খাইতাছে।

আমরা কিন্তুক এত জামেলায় না গিয়া এক কথায় কইবার পারি আত্মীয় ভাই, আত্মীয় বুইন। কী কন, বাইসাব। আমি নিরুত্তর। আমি বুঝলাম, এখন তর্ক না করে চুপ থাকাই ভালো। তারপর আমি বললাম, আপনার মেয়েরা তো এখন খুব ভালো দোভাষীর কাজ করতে পারে, ওরা কিন্তু আমার চেয়ে ভালো বলবে। সে বলল, আইজকাল মাইয়ারা স্বাধীন, অনেক কামই করবার চায় না।

তয় হ্যারাই আমাগো লগে যাইয়া ডাক্তরের লগে কতা কয়, মাগার আমার যে কতা কওনের কাম, হেইডা কইবার চায় না। আমি বললাম, কী এমন কথা যে তারা বলতে চায় না? বলল, কইতে অইবো, আমার সারা শরীর জ্বালাপোড়া করে, কইলজার মধ্যে খামচায়, লগে হাত–পা মোচড়ায়। আইচ্যা কন দেহি, এই সহজ বাংলার ইংরেজিও কইবার পারে না, তয় এই দ্যাশে আইয়া মাইয়ারা কী ইংরেজি হিকলো? শেষ

  • দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected] এ।