‘পিপ্পা’ নিয়ে হেব্বি কথা
একটি দেশের কৃষ্টি, কালচার, সংস্কৃতি ওই ভূখণ্ডের অধিকাংশ মানুষের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, বলন, চলনেরই প্রতিনিধিত্ব করে। আচ্ছা ‘পিপ্পা’ ছবির সংগীত পরিচালক, যিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অস্কার পেয়েছেন, তিনি কি তা জানতেন না? এ গানে যে একটি ন্যাশনালিজমের মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে, নিশ্চয় সেটাও তিনি জানতেন। যে গানের মাধ্যমে নজরুল বিভিন্ন জাতিসত্তায় ঐক্য স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেই গানের সুরে বিকৃতি হয় কী করে? ভাগ্যিস মূল গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান শুধু সুরে পরিবর্তন এনেছেন, পুরো গানে হাত দিলে যে কী অবস্থা হতো, তা–ই ভাবছি। যা–ই হোক, তিনি গানের ভাবাদর্শ ও বৈশিষ্ট্যে হাত দেননি—এটাই মূল কথা।
সংস্কৃতির গ্রহণ কিংবা বর্জন নিয়ে আমি এ লেখায় কোনো বিতর্কে যাব না, তবে মনে হয়, পরিচালক নতুন কিছু নির্মাণকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। এতে তিনি চূড়ান্ত ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, এটা ঠিক। আমি এর সপক্ষে কিংবা বিপক্ষে কিছুই বলব না। নিঃসন্দেহে পরিচালক এ আর রাহমান অনেক মেধাবী, গুণী মানুষ কিন্তু তাই বলে হীরার মূল্যে তো আর কাচ কেনা যাবে না কিংবা বাঙালির আদর্শিক জায়গায় কেউ একজন ছড়ি ঘোরাবেন, তা–ও তো মেনে নেওয়া যায় না। যা সুন্দর, রূপান্তরে সেটাই সাহিত্য কিন্তু তাই বলে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’?
কোনো কোনো সুন্দর সংমিশ্রণে মনোজগতে প্রলয় হয়তোবা ঘটাতে পারে কিন্তু এ আর রাহমানের পরিবর্তিত গানের সুরটি আমার মোটেও ভালো লাগেনি, আর ভালো লাগলেও তা যে সর্বজন সমাদৃত হতো, তা–ও কিন্তু নয়। আমি বিশ্বাস করি, শিল্পের জন্য এ এক বড় ধরনের হুমকি। সুর যেকোনো গানের ভাব বহন করে। এ ক্ষেত্রে মূল গানের সুরে যে নতুন সুর চড়ানো হয়েছে, তা জনপ্রিয়তায় খুব বেশি দিন টিকবে বলে মনে হয় না। গান, সুর, তাল, লয় সম্পর্কে আমার তেমন কোনো একাডেমিক জ্ঞান নেই, তবে রাগনির্ভর গানে সুরের পরিবর্তনে সম্ভবত কোনো দোষ নেই। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম,’ ‘শাওন রাতে যদি’, ‘আলগা করগো খোঁপার বাঁধন’ কিংবা অনুপ জালোটার ভজন ‘হৃদি পদ্মে চরণ রাখো’ অথবা মোহাম্মদ রফিজির কণ্ঠে ‘আজও মধুর বাঁশি বাজে’—এ গানগুলোর সুরের বিকৃতি নিশ্চয় একটি চূড়ান্ত অপরাধ। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে কাজী নজরুল ইসলাম, তিনি কেবল একজন সফল গীতিকারই ছিলেন না, তিনি অনেক রাগের স্রষ্টাও ছিলেন, তিনি অনেক বড় মাপের একজন সুরকারও ছিলেন বটে। যা–ই হোক, নজরুল আমাদের রক্তে অমল একজন পূর্বসূরি। এ আর রাহমান ‘রোজ’ ছবিতে তিনি সুরের জাদু দেখিয়েছেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘পিপ্পা’ ছবিতে তিনি কেন যে এমন একটি জনপ্রিয় গানের সুরকে বিকৃত করলেন, তা আমি নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একটা মীমাংসায় উপনীত হতে পারিনি। ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি নজরুলের ‘ভাঙার গান’, পরিচালক এ আর রাহমান কি তা জানতেন না? ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে যে গান সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে আজও সগৌরব দাঁড়িয়ে আছে, তার বিকৃতি হয় কী করে? যদিও পরিচালক এখন অন্য কথা বলছেন, তিনি নাকি নজরুলের পরিবারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ীই তা করেছেন, তাহলে তো এটি আরও ভয়াবহ বিপজ্জনক কথা, নজরুলের পরিবার কি নজরুলের গানের, তাঁর সৃষ্টির প্রতিনিধিত্ব করে? তাঁর সুর, সৃষ্টকে পরিবর্তন, পরিবর্ধনের এখতিয়ার রাখে?
নজরুলের গান আমাদের সবার, তাঁর সৃষ্টি আমাদের সবার। যা–ই হোক, সর্বোপরি পরিচালক এ আর রাহমান তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং সে জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশসহ ক্ষমাও চেয়েছেন। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও উদারতার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই ভুল করে তা স্বীকারও তো করতে চাই না।