স্বপ্নপূরণের পথে প্রবাসজীবন: সতর্কতা ও দায়বদ্ধতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছোটবেলায় দেখতাম টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন দিত—‘সিগারেট থেকে শুরু, শেষকালে হেরোইন, মাঝখানে মাদকের দাসত্ব প্রতিদিন।’ বাক্যটি আমার জীবনে একটি গভীর ছাপ ফেলেছিল। আজ যখন আমি মো. মঞ্জুরুল আহসান, ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমা-তে একজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত, তখন প্রবাসে আসা তরুণ প্রজন্মের জীবনযাত্রা দেখে সেই কথাগুলো নতুন করে মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে যাঁরা আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতে পা রাখবেন, তাঁদের জন্য আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।

জীবনে প্রথম যখন সিগারেটে টান দিই, তখন তীব্র অপরাধবোধ গ্রাস করেছিল। মনে হয়েছিল আমি কতটা খারাপ একটি ছেলে। কারণ, আমাদের সমাজে ধূমপানকারীদের নেতিবাচক চোখে দেখা হয়। ওই দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কখনো সিগারেট স্পর্শ করব না। কিন্তু এর কিছুদিন পর আবার এক তীব্র আগ্রহে টান দিলাম, ভাবলাম এটাই শেষ। এরপর ২-৩ মাস পর যখন নিজের টাকায় সিগারেট কিনে খাওয়া শুরু করলাম, তখন সেই অপরাধবোধ আর কাজ করছিল না। বরং একদিন মা আমার হাত শুঁকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, তুই কি সিগারেট খাস?’ তখন ভীষণ রাগ হয়েছিল। ভেবেছিলাম, অন্য মা–বাবার মতো আমার মা–বাবা কেন এতটা উদার নন? কেন সবকিছুতে এত বাধা-নিষেধ?

বছরখানেক আগে কানাডায় একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী একটি পার্টিতে গিয়ে সম্ভবত ‘মলি’ নামক এক ড্রাগ নেয়। এরপর এর প্রভাবে সে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে।

মা–বাবা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চান না। যে বিষয়গুলো পরিবার থেকে লুকিয়ে করতে হয়, তা ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য আমার কাছে অনেক যুক্তি থাকলেও বাস্তবে সেগুলো আসলেই ক্ষতিকর। এ কারণেই জীবনে যা-ই ঘটে যাক না কেন, মা-বাবা ও পরিবারকে পাশে রাখা অপরিহার্য। তাঁদের কথাগুলো ভালো না লাগলেও শোনা উচিত। কারণ, দিন শেষে তাঁরাই তোমার খেয়াল রাখবেন, অন্য কেউ নয়। এই যে বন্ধু-বান্ধব এসব সাময়িক। সময় চলে গেলে যখন দেখবে তোমার আশেপাশে সবাই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, তখন তোমার অপশন থাকবে দুটো—হয় বিচ্যুত হয়ে আরেকটা ভুল পথে চালিত হওয়া বা দল খুঁজে সেই পথে জীবন চালিয়ে যাওয়া; আর না হয় যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

ছবি: সংগৃহীত

অনেক তরুণ-তরুণীকে দেখি পড়াশোনার মেধা কাজে লাগিয়ে ‘অড জব’ করে টাকা উপার্জন করছে। এরপর সেই টাকা দিয়ে রাতভর পার্টি করে বেড়াচ্ছে। মদ, গাঁজা, নারী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কাছে নিজেদের এমন জীবনযাপনের পক্ষে অনেক যুক্তি থাকে।

এখন যদি সেই ছেলেদের জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি যেই মেয়েদের নিয়ে রাতভর পার্টি করলে, তুমি কি এমন কোনো মেয়েকে নিজের স্ত্রী বানাবে?’ কিংবা ওই মেয়েদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ‘তুমি কি এমন কোনো ছেলেকে নিজের স্বামী বানাবে যার কোনো লক্ষ্য নেই, রাত–বিরাতে তথাকথিত বন্ধুদের নাম করে মেয়ে নিয়ে পার্টি করে বেড়াচ্ছে—এমন কাউকে কি নিজের স্বামী, নিজের সন্তানের বাবার জন্য বেছে নেবে?’ আমার ধারণা, এই গুণগুলো তারা বা তাদের পরিবার কেউ মানবে না।

অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে নিজস্ব অর্থায়নে আসে। যেই টাকাটা হয়তো তার মা-বাবা বা মায়ের কোনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে নেওয়া, কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ করা। তাই উন্নত দেশে এসে মা-বাবাকে দুটো পয়সা দিয়েই এটা ভাবা অপরাধ যে তোমার দায়িত্ব শেষ। তোমাদের দিকে গোটা পরিবার, সমাজ এবং দেশ তাকিয়ে থাকে। তোমরা ভালো করলে দেশেরও ভালো হয়। তোমাদের পরাজয় মানে একটি সমাজ ও দেশেরও পরাজয়।

যেই কাজগুলো সাময়িক আনন্দ দেয়, তা দীর্ঘমেয়াদে অনেক বেশি হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। গত বছর থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে টানা পিৎজা খাওয়া শুরু করেছিলাম। এক বছর পর তার ফল ভোগ করতে হলো...কী সেই ফল? আমার ওজন ৩০ পাউন্ড বেড়ে গেল! এখন এই বিলটা আমাকেই শোধ করতে হবে। আর পিৎজা খাওয়া যাবে না। আম্মা ভিডিও কল দিলেই বলেন, ‘কিরে, তুই এত মোটা কেন হচ্ছিস?’ প্রথম দিকে বিরক্ত লাগলেও এখন সেটাই মাথায় ঢুকে গেছে। হাজার মাইল দূরে থেকেও মায়ের চোখ মিস করেনি যে কী ভুলটা করেছি পিৎজা খেয়ে খেয়ে।

প্রবাসজীবন যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়, তেমনি অনেক নতুন চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় পারিবারিক বন্ধন, নৈতিক মূল্যবোধ ও দূরদৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখবেন, আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু আপনার জীবনকেই নয়, আপনার পরিবার ও দেশের ভবিষ্যৎকেও প্রভাবিত করে। তাই প্রবাসে পা রাখার আগে সচেতন হোন, সঠিক পথ বেছে নিন।

*লেখক: মো. মঞ্জুরুল আহসান, সহকারী অধ্যাপক, শিল্প ও সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]