টিফার স্মৃতি এবং উদ্যাপন
দিনটি ছিল ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিন। টরন্টো ডাউনটাউনের আকাশচুম্বী সারি সারি বাড়ির মধ্যে অবস্থিত শহরের অন্যতম সাংস্কৃতিক পীঠস্থান টরন্টো হারবার ফ্রন্ট সেদিন মুখর হয়েছিল বাংলা ভাষায় উচ্চারিত শব্দে। উচ্চারিত হয়েছিল সেই ভাষা, যার জন্য আজ থেকে ৭১ বছর আগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছিলেন তরতাজা যুবকেরা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো সেই একুশে ফেব্রুয়ারিতেই ইন্টারন্যাশনাল মাদার্স ল্যাঙ্গুয়েজ ডে পালিত হয় পৃথিবীজুড়ে। ৪৩তম টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব অথরসের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে তাই পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে সমমর্যাদায় বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে আমরা ১০ জন বাঙালি লেখক পৌঁছে গিয়েছিলাম সেদিন। উদ্যাপন করেছিলাম বাংলা ভাষা। হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে যে আবেগ উৎসারিত হয়, সেটি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল চোখেমুখে আর আমাদের উচ্চারিত বাংলা শব্দে।
কানাডা ও টরন্টোবাসী বাংলা ভাষার অক্ষরশ্রমিকেরা একত্রিত হয়ে এমন একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম যে মানুষটির সাংগঠনিক দক্ষতায়, তিনি গায়েত্রী গ্যামি অ্যাওয়ার্ড এবং নালন্দা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক গবেষক সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুব্রত কুমার দাস। টিফার বিশ্ব দরবারে বাঙালি লেখকদের নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চক্রের আয়োজন করার পেছনে মূল পুরোধা তিনিই।
২০২২ সালের টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব অথরসের (টিফা) ৪৩তম বার্ষিক অনুষ্ঠানে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী সাহিত্য সমাবেশে বাঙালি লেখকেরা অংশ নিয়েছিলেন হারভার ফ্রন্টের ওপেন স্টেজে। সেদিনের অনুষ্ঠানে World in Other Words: Bengali Stories in Canada—এ শিরোনামে লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসের তত্ত্বাবধানে লেখিকা রুমানা চৌধুরী ও ভাস্বতী ঘোষ তাঁদের লেখালেখির অভিজ্ঞতা ও অনুবাদ প্রসঙ্গে বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এরপর দ্বিতীয় পর্বে World in Other Words: Bengali Readings শিরোনামের অনুষ্ঠান পর্বে আবারও সুব্রত কুমার দাসের সঞ্চালনায় বাংলাদেশ ও কলকাতার আরও ছয়জন বাঙালি লেখক ভজন সরকার, আকতার হোসেন, শুজা রশীদ, শ্রেয়সী বোস দত্ত, বাদল ঘোষ ও আমি দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক আমাদের লেখা গদ্য, স্বরচিত বাংলা কবিতা এবং তার অনুবাদ পাঠ করে শুনিয়েছিলাম উপস্থিত নানা ভাষার দর্শক ও শ্রোতাদের। হারবার ফ্রন্টের উন্মুক্ত মঞ্চে সবুজ গালিচার মতো ঝকঝকে লনে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে টরন্টো সিএন টাওয়ারকে সাথি করে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলাম আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বাংলা ভাষার জয়গান শুনে দর্শকদের করতালিতে আমরা উজ্জীবিত হয়েছিলাম বারবার। আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয় ঘোষণা করা ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।
এই আনন্দে এ বছরও শামিল হওয়ার জন্য আমরা উৎসাহ বোধ করেছিলাম। তার ফল স্বরূপ এ বছর টিফার ৪৪তম বার্ষিক আয়োজনে আবারও নতুন ১১ জন বাঙালি লেখক উদ্যাপন করেন বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে। আর আমরা যাঁরা গত বছর মঞ্চে ছিলাম, বাংলা ভাষার প্রতি সেই একই আবেগ ও উৎসাহ নিয়ে ছিলাম দর্শকদের আসনে।
এ বছর আন্তর্জাতিক লেখক উৎসব শুরু হয় ২১ সেপ্টেম্বর। ১১ জন বাঙালি কবি-লেখক টিফা মঞ্চে তিনটি পর্বে অংশ নেন। উৎসবের চতুর্থ দিন ২৪ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় ‘রাইটিং অ্যাজ আ প্যাশন’ শিরোনাম পর্বে তিন বাঙালি লেখক পণ্ডিতজন দিলীপ চক্রবর্তী, কবি ও ছোটগল্পকার রোকসানা লেইস এবং প্রাবন্ধিক সুধীর সাহা কথা বলেন। বেলা একটায় একটি সেশন ছিল কানাডায় বসবাসকারী বাঙালিদের নিয়ে, যাঁরা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। ‘বেঙ্গলিজ ইন ক্যানলিট’ পর্বে বাঙালিরা কবি কে. গান্ধার চক্রবর্তী, ঔপন্যাসিক আরিফ আনোয়ার এবং কবি লাবণী ইসলাম ছিলেন। এ তিনজন লেখকের রয়েছে কানাডা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থ। বিকেল সাড়ে চারটায় ‘রিডিং বেঙ্গলি পোয়েমস’ পর্বে চার বাঙালি কবি অংশ নেন, তাঁরা হলেন শেখর গোমেজ, আঞ্জুমান রোজী, শিউলি জাহান ও কাজি হেলাল। এবার বাঙালি লেখক-কবিদের অংশগ্রহণে তিনটি আয়োজনই অনুষ্ঠিত হয় Brigantine Patio (235 Queens Quay West Toronto ON M5J 2G8) ঠিকানায়। আগেরবারের মতো এবারও তিনটি আয়োজন ছিল উন্মুক্ত।