ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিকথা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দীর্ঘ চার দশক পর স্মৃতিকথা লিখব এটা কখনো ভাবিনি। জানা থাকলে প্রতিদিনের ক্লাস নোট খাতার পাশাপাশি আরেকটি খাতা স্মৃতিচারণার জন্য রাখলে আজ বিশাল একটি গ্রন্থ হয়ে যেত অনায়াসে। ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায়’। পাস কোর্সে গ্র্যাজুয়েশনের পর দুই বছরের স্নাতকোত্তরের কোর্স শেষ হয় চার বছরে। রেজাল্ট বের হতে সময়ক্ষেপণ হয় এক বছর। পরীক্ষা শেষে এক ছাত্রী বিয়ের পর মা হন। বাংলার বাণী পত্রিকায় ছবিসহ সেই সংবাদ প্রকাশিত হলে ডিপার্টমেন্টের টনক নড়ে।

লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পরিবর্তে স্নাতক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে স্নাতকোত্তর পর্বে ভর্তির ব্যবস্থা ছিল ১৯৮০ সালে। আমাদের ভর্তির পর পরই এই পদ্ধতির অবসান হয়। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ভর্তির আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় কাজিন বন্ধুতুল্য দেলোয়ার হোসেন বাদল সঙ্গী ছিল তখন। বাদল সপরিবার সিডনিপ্রবাসী। বাদল বলল, দাদা, বাংলা ডিপার্টমেন্টেও একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিই। দেখি না কী হয়? টেবিলে অপেক্ষায় স্যার আমার কাগজপত্র দেখে ভড়কে যাওয়ার মতো অযাচিত অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করলেন, সব বিষয়ে তোমার মার্ক এত বেশি কেন? তুমি কি নকল করেছো? উত্তরে তর্ক না করে যুক্তির আশ্রয় নিই। স্যার কলেজের পরীক্ষার উত্তরপত্র কি কলেজ শিক্ষকেরা দেখেন, না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেখেন? না, কেন আমরা দেখি। তাহলে তো স্যার আপনার প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছেই আছে।

শৈশবে মসজিদে গিয়ে আরবি পড়েছি। কৈশোরের প্রতিটি ভোরেও মসজিদে হাজির হয়েছি। এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল আটটার ক্লাস শুরুর আগে উপস্থিত থাকা আমার কাছে কোনো কষ্টকর ব্যাপার বলেই মনে হতো না। নারায়ণগঞ্জের জামতলার মোড় থেকেই প্রগতির তৈরি সুপরিয়র বাসে উঠি। গুলিস্তান থেকে রিকশায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ ঘেঁষে কলা ভবনে যাওয়ার পথে সবুজের এক মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে ক্লাসে পৌঁছি। সহপাঠী বন্ধু আবু ইয়াহিয়া দুলাল একদিন জিজ্ঞাসা করে, কিরে হলে থেকে সকাল আটটার ক্লাস ধরতে পারি না, লেট লতিফ হই। এত সকালে তুই অত দূর থেকে কেমন করে আসিস?

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দেখা গেল অনেকেই প্রাচ্যের ডান্ডির শহর থেকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে যান। বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে যেতে গিয়ে কেউ কেউ দুলালের মতো লেট লতিফ হয়ে ডান্ডি-পটাশ হন। এরপর শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস প্রাপ্তির স্বাক্ষর অভিযান। অভিযান সফল হলো। বাসার মোড় থেকেই সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ‘আনন্দ’ বাসে উঠি। রোকেয়া হলের গেটের বিপরীতে নেমেই এক কাপ গরম চায়ের পর সিগারেটের ধূম্ররাশি উড়িয়ে ক্লাসে ঢুকি।

স্যারদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ক্লাস রুটিন ও নোট খাতায় তাঁদের নাম লেখার রীতি ছিল। ডক্টর আহমদ শরীফ স্যারের নাম—আশ। ডক্টর সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারের নাম - সৈআহো। অনেকেই নামের বানান ভুল করেন, এ জন্য আকরম স্যার প্রথম ক্লাসে বললেন, আমার নামের বানানের—এ আকার নাই। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের এক কর্মচারী ডক্টর আহমদ শরীফ স্যারের নামের বানান ভুল করলে স্যার তাঁকে বলেছিলেন, আহম্মক কোথাকার! ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ স্যার তাঁর নাম বোর্ডে লিখে বলেছিলেন—ম-এ ওকার হবে না, হ্রস্ব উ কার হবে।

দীন মুহম্মদ স্যার বেশ কিছুদিন বানানের রীতির ক্লাস নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে বই জেরোক্স করা যেত। ফ্রয়েডের একটি বই জেরোক্স করার জন্য ফরম পূরণের পর অনুমতির জন্য ডিপার্টমেন্টে জমা দিই। দিন-মাস ঘুরে বছর এলে দীন মুহম্মদ স্যার বললেন, তুমি ফ্রয়েডের বই পড়তে চাও কেন? স্যার নবীজী (সা.) বলেছেন—‘জ্ঞানের জন্য সুদূর চীন যেতে পারো।’ স্যার দুই চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা নাও। লন্ডন যাওয়ার সময় প্লেনে স্যার হাঁচি দেওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ শব্দ করে উচ্চারণ করেছিলেন। সহযাত্রী তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, তোমার উচ্চারিত শব্দের অর্থ কি? উত্তরে স্যার বলেছিলেন, এটা তোমাদের ‘এক্সকিউজ মি’ শব্দের আরবি। আকাঙ্ক্ষা শব্দের সঠিক বানান ও উচ্চারণের জন্য দুই দিন ক্লাস নিয়েছিলেন।

আকরম স্যারের ক্লাসটি ছিল ঠিক লাঞ্চের পর ভাতঘুমের সময়। স্যার বললেন, আমার ক্লাসটি দুটি পিরিয়ডের সমান দীর্ঘ। দুপুরে আমার ক্লাসটির জন্য তোমাদের কষ্ট হবে। আমি চাই তোমরা কষ্ট করেই শেখো। স্যারের প্রতিটি ক্লাসের জন্য লাঞ্চের পর ঘুম তাড়ানিয়া চা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। কখনো একসঙ্গে দুই কাপ। আশির দশক থেকে আজও পত্রিকা ও বইয়ের সব সাক্ষাৎকার পড়ি। আকরম স্যারের সাক্ষাৎকার আজও দেখিনি গত চার দশকে। স্যার হয়তো সচেতনভাবে এই পর্বটি এড়িয়ে চলেন। পথের পাঁচালী, অপরাজিতা, আরণ্যক, লাল সালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো, পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য—স্যারের নির্দেশ ছিল এই ৯টি বইয়ের প্রতিটি বই তিনবার করে পড়তে হবে। কী বিশাল আয়োজন। সারারাত জেগে প্রতিটি বই তিনবার করেই পড়েছি। পড়ায় কোনো ফাঁকি ছিল না। শৈশব থেকেই বই পড়ি। ডক্টর আহমদ শরীফ স্যার, ডক্টর সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার ও ডক্টর সাঈদ-উর-রহমান স্যার বই পড়া ও বইয়ের সমালোচনা করা শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন কর্তন, বর্জন। আকরম স্যার ও সাঈদ-উর-রহমান স্যার বলেছিলেন, আমরা তোমাদের চোখ তৈরি করে দেব। দেখার দায়িত্ব তোমাদের।

টিউটোরিয়াল ক্লাসগুলো ছিল ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে একে-অপরের সান্নিধ্যে আসার ও জানার সুযোগ। সাইদুর রহমান ভূঁইয়া স্যারের টিউটোরিয়াল ক্লাসে স্যার জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কোথায় থাকো? স্যার আমি রুমির স্কুল ফ্রেন্ড। একসময়ে স্যার সপরিবার নারায়ণগঞ্জ থাকতেন। রুমি স্যারের বড় ছেলে, মাধ্যমিক স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল। এয়ারফোর্সের প্লেন ক্রাশে রুমির অকাল প্রয়াণ ঘটে। স্যার স্তব্ধতার ঘোর ভেঙে বললেন—তোমার বাসা কোথায়, ঠিকানা বলো? ঠিকানা বলার পর বললাম, স্যার আপনি যে গলিতে থাকতেন আমি তার পশ্চিমের গলিতে। একদিন পড়ন্ত দুপুরে মহল্লার মোড়ের মুদিদোকানের ছেলেটির বাসায় এসে বলল—ভাই ঢাকা থেইক্কা একজন লোক আইছে, আপনেরে ডাহে। আমার দোকানের সামনে খাড়ায়াইয়া রইছে। অলি ভাই, তাঁকে বাসায় নিয়ে আসতেন। না হয় আইব না কইছে। আপনেরে আমার লগে যাইতে কইছে। সাইদুর রহমান স্যারকে দেখে বিস্মিত হয়ে সালাম দিয়ে বলি—স্যার বাসায় চলুন। না, চলো রিকশায় ওঠো, বোস কেবিনে গিয়ে চা খাব। বোস কেবিন নারায়ণগঞ্জের শতাব্দী প্রাচীন প্রসিদ্ধ রেস্টুরেন্ট, চা ও আড্ডার জন্য বিখ্যাত আজও।

‘সেই চম্পা নদীর তীর’ থেকে একরাশ সুর নিয়ে আসতেন আবু হেনা স্যার। তাঁর কণ্ঠে সব সময়ই ধ্বনিত হতো একটি গান বা কবিতার লাইন। ‘আমার চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে’। মনে হয় স্মৃতিধর আবু হেনা স্যার সব সময়ই কাব্যময়তার মধ্যে ডুবে থাকতেন। আবু হেনা স্যার রবীন্দ্র কাব্য পড়াতেন আমাদের। সংবাদের সাহিত্য পাতায় রবীন্দ্র কাব্য নিয়ে স্যারের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় স্যারের লেখাটি উত্তরপত্রে লিখে দিয়েছিলাম। আবু হেনা স্যার ও সাঈদ উর রহমান স্যার দুজনের ‘আপনি’ সম্বোধনে আমি আচ্ছন্ন ও আবিষ্ট আজও।

ডক্টর সাঈদ উর রহমান স্যার বলেছিলেন, আপনারা রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ পড়বেন। প্রতিদিন লাঞ্চের পর ক্লাস না থাকলে লাইব্রেরিতে বসে বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের রচনাবলি থেকে তাঁদের লেখা চিঠি পড়েছি। কারও রচনাবলি থেকে যেন চিঠি বাদ পড়ে না যায়, এ জন্য ক্যাটালগ ঘেঁটে সব সাহিত্যিকদের রচনাবলির ক্যাটালগ নাম্বার লিখে রেখেছি খাতায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে বরেণ্য, খ্যাতিমান শিক্ষকদের ছাত্র হতে পারা গর্ব, অহংকার ও আনন্দের বিষয় বলে মনে হয় আজ।