শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য: নৈতিকতা বনাম দুর্নীতি

প্রথম আলো ফাইল ছবি

শিক্ষায় জাতির মেরুদণ্ড, এসব ফালতু কথা কে কবে কীভাবে বা কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সেটা জানার আর কোনো শখ নেই। বরং বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হবে। যা দেখছি, তাতে পরিষ্কার যে দুর্নীতি আসলে জাতির মেরুদণ্ড। সেটা শিখতেই আমরা এত দিন লেখাপড়া করেছি। যিনি যত ডিগ্রিধারী, যিনি যত ক্ষমতাশালী, তিনি তত দুর্নীতিবাজ, ভণ্ড। এই তো চারপাশে দেখছি। আর এসব শিক্ষিত ব্যক্তিই কিন্তু শিক্ষা প্রদান করেন, তাঁরা সবাই বড় বড় গুন্ডা, রাজনীতিবিদদের চামচা ইত্যাদি।

এ ধরনের শিক্ষকদের আবার তাঁদের ছাত্ররা ধরে মারপিটও করছেন ইদানীং। দিব্যি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কীভাবে সুদ, ঘুষ খেতে হয়; কীভাবে সেটা সমাজে প্রচলন করতে হয়। পরে শিক্ষা শেষ, চলছে তার প্র্যাক্টিস। ফলে বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাঁদের শিক্ষকদের মেরে অপমান করে প্রমাণ করছেন, যেমন শিক্ষক তেমন শিক্ষার্থী। সহজ করে বললে এমন দাঁড়ায়, যেমন কর্ম তেমন ফল। খামাখা আমরা বদনাম দিচ্ছি শিক্ষিত লোকদের। তাঁরা যা শিখেছেন, মূলত সেটাই করছেন।

আমার কথায় কি কোনো সন্দেহ আছে?

এই বাস্তবতায় এসে প্রশ্ন ওঠে, কোনো শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি আমরা? ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ শুনতে ভালো লাগলেও, বাস্তবতা ঠিক উল্টো। এমনকি শিক্ষকও এখন অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় ও দুর্নীতির সঙ্গে আপস করছেন। আমরা একটি এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে দুর্নীতি, স্বার্থপরতা ও অন্যায় আচরণ যেন শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিবেশে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী? কী ধরনের শিক্ষা আমরা নিচ্ছি?

শিক্ষা কেবল ডিগ্রি অর্জন নয়; বরং জীবনের নীতি, মূল্যবোধ ও আচরণের বিকাশ ঘটানোর একটি উপায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের চারপাশের যা চিত্র তাতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা যেন ব্যক্তিগত স্বার্থ ও দুর্নীতির পথচলা শেখানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। যাঁদের কাছে ক্ষমতা আছে, তাঁরা নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অন্যকে নিচে ফেলার কৌশলগুলো শিখে নিচ্ছেন এবং এসব কৌশল রপ্ত করে তাঁরা নিজেদের সুবিধা লাভে তৎপর হচ্ছেন।

তাই আজকের সমাজে শিক্ষার প্রকৃত মানে বোঝা জরুরি হয়ে পড়েছে। ‘শিক্ষা’ শব্দটির আসল অর্থ হলো জ্ঞান অর্জন ও তার সঠিক ব্যবহার, কিন্তু বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়ে দুর্নীতি, অনৈতিকতা ও স্বার্থপরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি শিক্ষক, যাঁদের আমরা সমাজের দিকপাল হিসেবে মনে করি, তাঁরাও নিজেদের স্বার্থে নৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছেন।

তাহলে আসল শিক্ষা কী?

আসল শিক্ষা হলো নৈতিকতা, সততা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যক্তি নয়; বরং সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করা। শিক্ষা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন একজন ব্যক্তি তাঁর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন এবং নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটান।

শিক্ষা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বা জ্ঞান নয়, এটি অন্যদের প্রতি আচরণ, সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও নৈতিক দায়িত্ববোধের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে। সত্যিকার শিক্ষা সেই শিক্ষা, যা মানুষকে সততা, নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলির প্রতি উৎসাহী করে তোলে।

আমাদের সমাজে এমন অনেক শিক্ষিত মানুষ আছেন, যাঁরা দুর্নীতির এই স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। যেমন সৎ ও সাহসী সরকারি কর্মকর্তাদের কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়, যাঁরা ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে নিজের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করেছেন। এ ধরনের মানুষদের শিক্ষাই হলো সত্যিকার শিক্ষার উদাহরণ, যেখানে শিক্ষার মূল লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা।

আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজকাল নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্বের গুরুত্ব বোঝাতে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে এখন নিয়মিত নৈতিক শিক্ষার ক্লাস নেওয়া হয় এবং সমাজসেবার কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এমন প্রচেষ্টা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং বাস্তব জীবনে সঠিক মূল্যবোধের চর্চার সুযোগ তৈরি করছে।

আসল শিক্ষা শেখা এবং চর্চা করার উপায়গুলো হচ্ছে—

নৈতিক শিক্ষা: শিক্ষার মূলধারায় নৈতিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটি শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়; বরং সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের শিক্ষা হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝাতে হবে, যাতে তাঁরা সঠিক ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন।

ব্যক্তিত্ব গঠন: শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁদের ব্যক্তিত্বের বিকাশে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা ও সামাজিক বোধের উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা জীবনের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ: শিক্ষা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, সমাজের কল্যাণে কাজ করার মনোভাবও তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ ও নৈতিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দিতে হবে।

সমান সুযোগ এবং নিরপেক্ষতা: শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও নিরপেক্ষতার গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেখানে ব্যক্তির অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থান নয়; তাঁর যোগ্যতা, পরিশ্রম ও সততা মূল্যায়িত হবে। এতে দুর্নীতি ও ভণ্ডামির স্থান থাকবে না।

শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার: শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন জরুরি। শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিকতা, সততা ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটাতে হবে, যাতে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পথ দেখাতে পারেন। তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।

বর্তমান সমাজে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে যে আমরা ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা, যা মানুষকে সঠিক পথে চালিত করে, নৈতিক মূল্যবোধ শেখায় এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে। এই শিক্ষা পেতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন করতে হবে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য শুধু ব্যক্তিগত উন্নতি নয়, বরং জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা। যদি আমরা একটি সৎ, নৈতিক ও দায়িত্বশীল সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই শিক্ষার প্রকৃত মানে বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষিত হতে হবে—চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।

*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন