বাংলা নামে ঝলমল সিডনির লাকেম্বা
ঢাকার সেই চিরচেনা কোলাহল, কারওয়ান বাজারের ব্যস্ততা কিংবা নিউমার্কেটের উৎসবমুখর পরিবেশ কিংবা ঢাকার বাইরে মফস্সল শহরের সবজির বাজারে কেনাকাটা—এই স্মৃতিগুলো যাঁদের সত্তায় মিশে আছে, হাজার হাজার মাইল দূরে অস্ট্রেলিয়ার দিনগুলোয় তাঁদের মন কেমন করে ওঠে। কিন্তু যদি বলি, সিডনির বুকেও আপনি দেখা পেয়ে যাবেন সেই কারওয়ান বাজার বা মফস্সলের সবজির বাজারের? অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মহানগরের বুকে একটুকরো বাংলাদেশ সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব মেলে ধরেছে, আর সেই এলাকার নাম লাকেম্বা।
সিডনির উপকণ্ঠে এই ছোট্ট এলাকাটি ঘিরে গড়ে উঠেছে এক জীবন্ত ও প্রাণবন্ত বাংলাদেশি সমাজ। এখানকার বাতাসে ভাসে ইলিশভাজার মনমাতানো ঘ্রাণ, কানে আসে দোকানের ভেতর থেকে ভেসে আসা বাংলা গানের সুর, আর ফুটপাতজুড়ে চোখে পড়ে পানের বাটায় রাখা চুন, খয়ের। দোকানগুলোয় পরম মমতায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশি শুঁটকি, চাল-ডাল, মসলা থেকে শুরু করে টুপি-লুঙ্গি, গামছা, জর্দা, আতর পর্যন্ত। ‘বঙ্গবাজার’, ‘কারওয়ান বাজার’, ‘ধানসিঁড়ি’, ‘খুশবু’, ‘বৈশাখী’, ‘জেবা’, ‘গ্রামীণ’, ‘একুশে’, ‘হাটবাজার’, ‘বনফুল’, ‘ঢাকা’—এমন সব পরিচিত বাংলা নামে ঝলমল করছে দোকানপাট। এই নামগুলো নিছক সাইনবোর্ড নয়, এগুলো প্রবাসীদের জন্য এক একটি স্মৃতিকাতরতার ঠিকানা, শিকড়ের প্রতিচ্ছবি। বাংলার স্বাদ, গন্ধ আর সুরে ভরা লাকেম্বা যেন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাংলাদেশের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
সিডনির বুকে ‘ছোট্ট বাংলাদেশ’
লাকেম্বার সড়ক রেলওয়ে প্যারেড, হ্যাল্ডন স্ট্রিট কিংবা লাকেম্বা স্ট্রিটে পা রাখতেই মনে হবে, আপনি সিডনিতে নয়, ঢাকারই কোনো পরিচিত পাড়া-মহল্লায় দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষের কোলাহল, বাংলায় কথা বলার স্বস্তি, আর রেস্তোরাঁগুলো থেকে ভেসে আসা বিরিয়ানি আর কাবাব ও ইলিশভাজার সুঘ্রাণ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আপন অনুভূতি। লাকেম্বা এখন আর কেবল একটি উপশহর নয়, এটি হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের প্রধান মিলনকেন্দ্র।
ক্যান্টারবারি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর শাহে জামান টিটু জানালেন, ‘লাকেম্বা ও এর আশপাশের এলাকা মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন। আর পুরো অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশির সংখ্যা লক্ষাধিক।
সিডনি বেড়াতে আসা বাঙালিরাও একবারের জন্য হলেও এই ‘ছোট্ট বাংলাদেশে’ ঢুঁ মেরে যান। একটি দোকানের মালিক মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন বললেন, ‘আমাদের এখানে ব্যবসা করাটাও যেন সারা দিনের উৎসব। পরিচিত মানুষের আনাগোনা, দেশের মানুষের সঙ্গে বাংলায় কথা বলা, তাঁদের সেবা করা—সব মিলিয়ে মনে হয় যেন নিজের দেশেই আছি।’
প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসে লাকেম্বার চেহারাটাই বদলে যায়। সিটি কাউন্সিলের ব্যবস্থাপনায় এখানে বসে ‘রামাদান নাইটস’ নামের এক জমজমাট ইফতারি ও খাবারের মেলা।
সাফল্য, স্বীকৃতি এবং ধূসর বাস্তবতা
সিডনিতে বাংলাদেশি সমাজ মানেই কেবল ব্যবসা, সাফল্য আর উৎসবের গল্প নয়। যেখানে বাঙালি, সেখানে ঐক্যের পাশাপাশি অনৈক্য বা ‘ক্যাচাল’ থাকবে না, তা কী করে হয়! বিশাল এই কমিউনিটিতে প্রায়ই দেখা মেলে ব্যক্তিগত রেষারেষি, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা সামাজিক-রাজনৈতিক দলাদলির মতো বিষয়। কখনো কখনো এসব মতবিরোধ থেকে ঘটে কিছু অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক ঘটনা, যা অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার গণমাধ্যমেও উঠে আসে। এসব ঘটনা কমিউনিটির সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও ম্লান করে। তবে শত সাফল্যের ভিড়ে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোই যেন মনে করিয়ে দেয়, সমাজ হিসেবে আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
তবে এই আলোছায়ার মধ্যেও আশার কথা হলো, বাংলাদেশিরা এখন অস্ট্রেলিয়ার মূলধারায় রাজনৈতিকভাবেও যথেষ্ট প্রভাবশালী। স্থানীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলররা সাফল্যের সঙ্গে কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁদের এই অংশগ্রহণ এখন জাতীয় পর্যায়েও প্রভাব ফেলছে। অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ এবং বাংলাদেশিদের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী মন্ত্রী টনি বার্ক প্রায়ই বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বিশেষ করে টনি বার্কের সঙ্গে এই কমিউনিটির সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। তাঁদের এই সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে, অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি সমাজ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
তবু মন পড়ে থাকে লাকেম্বায়
সময় বদলেছে। বাংলাদেশিরা এখন আর শুধু লাকেম্বায় সীমাবদ্ধ নেই। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন সিডনির অন্যান্য উপশহরে। দক্ষিণ-পশ্চিম সিডনির মিন্টো, ইঙ্গেলবার্ন, গ্লেনফিল্ড ও ক্যাম্পবেলটাউন এমনকি নতুন এলাকা বারডিয়া, ডেনহ্যাম কোর্ট এলাকাগুলোয় এখন বাংলাদেশিদের শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। একইভাবে পশ্চিম সিডনির ব্ল্যাকটাউন ও তার আশপাশের এলাকায়ও বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে।
সিডনিতে প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন প্রকৌশলী আব্দুল মতিন। সিডনির দক্ষিণ-পশ্চিমের এলাকা হোলসওয়ার্দিতে নিজের কেনা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এক ছুটির দিনে। তিনি বললেন, ‘যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন লাকেম্বাকেন্দ্রিক ছিল আমাদের সবকিছু। এখন আমরা আরও ভালো জায়গায় থাকি, ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ে। কিন্তু মনটা এখনো টানে লাকেম্বার জন্য। কিছুদিন পরপর একবার ওখানে না গেলে মনে হয় কী যেন নেই। আসলে ওখানকার বাতাসে দেশের গন্ধ পাওয়া যায়।’