বসন্তের জন্য অপেক্ষা

প্রিয় ঋতু কোনটি কেউ জিজ্ঞাসা করলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ব। কোনটা প্রিয় ঋতু? সব কটিই যে প্রিয়! আমার বর্তমান ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্য ডেলওয়্যার। এই ডেলওয়্যারে প্রতিটি মৌসুম ভিন্নতা নিয়ে আসে। যেহেতু এখানে প্রতি ঋতুর একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, তাই তাদের প্রতি আমার পৃথক ভালোবাসা জন্মে গেছে। প্রতিটি ঋতু নিয়ে আসে অনন্য আমেজ, প্রকৃতি সাজে অপূর্ব সাজে। সেই সাজ যেন অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে একেবারে ভিন্ন। এই যেমন এখন গুটিগুটি পায়ে এসেছে ঋতুরানি বসন্ত। আকাশে-বাতাসে ঝংকৃত হচ্ছে তার আগমনী সুর, আমি সেই সুর শুনতে পাই।
সব কটি ঋতু প্রিয় হলেও নিজেকে শীতকালের বড় ভক্ত বলে দাবি করতে পারি না। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, তার পক্ষে ঠান্ডা আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া কার্যত কষ্টকর, বিশেষত সেই শীতকাল যদি চার থেকে পাঁচ মাস স্থায়ী হয়। তাই শীতকাল বিদায় নিয়ে যখন বসন্তকাল আবির্ভূত হয়, তখন একেক দিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবি, ‘এত্ত সুন্দর একটা দিন দেখার সৌভাগ্য হলো আমার!’ শোবার ঘরের জানালা দিয়ে প্রভাতের বাসন্তী রঙের রোদ এসে ভাসিয়ে দেয় কাঠের মেঝে, সাদা আরামকেদারা, লিনেনের বিছানা-বালিশ।

বসন্ত তার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে গাছের নতুন পাতায়। আমার বাগানের গোলাপগাছগুলোয় লাল রঙের শিশুপাতা বাসন্তী বাতাসে তিরতির করে কাঁপে। শুধু পাতা নয়, পুষ্পজগৎও জানিয়ে দেয় বসন্তের উপস্থিতি। ড্যাফোডিল, টিউলিপ, হেলেবোর এবং হায়াসিন্থেরা মৃদু বাতাসে মাথা দুলিয়ে গায় তাদের নিজস্ব কোনো সংগীত।
ড্যাফোডিল, টিউলিপরা বিদায় নেওয়ার আগেই আরও ফুল দলে দলে যোগ দেবে বসন্তের এই পুষ্পোৎসবে। এই সময়ে, মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য উপভোগ করা যায় প্রকৃতির সবচেয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্যের। একটি সাদা অথবা গোলাপি পুষ্পে পুষ্পিত চেরিগাছ। বসন্তের সবচেয়ে মনোহর দৃশ্য বোধ হয় ফুলে ভরা চেরিগাছ।
চেরি ছাড়াও এ সময় ফোরসিথিয়া, ডগউড, ইস্টার্ন রেডবাড, ক্র্যাবঅ্যাপল অথবা ম্যাগনোলিয়া গাছের ক্ষণজন্মা বেগুনি, সাদা, গোলাপি অথবা হলুদ ফুলের সৌন্দর্য প্রকৃতিপ্রেমীদের নিয়ে যায় কোনো রূপকথার ভুবনে। শীতপ্রধান অঞ্চলে উপরিউক্ত গাছগুলোয় বসন্তে পাতা আসার আগে ফুল আসে, ফুলগুলো ঝরে গেলে নতুন পাতা জন্মায়।

আমরা যারা বাগান করি, তাদের জন্য এই বসন্তকাল হচ্ছে একটু একটু করে তৈরি হওয়া গ্রীষ্মের জন্য। বসন্ত হলেও এক-একদিন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। কিন্তু যেদিন আবহাওয়া একটু উষ্ণ থাকে, সেদিন বাগানের যত্ন নিয়ে, পরগাছা এবং গত শীতের অবশিষ্ট ঝরাপাতা মাটি থেকে তুলে ফেলে, পুরোনো গাছের নতুন পাতাদের হাত বুলিয়ে একটু আদর করে একটা বড় সময় কাটে। নতুন কী গাছ রোপণ করব, তা নিয়ে পরিকল্পনা, চট করে নার্সারি ঘুরে আসা, কয়েক প্যাকেট বীজ, কয়েক ব্যাগ মাটি এবং সার আগেভাগে কিনে রাখা—এসবই চলে বসন্তে। আর চলে অপেক্ষা, কবে সত্যিকারের উষ্ণতা আসবে, কবে বাগান শুরু করা যাবে, কবে গরম জামা আর লেপ-কম্বল বাক্সবন্দী করতে পারব, কবে জানালা খুলে বাইরের বিশুদ্ধ বাতাসকে ঘরে ডেকে এনে বলতে পারব, ‘নে যত খুশি খেলা কর।’
এ বছর আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত এসেছে ১৯ মার্চ। ক্যালেন্ডারের কথা চিন্তা করলে বলা যায়, আমার বসন্তের জন্য অপেক্ষার অবসান হয়েছে। ড্যাফোডিল ফুটেছে। কুঁড়ি এসেছে হায়াসিন্থ ও টিউলিপে। ইস্টার্ন রেডবাডে ফুটেছে বেগুনি আভার গোলাপি ফুল। ফুলভর্তি ম্যাগনোলিয়াও চোখে পড়েছে কয়েকটা।
এখন অপেক্ষা বসন্তকালে প্রকৃতির সবচেয়ে নয়নাভিরাম সেই দৃশ্যের—বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত হওয়া একটি বিকশিত চেরিগাছ।