উন্নয়ন: কতটা দরকার
আমি অর্থনীতির কোনো ছাত্র নই। অনেকের মতো অর্থনীতি বোঝার চেষ্টা করি মাত্র। অর্থের মূল কথা হচ্ছে, এ দিয়ে মানবজাতির উন্নয়ন। দিন দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, আসলে কি উন্নয়নের দরকার ছিল?
আমি গ্রামে বড় হয়েছি। সেখানে হারিকানের আলোয় লেখাপড়া করেছি। সন্ধ্যা হয়ে গেলেই তখনই পড়ার টেবিলে বসতে হতো। এ যেন এক সান্ধ্য আইন। নদীর ধারে ছিল আমাদের বাড়ি। নদীর ওপারের গ্রামে ছিল বিদ্যুৎ। সব সময় মনে হতো কখন বিদ্যুৎ আসবে আমাদের গ্রামে। একসময় বিদ্যুৎ এসে গেল। বড় বাতির আলোয় পড়াশোনা করতে ভালো লাগত। ভাবলাম এই তো উন্নয়ন। ভাবলাম রাস্তা কখন পাকা হবে। রিকশা–ভ্যান চলবে। সেগুলো দিয়ে বাজার করে বাড়ি ফিরব। বাড়ির বাজার করার দায়িত্ব ছিল আমার। আমার বাবার সঙ্গে প্রায়ই বাজারে যেতাম। ৬০ থেকে ৭০ টাকায় গরুর মাংস।
৫০ থেকে ৬০ টাকায় ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। খুবই আনন্দ লাগত। তখন গ্রামের কৃষক বাজারে গিয়ে কিছু না কিছু ভালো জিনিস কিনতেন। তাঁদের জীবনেও খাওয়াদাওয়ার অভাব ছিল না। মানুষ সুখে–শান্তিতেই বসবাস করতেন। আস্তে আস্তে গ্রামগঞ্জে সংসদ সদস্য মন্ত্রীদের পদচারণ বেড়ে গেল। বলতে লাগল উন্নয়ন করতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ ভাবলাম, উন্নয়ন তো দরকার। এবার আমরা দেখলাম, চারদিকে উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়ল। স্কুল, কলেজ, রাস্তা এবং ব্রিজ নির্মাণ শুরু হয়ে গেল। খুবই আনন্দিত। এখন রিকশা–ভ্যানে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নটা হচ্ছে কীভাবে। উন্নয়ন করার জন্য টাকা দরকার। সরকারের টাকার উৎসই–বা কি। সাধারণ মানুষের মতো আমিও বোঝার চেষ্টা করলাম। সরকার উন্নয়ন করে মূলত মানুষের ট্যাক্সের টাকায় অথবা বিদেশি ঋণের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের মতো দেশে বেশির ভাগ উন্নয়নের হচ্ছে ঋণের মাধ্যমে। সরকার যখন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়, তখন একটা নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। ধরুন সরকার একটি প্রতিষ্ঠানকে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দিল। সেতুর স্থায়িত্বকাল ধরা হলো ১০০ বছর। ৫০ বছর যেতে যেতে সেতুটি ভেঙে পড়ল। সরকারকে আবার অর্থ বরাদ্দ করাতে হলো সেতুটি নির্মাণের। ঋণ করে এই সেতুটি নির্মাণ করল। সরকারের এই ঋণ পরিষদের জন্য অতিরিক্ত কর অথবা টাকার অবমূল্যায়ন করতে হলো। ফলে ১০০ টাকার জিনিস ১৫০ টাকা কিনতে হলো আমাদের। এভাবে উন্নয়ন আমাদের ক্রয়ক্ষমতাকে সীমিত করে চলল।
ওই যে গ্রামের বিদ্যুৎ এলেও এবং আসার সঙ্গে সঙ্গে একটু অসুবিধা নিয়ে এলো। তার নাম লোডশেডিং। সরকার বলল, লোডশেডিং দূর করার জন্য আমাদের তৈরি করতে হবে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট। নতুন নতুন প্ল্যান্ট হলো, বিদ্যুতের দাম বেড়েই চলল আর আমাদের ক্রয়ক্ষমতা কমতেই থাকল। গরুর মাংসের কেজি ৭০ থেকে হলো ৭০০, ইলিশ মাছের দাম ৬০ থেকে হলে ১৬০০। আমরা সাধারণ মানুষ আর গরুর মাংস এবং ইলিশ মাছ খাওয়া প্রায়ই ছেড়েই দিলাম। আর এগুলো হচ্ছে উন্নয়নের ফলাফল।
আরও উন্নয়ন হলো। গ্রামে এল মুঠোফোন। আমরা ভাবলাম, এটা বেশ ভালো যন্ত্র। সহজে যোগাযোগ করতে পারবে একজন অন্যজনের সঙ্গে। কিন্তু এ দিয়ে তরুণ–তরুণী কথা বলতেই থাকে, কথা বলতেই থাকে। এভাবেই তাঁদের নীতি–নৈতিকতা শেষ। তারপর আসলে ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটক। এখানে আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে যা খুশি লিখতে থাকলাম, বলতে থাকলাম এবং ছবি আপলোড করতে থাকলাম, আরও কত কী। এগুলো সবই ফ্রি, কিন্তু এগুলো ব্যবহারের জন্য কিনতে হয় মোবাইল ডেটা।
এটা হচ্ছে অতিরিক্ত খরচ, যার ফলে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়ক্ষমতাকে হলো সীমিত। আগের মতো আর আমার প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ক্ষমতা নেই। সেই সুখ–শান্তি আমরা অনুভব করি না। সাধারণ মানুষের মতো আমারও চাওয়া, এই উন্নয়ন ফিরিয়ে নাও। আমি চাই, কাদামাটির রাস্তা, বিদ্যুৎহীন সমাজ। ফেসবুক, টুইটারবিহীন তরুণ। যারা বিকেলবেলা খেলবে, আড্ডা দেবে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করবে। আর আমি খেতে চাই, ৫০ টাকায় গরুর মাংস আর ৬০ টাকায় ইলিশ মাছ।
আমিও শাহ আবদুল করিমের মতো বলতে চাই ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান...আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ সুন্দর দিন কাটাতে চাই।
লেখক: মো. শফিকুর রহমান, ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, পাবলিক সার্ভিস অস্ট্রেলিয়া