তিউনিসিয়ায় আনন্দভ্রমণে ঢাবি অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকে

উত্তর আফ্রিকার এটলাস পর্বতমালা ও সাহারা মরুভূমির দেশ তিউনিসিয়া সফর করেছে লন্ডনে বসবাসরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের ১১ থেকে ১৪ মে চার দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণে সংগঠনের ৩৯ জন সদস্য ও তাঁদের অনেকে পরিবার নিয়ে ভূমধ্যসাগরের পাড়ের পর্যটন শহর সমুদ্রসৈকত ইয়াসমিন হ্যামামেট গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ঘুরে এসেছেন তিউনিসিয়ার রাজধানী অনিন্দ্যসুন্দর তিউনিস শহর। দেখে এসেছেন ইউনেসকো সংরক্ষিত পিউনিক ও রোমান সাম্রাজ্যের কার্থেজ কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষ। আর ফিরে আসার দিন উপভোগ করেছেন মনমাতানো মেডিটেররানিয়ান ক্রুজ।  

এ ছাড়া সবাই দল বেঁধে গাড়িতে এবং টমটমে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেছেন। তিউনিসিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মিউজিয়াম সুছ, বিখ্যাত মসজিদ কাইরান, বিখ্যাত থিয়েটার আল জেম, তিউনিসিয়ার স্বাধীনতার মহানায়ক হাবিব বুরগিবার সমাধি মোনাস্তির, ধর্মীয় নেতা সিডি বু সাঈদ ও হ্যামামেটের আশপাশের বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থান।

ভূমধ্যসাগরে পুরোনো দিনের আদলে তৈরি ‘কলম্বাস’ বোটে করে সমুদ্রভ্রমণের সময়ে বোটের ক্রুরা গান ও নৃত্য পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখেন। তাঁদের সঙ্গে পুরো বোটের যাত্রীরাও নাচে অংশগ্রহণ করেন। ক্রুদের সাজ ছিল পুরোনো আমলের জাহাজের খালাসিদের মতো। একপর্যায়ে তাঁরা জলদস্যুর ভূমিকায় অভিনয় করেন। কাঠের তলোয়ার দিয়ে ভয় দেখিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার কৌশল প্রদর্শন করেন। বোটে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনও ছিল।  

গত বছর এ সংগঠনের সদস্যরা আকর্ষণীয় ইস্টবর্ণের সমুদ্রসৈকতে সামার ট্রিপে গিয়েছিলেন। তখন সভাপতি মারুফ চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আগামী দিনে আমরা ইউকের বাইরে অন্য দেশে সবাই মিলে সফরে যাব।’ যেই কথা সেই কাজ, অর্থাৎ তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রস্তুতি। সফরকে সাফল্যমণ্ডিত করতে করিতকর্মাদের নিয়ে গঠন করা হয় একটি কমিটি। সভাপতি মারুফ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ ফ মেসবাহ উদ্দিন ইকোর তত্ত্বাবধানে কমিটিতে ছিলেন বাসিত চৌধুরী কামরান, সৈয়দ জাফর, এরিনা সিদ্দিকী, সৈয়দ ইকবাল, মেহেরুন আহমেদ মালা ও কামরুল হাসান। তবে শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক এরিনা সিদ্দিকী এ সফরকে ফলপ্রসূ করতে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন এবং কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ জাফরের সহযোগিতায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ তিউনিসিয়া সফর চূড়ান্ত করা হয়। এরপর তিউনিসিয়া সফরে যাওয়ার যাত্রীরা মহা আনন্দে শুরু করেন প্রস্তুতি। ‘তিউনিসিয়া ভ্রমণ’ গ্রুপে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতির মহাযজ্ঞ। সেখানকার আবহাওয়া কেমন হবে, তাপমাত্রা কেমন থাকবে, সুস্বাদু খাবারের তালিকা, সাঁতারের উপযোগী পোশাক, সময় কাটানোর জন্য দাবা, লুডু, কার্ড সঙ্গে নেওয়ার তাগিদ ইত্যাদি। কোন কোন আকর্ষণীয় স্থানগুলো দেখতে যাওয়া হবে তা গবেষণা করে বের করেছেন কামরুল হাসান।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় ১১ মে গেটউইক বিমানবন্দর ছিল মুখর। ইজি জেট এয়ারলাইনসের প্যাকেজ ট্যুরে অল ইনক্লুসিভ হোটেল বুক করা হয়েছিল।

আগেই ঠিক করা ছিল লন্ডনের যে যে প্রান্তেই থাকুক, দুপুর ১২টায় গেটউইক বিমানবন্দরে সবাই উপস্থিত থাকবেন। সবার আগে মাহফুজা রহমান ও এমদাদ তালুকদার দম্পতি গরম গরম পেঁয়াজু নিয়ে হাজির হয়েছেন। এরপর একে একে মতিন চৌধুরী এসেছেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনসহ রেডব্রিজ থেকে বড় গাড়িতে একসঙ্গে অনেকে এসেছেন। উপদেষ্টা শাহগির বখত ফারুক, সভাপতি মারুফ চৌধুরী, মোহাম্মদ আবুল কালাম এসেছেন। মির্জা আসাব বেগ, বাসিত চৌধুরী ও মোস্তফা কামাল মিলন এসেছেন সস্ত্রীক, সৈয়দ ইকবাল স্ত্রী ও তিন সন্তান এবং কে জি বি কনক ও সুপ্রভা অ্যালামনাই দম্পতি দুই সন্তানসহ এসেছেন। আরও এসেছেন ফখরুল ইসলাম মেজবাহ, ফয়জুল হক রিপন, মিজানুর রহমান, কামরুল হাসান, সহুল আহমেদ মকু, চন্দন মিয়া, আব্দুল মাজেদ, সৈয়দ জাফর। সস্ত্রীক সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন ইকো এসেছেন সঙ্গে তাঁর গাড়িতে এসেছেন উপদেষ্টা আবু মুসা হাসান ও  নিলুফা ইয়াসমীন হাসান।

সারপ্রাইজ ছিল সুদূর পশ্চিম লন্ডন থেকে গেটউইক বিমানবন্দরে সবাইকে সি অফ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন সাবেক সভাপতি গৌস সুলতান। তাঁকে কাছে পেয়ে সবাই যারপরনাই খুশি হয়েছেন।

যথাসময়ে রাত সাড়ে আটটায় আমরা ইনফিদা হ্যামামেট বিমানবন্দরে পৌঁছেছি। বিমানবন্দর থেকে শার্টল বাসে করে আমাদের জন্য নির্ধারিত সমুদ্রের কোলঘেঁষা মনোরম সুন্দর হোটেল আল মুরাদি হ্যামামেটে এসে পৌঁছায়। ইয়াসমিন হ্যামামেট একটি ঐতিহ্যবাহী উপকূলীয় শহর। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সূক্ষ্ম সাদা বালি এবং স্ফটিক-স্বচ্ছ জল এ সামুদ্রিক ছিটমহলটিকে এর প্রকৃতির দ্বারা আকৃষ্ট করে রেখেছে। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে লবিতে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মধুর আড্ডা। সারা দিনের ভ্রমণের ক্লান্তি কাউকে কাবু করতে পারেনি। যে তিন রাত হোটেলে ছিলাম, সারা দিন ঘোরাঘুরি শেষে রাতে জমত মধুর আড্ডা। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে গান, কবিতা, নাচ, কৌতুক কোনোটাই বাদ যায়নি। সবার ভেতর যে এত সুপ্ত প্রতিভা আছে, একসঙ্গে তিউনিসিয়া ভ্রমণে না গেলে জানা হতো না।  

]সমুদ্রের মিষ্টি গর্জনে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে সমুদ্রপাড়ে  প্রাতর্ভ্রমণ সেরে নাশতার টেবিলে চলত আরেক দফা আড্ডা। এরপর সমুদ্রে স্নান, হোটেলের পুলে সাঁতার কাটা হতো প্রতিদিন। সবার সুন্দর স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো বেশির ভাগ নিজের ক্যামেরায় বন্দী করেছেন এম কিউ হাসান। দলের সাহসী সদস্য জাফর, মিজান, রিপন, কনক ও এম কিউ হাসান সমুদ্রের ওপরে বেলুনে আকাশে উড়েছেন (পেরাগলেন্ডিং), কোয়াড বাইক চালিয়েছেন। এম কিউ হাসান আরও কয়েকজন বোটের যাত্রীসহ ভূমধ্যসাগরে সাঁতার কেটেছেন। এরপর প্রতিদিনই একসঙ্গে গাড়িতে চড়ে হইচই করতে করতে, গান গেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করেছেন সবাই। হোটেলের পাশে মদিনা বাজারে প্রিয়জনের জন্য উপহার, স্যুভেনির কিনেছেন।

তিউনিসিয়া থেকে ফিরে এসে সবার প্রায় একই বক্তব্য, সমুদ্রে সাঁতার কাটা, গভীর রাত পর্যন্ত হোটেলের লবিতে সবাই মিলে নাচ, গান, কৌতুক আড্ডায় মধুর সময় কেটেছে; যার ঘোর এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এই আনন্দের রেশ থাকবে বহুদিন।

তিউনিসিয়ার সরকারি নাম তিউনিসীয় প্রজাতন্ত্র। উত্তর আফ্রিকার উপকূলে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। দেশটির মধ্য দিয়ে এটলাস পর্বতমালা চলে গেছে। ধারণা করা হয় যে তিউনিস নামটি বার্বা‌র জাতির ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘শৈলান্তরীপ’ অথবা ‘রাত কাটানোর স্থান।’

রাজধানী তিউনিসে দুটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চনাটক মিলনায়তন আছে।

হলিউডের অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে এ শহরে। জুলাই মাসে কার্থেজে গ্রীষ্মকালীন উৎসব হয়, যেটি বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। তিউনিস শহরটি ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৬ সালে তিউনিসিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের পরে শহরটিকে দেশের রাজধানী বানানো হয়।

তিউনিস শহরটি দুই ভাগে বিভক্ত। শহরের কেন্দ্রের প্রাচীন প্রাচীরবেষ্টিত মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকাটির নাম তিউনিসের মদিনা; এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। পুরোনো শহরের রাস্তাগুলো সংকীর্ণ এবং আঁকাবাঁকা। এখানে জমকালো মসজিদ আছে। মদিনার পূর্ব পাশ থেকে সমুদ্রদ্বার অতিক্রম করলে শুরু হয় আধুনিক বা ইউরোপীয় তিউনিস শহর, যাকে ভিল নুভেল নামেও ডাকা হয়। নতুন তিউনিসের ভেতর দিয়ে চলে গেছে বিশাল হাবিব বুরগিবা রাজপথ বা অ্যাভিনিউ। এ রাজপথের ওপরে ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলের অনেক ভবন অবস্থিত, যেগুলো প্রাচীন ক্ষুদ্রতর স্থাপনাগুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কৃষিকাজ এখানকার অর্থনৈতিক উপার্জনের মূল উৎস। এখানে মূলত জলপাই ও খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়, খেজুর ও রসাল কমলার জন্য বিখ্যাত। তিউনিসিয়া কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে একটি, যা আইনগত বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করেছে। সেখানে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতেও নারী–পুরুষের সমান অধিকার।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]