শিশুশিক্ষার ভবিষ্যৎ: নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
বিশ্বজুড়ে শিশুশিক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতি দেখা যায়, যা প্রতিটি দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তবে সব দেশেরই একটি সাধারণ লক্ষ্য থাকে—শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করা এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যা তাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শিশুদের প্রস্তুত করতে সহায়ক। ফিনল্যান্ড, জাপান ও সুইডেনের মতো দেশগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশেও শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে, যাতে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারে।
এখন প্রশ্ন, আমরা কীভাবে শিশুশিক্ষাকে মানসম্পন্ন করব—মুখস্থ করে শেখা, করা থেকে শেখা নাকি দেখা থেকে শেখা?
শিশুরা সাধারণত করা থেকে শেখা (হ্যান্ডস-অন লার্নিং) পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করে। শিশুরা যখন নিজেরা হাতে কাজ করে শেখে, তখন তারা শুধু তত্ত্বগত নয়, বরং বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান করতেও দক্ষ হয়।
অন্যদিকে দেখা থেকে শেখা (অবজারভেশন–বেজড লার্নিং) শিশুরা তাদের পরিবার, সমাজ ও আশপাশের ব্যক্তিরা কীভাবে আচরণ করেন, তা থেকে শিখতে পারে। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী শিক্ষাপদ্ধতি। কারণ, শিশুরা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই পরিবেশের আচরণগুলো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। দুর্নীতি, অসততা ও নেতিবাচক আচরণ শিশুদের সামনে যখন প্রদর্শিত হয়, তখন তারা সহজেই সেটিকে গ্রহণ করে এবং সেটাকে সঠিক বলে মনে করতে শুরু করে।
তা ছাড়া মুখস্থ শেখার একটি প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তত্ত্বগত বিষয়গুলো মুখস্থ করতে বাধ্য হয়। তবে এই পদ্ধতি বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে সহায়ক নয়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীতে সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, এখানে শিশুরা স্বাধীন চিন্তা করতে এবং সৃজনশীল হতে উৎসাহিত হয়। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর ওপর পরীক্ষার চাপ কমিয়ে দিয়ে প্রকৃতির মধ্যে শিখতে দেয়। শিশুদের কৌতূহল এবং স্বাধীনতা দিয়ে তাদের শেখার ইচ্ছাকে উসকে দেওয়া হয়। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিশুরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিখতে পারে এবং তারা নিজেদের আগ্রহ অনুযায়ী শেখার বিষয় বেছে নিতে পারে।
জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে ফিনল্যান্ডের বিপরীত হলেও সমানভাবে কার্যকর। সেখানে শিশুদের প্রাথমিকভাবে শিষ্টাচার, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং সম্মানের বিষয়গুলো শেখানো হয়। নৈতিক শিক্ষা জাপানের স্কুলগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীরা শেণিকক্ষ ও বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা মেনে চলে, যা পরবর্তী জীবনে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি করে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে।
মন্টেসরি পদ্ধতি শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে আরেকটি দারুণ উদাহরণ। এখানে শিশুরা স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করতে শেখে এবং শেখার পুরো প্রক্রিয়াটি তাদের কৌতূহল ও স্বাভাবিক বিকাশের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই পদ্ধতিতে শিশুরা নির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরে গিয়ে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ পায়, যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল চিন্তাকে উন্নত করে।
সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থা ফিনল্যান্ডের মতোই। শিশুদের ওপর পরীক্ষার চাপ কম এবং স্বাধীন চিন্তা ও সৃজনশীলতা বিকাশের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুরা প্রকৃতির মধ্যে শিখতে পারে এবং তারা বিদ্যালয়ে এমন পরিবেশ পায়, যেখানে খেলাধুলা, প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সমন্বিতভাবে ঘটে। এখানে শিশুরা নিজেদের গতিতে শিখতে পারে এবং নিজেদের প্রাকৃতিক কৌতূহল অনুসরণ করে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থায় আরেকটি বিশেষত্ব হলো প্রাথমিক পর্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। পরীক্ষার চেয়ে শিশুদের মধ্যে সততা, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার শিক্ষা দেওয়া হয়। এটি বাংলাদেশে কার্যকর হতে পারে, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা এখনো সনদ ও পরীক্ষার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে মুখস্থ শেখা একটি প্রচলিত পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থীরা তত্ত্বগত বিষয়গুলো মুখস্থ করতে বাধ্য হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পরীক্ষা ও সনদনির্ভরতা। একই সঙ্গে শিশুরা তাদের পরিবার, সমাজ ও আশপাশের ব্যক্তিদের থেকে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা শিখতে পারে। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী শিক্ষাপদ্ধতি। কারণ, শিশুরা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই পরিবেশের আচরণগুলো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। দুর্নীতি, অসততা এবং নেতিবাচক আচরণ শিশুদের সামনে যখন প্রদর্শিত হয়, তখন তারা সহজেই সেটিকে গ্রহণ করে এবং সেটাকে সঠিক বলে মনে করতে শুরু করে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সামাজিক দুর্নীতি ও অশুভ প্রভাব প্রচলিত, সেখানে শিশুদের এই ধরনের শেখা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি, অসততা ও নৈতিক অবক্ষয় একটি বড় সমস্যা। শিশুদের চারপাশের পরিবেশ যখন দুর্নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন তারা সেই নেতিবাচক প্রভাবের অংশ হয়ে ওঠে। দেখা থেকে শেখা তাদের জন্য একটি নেতিবাচক শিক্ষার পদ্ধতিতে পরিণত হয়। তারা মনে করে, অসততা এবং অনৈতিক আচরণ জীবনের স্বাভাবিক অংশ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শিশুদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হয়, তবে শিক্ষার পাশাপাশি সমাজকেও নৈতিকভাবে উন্নত হতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যা শিশুরা তাদের পরিবার, স্কুল ও সমাজের মাধ্যমে শিখতে পারে। নৈতিক মূল্যবোধ, সততা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ শিশুদের মধ্যে শুরু থেকেই গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা দুর্নীতিমুক্ত এবং নৈতিকভাবে সঠিক সমাজের অংশ হতে পারে।
ভবিষ্যতের পরিকাঠামোর জন্য ফিনল্যান্ড, জাপান ও সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থার উদাহরণ থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি, তা হলো শিক্ষাকে একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, শিশুদের সৃজনশীলতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করে শেখানো দরকার।
বাংলাদেশে শিশুশিক্ষার উন্নয়নে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যা নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীল শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে হবে।
নিচে বাংলাদেশের জন্য কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো—
১. শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব
শিশুরা যাতে সৎ, আদর্শবান ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে, সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরিবার, স্কুল ও সমাজে এই শিক্ষা প্রচলিত হলে শিশুরা দুর্নীতির প্রভাব থেকে দূরে থাকবে।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন
শিশুদের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তাদের শিক্ষা দেওয়া এবং সততার মূল্যবোধ শেখানো গুরুত্বপূর্ণ।
৩. প্রকৃতি ও খেলাধুলার মাধ্যমে শেখা
সুইডেনের মতো শিশুরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে এবং খেলার মাধ্যমে শেখার সুযোগ পেতে পারে, এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। এটি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক হবে।
৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন
শিক্ষকেরা যেন শুধু পাঠদাতা না হয়ে শিশুদের মেন্টর হিসেবে কাজ করতে পারে, সে জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন করতে হবে। শিক্ষকেরা যদি নৈতিক শিক্ষা এবং সৃজনশীল শেখার পদ্ধতি জানেন, তবে তারা শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে সক্ষম হবেন।
৫. প্রযুক্তি ও হাতে–কলমে শেখা পদ্ধতির সমন্বয়
শিক্ষায় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং হাতে–কলমে শিক্ষার পদ্ধতি যুক্ত করা দরকার। শিশুরা প্রযুক্তি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারে, সেটি শেখানো উচিত।
এ ছাড়া শিশুশিক্ষায় এআইয়ের ভূমিকা বর্তমান সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এআই-ভিত্তিক লার্নিং প্ল্যাটফর্ম এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ টুলস শিশুদের শেখার পদ্ধতি সহজতর করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শিক্ষার প্রক্রিয়া ব্যক্তিগতকরণ করা সম্ভব, যেখানে প্রতিটি শিশুর আগ্রহ, দক্ষতা ও দুর্বলতা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া এআই-ভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের হাতে-কলমে শেখার অভিজ্ঞতা, যেমন ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি ব্যবহার করে আরও সমৃদ্ধ করা যায়। এআই প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে, তেমনই এটি শিশুদের মধ্যে কৌতূহল ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারে। এই পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশে শিশুশিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে বর্তমানে মুখস্থ শেখা প্রচলিত পদ্ধতি।
এ ছাড়া যাঁরা এই শিক্ষাদানের কারিগর, অর্থাৎ শিক্ষকদের যদি নৈতিকতা এবং শিক্ষাদানের মৌলিক তত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকে, তাহলে সঠিক শিক্ষা প্রদান সম্ভব নয়। সুতরাং শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদেরকে প্রতিদিনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাঁদেরকে বুঝতে হবে, কী শিক্ষা প্রয়োজন, কেন তা প্রয়োজন এবং কীভাবে তা প্রদান করা হবে।
শুধু তখনই শিশুরা সত্যিকার, সুষ্ঠু ও সঠিক শিক্ষা পাবে, যা তাদেরকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এভাবে শিশুশিক্ষার মাধ্যমে একটি উন্নত, নৈতিক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]