নামে কিছু আসে যায়?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

২০১৫ সাল। জার্মানি।

আমার এক সহকর্মী ই–মেইল করলেন, অফিসে সবকিছুতে তাঁর নাম বদলে দিতে হবে।

তিনি বিয়ে করেছেন, তাই আগের পদবি বদলে নতুন পদবিওয়ালা নাম নিয়েছেন।

ফেসবুকে সহজে নাম বদলানো যায়, কিন্তু অফিসের কিছু সফটওয়্যার আছে, যেগুলোয় ব্যবহারকারীর নাম–নিবন্ধিত লাইসেন্স কিনতে হয়।

আমার সহকর্মীর নাম বদলাতে সফটওয়্যারটির লাইসেন্স নতুন করে কিনতে হবে।

বিল এল ৫০ হাজার টাকার মতন।

ঝামেলা বাঁধল, নিজের নাম বদলানো সহকর্মীটির একান্ত ব্যক্তিগত শখ। তাঁর শখ মেটাতে ৫০ হাজার টাকা কোম্পানির কোন খাত থেকে খরচ হবে?

অনেক আলোচনা হলো। শেষমেশ বস তাঁর বাজেটের একটি বিশেষ খাত থেকে অর্থ অনুমোদন করলেন।

২০০৪ সাল। বাংলাদেশ।

‘আমাদের কোম্পানির নিয়ম হলো, সবার আইডি কার্ড যেন সব সময় দৃশ্যমান থাকে। এতে অফিসের নিরাপত্তা ও ডেকোরাম নিশ্চিত হয়। জিজ্ঞেস না করেও আইডি কার্ড দেখেই নাম ও পদবি বুঝে নেওয়া যায়।’—মানবসম্পদ বিভাগের এক কর্মশালায় আমরা যাঁরা নতুন যোগদান করেছি, তাঁদের কড়া করে বুঝিয়ে যাচ্ছেন সেই বক্তা।

সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পার করে আমার জীবনের প্রথম স্থায়ী চাকরি।

শরীর-মন থেকে তখনো ছাত্রজীবন পুরোটা ধুয়ে চলে যায়নি।

সবাইকে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাইয়া’ কিংবা ‘আপু’ মনে হয়।

আমি হাত তুললাম।

আমার প্রশ্ন, ‘ভাইয়া, তাহলে মিটিংয়ে যাই কিংবা মধ্যাহ্নভোজনে; আইডি কার্ড সব সময় সামনে ঝুলিয়ে রাখতে হবে? যেন সবাই আমার নাম জানতে পারেন?’

‘অবশ্যই। এই নিয়ম পালনের ব্যাপারে কোম্পানি খুব শক্ত।’—বক্তা নাক উঁচু করে বলে গেলেন।

‘ভাইয়া, আপনার নামটা জানতে পারি কী? আর আপনার পদবি কী?’—আমার সম্পূরক প্রশ্ন।

বক্তা হতভম্ব আমার প্রশ্ন শুনে।

‘আমি এই কোম্পানির মানবসম্পদের প্রধান। তুমি আমার নাম জানো না???’—তিনি রাগে কাঁপছেন।

আমি শান্ত গলায় জানালাম, ‘ভাইয়া, কী করে জানব? আপনি তো আপনার আইডি কার্ড সামনে ঝুলিয়ে রাখেননি।’

তাঁর রাগের বেলুন ফুটো হয়ে চুপসে গেল। তৎক্ষণাৎ পকেট হাতড়ে বললেন, ‘ওহঃ !! বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ওটা পকেটে রেখেছিলাম আর সামনে ঝোলানো হয়নি।’

এর পর থেকে তিনি আমার নাম কখনো ভোলেননি।

২০১৩ সালের কথা। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে এক দম্পতি রওনা দিলেন আফ্রিকা মহাদেশের সেনেগালে।

ইস্তাবুলে বিমান বদল করে পরের বিমানে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা।

বিমান অবতরণের পর তাঁরা অবাক, এটা কোথায়?

তাঁদের ইস্তাবুল থেকে ভুল বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তাঁরা যেতে চেয়েছিলেন সেনেগালের রাজধানী ‘ডাকারে’ (Dakar), কিন্তু নেমেছেন সাড়ে এগারো হাজার কিলোমিটার দূরে, ‘ঢাকা’য়।

ট্রানজিটের সময় গন্তব্যের নাম ‘ডাকার’ বলেছিলেন, ইস্তাবুলের কর্মকর্তারা বুঝেছিলেন যে তাঁরা ‘ঢাকা’ যাবেন। সেই থেকেই এই ভুল যাত্রা।

পরে তাঁদের আরেকটি ফ্লাইটে করে আবার ইস্তাবুল পাঠানো হলো।

জার্মানিতেও এ রকম ভুল হতে পারে। সবাই যে ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট’ চেনে, সেটার পুরো নাম হলো ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন’—মাইন নদীর তীরে এ এক আধুনিক মেট্রোপলিটন সিটি।

আরও একটি ফ্রাঙ্কফুর্ট আছে, পুরো নাম ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট আন ড্যার ওডার’। ওডার নদীর তীরের এক ছোট্ট শহর।

জার্মানিতে এসে ট্রেনের টিকিট কেনার সময় ভালোমতো বলবেন কোন ‘ফ্রাঙ্কফুর্টে’ যেতে চান। ভুল করলে ৫৩৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কোথাও নামবেন!

যাঁরা ‘ঢাকা’য় বেড়াতে যেতে চান, জেনে রাখুন, বাংলাদেশের বাইরে ‘ঢাকা (Dhaka)’ নামে আরও একটি শহর আছে ভারতের বিহারে নেপালের সীমান্ত ঘেঁষে।

কোনো পণ্যের ব্র্যান্ডের ‘নাম’ পণ্যটির গুণগত মান নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলায় মা বাজারে পাঠালেন দেশলাই কিনতে চুলা জ্বালানোর জন্য। তখন ঘরে ঘরে ‘প্রজাপতি’ ব্র্যান্ডের সুনাম।

দোকানে গিয়ে দেখলাম ‘প্রজাপতি’-এর অর্ধেক দামে প্রায় একই রকম দেখতে অন্য দেশলাই বিক্রি হচ্ছে। নামগুলোও খুব কাছাকাছি, একদম ‘প্রজাপতি’-র মতন করে লেখা: ‘গণপতি’, ‘সেনাপতি’, ‘রণপতি’, ......।

আমি কিনলাম কোনো একটা ‘...পতি’, দিলাম বাসার দিকে গতি।

বাসায় দেখা গেল অর্ধেকের মতো দেশলাই জ্বলে না।

কোনোটি ঘষার আগেই দপ করে জ্বলে ওঠে! আঙুল পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ আমার শিক্ষা পর্ব চলল, কীভাবে ঠিক মতন ‘প্রজাপতি’ নামটি বানান করে পড়তে হয়।

পণ্যের ব্র্যান্ডের নাম পড়তে আর কখনো ভুল করিনি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার ‘এলপি’ শর্মিষ্ঠার জন্য উপহার কিনতে গেছি কসমেটিকসের দোকানে, ওর পছন্দের ব্র্যান্ডের পারফিউম কিনব।

জার্মান ও ইংরেজি মিশিয়ে বললাম, ‘ইশ মোশটে “গিফট” কাউফেন (আমি চাই গিফট কিনতে)।’

দোকানের স্টাফরা অবাক হয়ে তাকাল, ‘কার জন্য?’

আমার উত্তর, ‘আমার বউয়ের জন্য।’

ওরা ফিসফিস শুরু করল।

আমি তখন যে পারফিউমটি কিনতে এসেছি, তার ব্র্যান্ডের নামটিও স্পষ্ট করে বললাম।

এবার মনে হলো ওরা পুলিশকে ডাকা নিয়ে কিছু আলোচনা করছে।

চিন্তার বিষয়! দেরি না করে বাসায় দ্রুত চলে এসেছি।

শর্মিষ্ঠাকে জানালাম যে ওর জন্য গিফট কিনতে গিয়েও কিনতে পারিনি।

কিছু বলল না। ওর ধারণা, সবই আমার কৃপণতার কৌশল। দামি পারফিউম না কেনার বাহানা।

বাসায় বসে ভাবছি, ‘গিফট’ কিনতে গিয়ে এমন ঝামেলা হলো কেন?

গুগল করে জানলাম, ‘গিফট’ একটি জার্মান শব্দ। এর অর্থ হলো ‘বিষ’।

ঘটনা আরও জটিল হলো তখন, যখন পারফিউমের ব্র্যান্ডের নাম বলেছিলাম, ‘পয়জন (Poison)।