থ্যাংকস গিভিং ডে, ২০২৪
১৬২০ সালে ইংল্যান্ড থেকে মে ফ্লাওয়ার জাহাজে চেপে ১০২ জন মানুষ স্বাধীন ধর্মচর্চার জন্য অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তাঁরা ম্যাসাচুসেটস বে–তে এসে থামেন, ক্লান্ত বা অসুস্থ। যাঁরা সুস্থ ছিলেন, তাঁরা তীরে নেমে প্লিমথ নামে একটি গ্রাম গড়ে তোলেন। স্কোয়ান্ত নামের একজন আমেরিকান–ইন্ডিয়ান তাঁদের মাছ ধরা, কর্ন চাষসহ নিত্য প্রয়োজনে বেঁচে থাকার উপায় শিখিয়ে দেন। ১৬২১ সালে কর্নের ফলন এত বেশি হয়েছিল যে গভর্নর উইলিয়াম প্লিমথ আদিবাসীসহ সবার সৌজন্যে ভুরিভোজনের আয়োজন করেছিলেন। বনমোরগ (টার্কি), ম্যাশটড পটেটো (আলু), কর্নসহ স্রষ্টাকে সুস্থতা, খাবার এবং বন্ধুত্বের কৃতজ্ঞতা জানানোর অনুষ্ঠানের সেই শুরু।
১৮৬৩ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন থ্যাংকস গিভিং ডেকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রতিবছর নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে এ দিন পালন করা হয়। আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে চমৎকারভাবে এ দিনটি পালন করা হয় জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে।
টার্কি খেয়ে অভ্যস্ত না বলে এ বনমোরগ আমাকে কখনোই খুব একটা মুগ্ধ করেনি। তবে ছুটির আমেজ, উৎসব মুখর পরিবেশ সব সময় ভীষণ মুগ্ধ করে। শীত এখন প্রায় আসি আসি করছে। ভীষণ অসুস্থ একজন বৃদ্ধ রোগী পেলাম সেদিন। যতকিছুই করা হোক, কিছুতেই তিনি সুস্থ হচ্ছেন না। তাঁর বউ আমাকে প্রথম দেখাতেই বললেন আমরা বিবাহিত ৭০ বছর ধরে। তুমি যেভাবে পার তাঁকে সুস্থ করে তোল। সে পুরোটা টার্কি তেলে ভেজে ভীষণ মজার টার্কি ডিশ তৈরি করে। আমাদের এত বছরের থ্যাংকস গিভিংয়ের রেওয়াজ নষ্ট করা যাবে না। আমি তাঁকে রোগসংক্রান্ত আপডেট দিলাম। বিকালে রুগীকে দেখতে আবার গেলাম। তারপর ভদ্রমহিলার সঙ্গে বসলাম। বললাম, আমার রোগী ভাল নেই, আমাদের হাত–পা বাঁধা। তিনি মনে হয় না আর কখনোই টার্কি বানাতে পারবেন। তিনি অনেক রাগ করলেন, বললেন, ‘আমি কোন কথা শুনব না। ভাল কিছু থাকলে বল।’
শীতের রাত, কোথাও কোথাও ক্রিসমাসের আলোক সজ্জা শুরু হয়েছে। গেট দিয়ে আমার কমিউনিটিতে ঢুকে দেখি গাছের গোড়ায় ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের আলোক সজ্জা। এত সুন্দরের মধ্যে মনটা ভীষণ খারাপ হয়েই থাকল। পরের দিন রোগীকে দেখতে গেলাম। সময়টা থ্যাংকস গিভিংয়ের দুই দিন আগে। রোগীর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আমি বললাম, ম্যাম তোমার সব আত্মীস্বজনকে খবর দাও। আমাদের হাতে অনেক বেশি সময় নেই। বিকেল নাগাদ দেখি হাসপাতালে রোগীর রুম তাঁদের ভালবাসার ৭০ বছরের নানা স্মৃতির ভালবাসাময় ছবি দিয়ে সাজানো। ভদ্রমহিলা তাঁর নাতনিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করে দিতে নিয়ে এসেছেন।
আমি একটু শঙ্কিত। রোগীর অবস্থা ভালো না। দেখি ঝকঝকে চোখের নীল নয়না আমাকে বলছেন, তোমার মতো এ রকম ডাক্তার আমাদের অনেক দরকার। চলে যাবার আগে বিদায় জানানোর সময়টুকু আমার জন্য খুব জরুরি ছিল। সত্যি কথা বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। পর দিন সকালে প্রায় ১৫–১৬ জন রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিটিং করলাম। তাঁরা রোগীর জীবনের শেষ সময়টুকু তাঁকে কষ্ট কমিয়ে কমফোর্ট কেয়ারে দিতে চান। ব্যথানাশকসহ সব ওষুধ অর্ডার দিলাম। যত অপ্রয়োজনীয় আয়োজন বন্ধ হলো। রোগী থ্যাংকস গিভিংয়ের দিনই মারা যান।
পুত্র কন্যাসহ ছোট্ট আয়োজনে ভীষণ ভালো আনন্দময় একটা ডিনার করেছি আমরা বাংলাদেশি রীতিতে। আমি স্বাস্থ্য, সন্তান আর জীবনের সব প্রাপ্তির জন্য আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। ৭০ বছরের ভালোবাসার সমাপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকা একজন অজানা ভদ্রমহিলার জন্যও অনেক দোয়া করলাম। দোয়া করলাম আমার প্রাণের দেশের জন্য, দেশটা শত্রুমুক্ত থাকুক, সমৃদ্ধি নিয়ে ভালো থাকুক।