জীবনের আলপনায় শেষ ছবি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সিডনি ওভারসিজ প্যাসেঞ্জার টার্মিনালে সেদিন, একটা বিষয় নিয়ে গ্রাউন্ড স্টাফরা নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করেছে। হুইল চেয়ারে বসা এক নারী তাঁর স্বামীসহ ক্রোজিংয়ে যাবেন। এই নারীকে ঘিরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৫ জন। জানতে পারি, এ দম্পতি জাহাজে যাচ্ছেন। অন্যরা এসেছে বিদায় জানাতে।

আমার কাজ হচ্ছে যাত্রীদের বুকিং নম্বর অনুসারে স্পিকারে ঘোষণা দেওয়া এবং টার্মিনালের ভেতর পর্যায়ক্রমিক সাজানো চেয়ারে তাদের বসতে দেওয়া। এক সুযোগে এ দুই যাত্রীর বিষয়ে জানার সুযোগ হয়।

হুইল চেয়ারে বসা এই নারী মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী এই সমুদ্র যাত্রা। জগতে চিরকাল কেউ বেঁচে থাকে না। মানুষ একদিন মরেই যায়। বয়সের ভারে নত হয়ে সুস্থ মানুষটাকেও একসময় মরতে হয়। আর মরণব্যাধীতে ধরলে তো কথাই নেই। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে শুধু স্বামীকে নিয়ে এই নারী যাচ্ছেন সমুদ্র ভ্রমণে। জীবনের শেষ সময়গুলো একান্তে উপভোগ করতে চান। আমার কাছে মনে হচ্ছে, এ আবার কেমন যাত্রা! বেশ কিছুক্ষণ ভেবেও কোনো কূল পাচ্ছি না। দেখি, বিদায় জানাতে আসা অনেকের চোখেই জল।

বুকিং কনফার্মেশন নিয়ে এক এক করে জড়িয়ে ধরে সবাই তাঁকে বিদায় জানাচ্ছে। এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এবার উপস্থিত সবার চোখ ভিজে এল। কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে পড়ি। পরপারের সব আত্মীয়স্বজনকে একে একে মনে পড়তে থাকে। কখন যে চোখের জলে বুক ভিজে গেছে জানি না। তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলে এই পরিবারটার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করি। আমার ভাগ্য ভালো, মানুষগুলো খুবই বন্ধুসুলভ। এ নারীর ছোট ছেলের সঙ্গে কথা হয়। তার নাম স্টিফেন। সে বলল—

মায়ের শেষ ইচ্ছা, তিনি চান না তাঁর মৃত্যুর সময় কেউ সামনে থাকুক, তাঁর মৃত মুখ কেউ দেখুক। তিনি আমাদের মধ্যে যেমন উজ্জ্বল ছিলেন, স্মৃতিতেও উজ্জ্বল থাকতে চান। এ যে আমাদের সবার সামনে বিদায় নিয়ে তাঁর এই চলে যাওয়া, এটাই তিনি তাঁর শেষ স্মৃতি হিসেবে রেখে যেতে চেয়েছেন। এভাবেই তিনি জাহাজে ঢুকে পড়বেন। মাকে দেখা শেষ স্মৃতি বলতে আমাদের মনে এই দৃশ্যটুকুই বাঁধাই হয়ে থাকবে। মা আমাদের মধ্যে এমন করে বর্তমান থাকতে চান। তাঁর ডেডবডি এই টার্মিনালে আসবে। ফিউনারাল কর্তৃপক্ষ এসে লাশ নিয়ে যাবে। সেখানে আমরা কেউ থাকব না।

আমি মুগ্ধ হয়ে স্টিফেনের কথা কেবল শুনেই যাচ্ছি। এই পর্যায়ে বললাম,, আচ্ছা স্টিফেন, তোমার বাবা যখন ফিরে আসবেন, তার সঙ্গে কোনো একদিন আমি কিছুক্ষণের জন্য দেখা করব। সেটা কি সম্ভব?

হ্যাঁ, সম্ভব। মরোবরা সমুদ্র পারে আমরা ভাই-বোন সবার বাড়িগুলো কাছাকাছি। রবিবার আমরা সবাই মা-বাবার পাশে একত্র হই। সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই হাসি-আনন্দে কাটিয়ে পরে চলে আসি। এখন থেকে তো মা আর থাকবেন না...

স্টিফেনের কণ্ঠ জড়িয়ে এল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক ভরা পূর্ণিমার সন্ধ্যায় স্টিফেনের বাবা রবার্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাঁর জীবনকাহিনিটা এ রকম—

তাঁদের পরিচয় হয় প্রাইমারি স্কুলে। একই সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হওয়া, ছোটবেলায় ছোট ছোট কমিটমেন্ট, ধীরে ধীরে বড় হওয়া, পরিণতি পাওয়া। কী এক আন্তস্রোতের মতো মন দেওয়া-নেওয়া, জীবনের এই পর্যায়ে এখন তাঁর ঘটনাগুলোকে পর্যায়ক্রমিক সাজাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে এলোমেলো হয়ে যায় যেন। আবার কখনো মনে হয় কত স্পষ্ট সব। এইচএসসির পরপরই মেরির মা হতে যাওয়া। দুদিকেই মা-বাবার কাছে আমরা অনিরাপদ বোধ করি। তারপর সরকারি হাউজিংয়ে আমরা বাসা পাই। একটা ফাস্টফুড শপে শনি-রবিবার দুদিন চাকরি শুরু করি। মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগে আমরা দুই সন্তানের মা-বাবা। এভাবেই একে একে আটটা সন্তানের মা-বাবা হই আমরা। সন্তানগুলো এ পর্যন্ত আমাদের কোনো অভিযোগ করেনি। ওদের মায়া-মমতা, সমবেদনা, সহমর্মিতা ছাড়া সামান্যতম মান-অভিমানও দেখিনি। ছোটবেলাতেই আমি ওদের ভায়োলিন বাজানো শিখিয়েছি। আমাদের এই ছোট্ট লাইব্রেরিটাতে পৃথিবীর খ্যাতিমান লেখকদের বই রয়েছে। বুদ্ধি ও চেতনার অধিকারী এই মানুষ যেমনটি হওয়ার, আমি আমার পরিবারে সেটাই দেখেছি। জীবন ও প্রকৃতির সমন্বয়...

এই পর্যায়ে তিনি কিছুটা সময় থেমে গেলেন। এদিকে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি বাকিটা শোনার জন্য। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করলেন—

এই এমন জোছনা রাতে আমরা সাগরপারে জলের খুব কাছে, ঢেউগুলো যেখানে এসে শেষ হয়, সেখানে বসে থাকতাম। চাঁদের পানে চেয়ে থাকা। ঢেউয়ের সুর। রাতের পাখি। আমাদের ভালো লাগা। জীবনে যা চেয়েছি, তা পেয়েছি। অতৃপ্তি বলে কিছু নেই।

জি, জীবনের শেষ সময়গুলো কি ওনার মতো আপনিও...

না না, সে তো আমার চোখের সামনে চলেই গেছে। এখন এই সন্তানগুলোই তার রেখে যাওয়া সবচেয়ে বড় স্মৃতি। আমার চারপাশ ঘিরে থাকবে আমার সন্তানরা। এখানেই আমার সুন্দর।

জি।

খুব সম্ভব তিনি আমার চোখের জিজ্ঞাসা পড়তে পেরেছেন।

জি, টার্মিনালে সবার কাছে বিদায় নিয়ে জাহাজে প্রবেশের পর থেকে সমস্ত ঘটনা গোপন রাখতে আমাকে অনুরোধ করে গেছে। জীবনের ব্যস্ততায় যে কথাগুলো বলা হয়নি, তা শেষ বেলায় সে বলে গেছে।

সবিনয়ে অনুরোধ করে বললাম, ওনার শেষ সময়ের দু-একটা কথা যদি বলতেন।

রবার্ট কী এক আকুতিময় দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন কেবল। ওদিকে শোনা যাচ্ছে সাগরের গর্জন। সন্ধ্যা গড়িয়ে তখন রাত। জোছনা ক্রমেই বিকাশ করে চলেছে আপনার রূপ।

এই নির্জন একা পথে তাপমাত্রা তখন দুই ডিগ্রি। সম্মুখে সাগরের উত্তাল হিমশীতল জলরাশি। ঢেউয়ের শরীরে জোছনার ফুল। চাঁদের বাসর। কখনোবা মুছে যাওয়া কোনো এক কিশোরীর বুক। মরণ এক অজানা পুরির প্রবেশদ্বার। তাই মরণে মানুষের এত ভয়। ওই নিগূঢ় অজানায় পাড়ি দেয়া এত সুন্দর! এত শিল্পময়! ওই অজানাকে এমন শিল্প-সুন্দর উপলব্ধিতে আনতে পারছি না যে! তা ভেবে হয়তো আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। অথবা ভয় নয়, আশ্চর্য এক বিস্ময়! হয়তো উনি মরণকে বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি শুধু মরতে হয় বলে মরণ-গতানুগতিক এই চক্র থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বিশ্বময় এসব বৈচিত্র্যের মাঝেই বিরাজে আমার আনন্দ সুন্দর।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]