ভাত–কাপড়ের শিক্ষা এবং দেশপ্রেম: ঐতিহ্য বিশ্বাসঘাতক ও ক্ষমতায়ন
আজকের লেখাটি আমি আনেক দিন ধরে লেখার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না! ভাত-কাপড়ের শিক্ষা থেকে কীভাবে বিশ্বাসঘাতক তৈরি হচ্ছে, তার জন্য আমার শিরোনামে থাকা চারটি কনসেপ্ট বা ধারণা যুক্ত করতে হয়েছে, যেটা ছিল কষ্টসাধ্য! আজকের শুরুটা করতে চাই আমার স্কুল দিয়ে, যেখানে আমাদের শিক্ষার শুরু এবং বেড়ে ওঠা। আমাদের স্কুলের নাম করোপনেশন স্কুল, যেটি খুলনা বিভাগের অন্যতম নামকরা সরকারি স্কুল।
আমাদের স্কুলে যারা দশের মধ্যে থাকত, তাদের অডিটরিয়ামের ভেতর একটা মঞ্চে তুলে দেওয়া হতো। যারা একবার মঞ্চে উঠে যেত, তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে পরে দূরত্ব রেখে চলত। উপরন্তু, তাদের স্কুলে নিয়ে আসা অভিভাবকেরাও অন্য অভিভাবক থেকে কিছুটা সরে দাঁড়াতেন। কিছু অভিভাবকের ভাবভঙ্গি রীতিমতো দৃষ্টিকটু ছিল। তাঁরা নিখাদ চোখে অন্য মেয়েদের বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা ও চাকরি-বাকরি যাচাই করে তবেই নিজের মেয়েটিকে মিশতে দিতেন। বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, শিক্ষকেরা এই অভিভাবকদের আলাদা তোয়াজ-খাতির করতেন, যাতে তাঁদের মেয়েটি ওই শিক্ষকদের বাসায় পড়তে যায়। কারণ, ওই মেয়েটি তাঁদের কাছে পড়তে গেলে অন্যরাও তাকে অনুসরণ করবে।
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন সেখানেও ঠিক ব্যতিক্রম কিছু দেখলাম না। আমাদের বিভাগে যে দুটি ছেলে যৌথভাবে প্রথম হতো, তারা অন্যদের সাথে ন্যূনতম কুশল বিনিময় পর্যন্ত করত না। তারা একটা নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে আসত এবং নির্দিষ্ট চেয়ারে বসত। ক্লাস শেষ হওয়ার পরে কেউ তাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা চোখ শীতল করে একটা বিকৃত হাসি দিত, যেন অচ্ছুত কেউ তাদের সামনে এসেছে! আমি ঠিক গল্পটা এখান থেকেই শুরু করতে চাই, যেটার নাম হচ্ছে এলিটিজম বা অভিজাততন্ত্র। “Eilitism”: Elites emerge as a consequence of layers of hierarchical relationships between small groups that control resources and other groups that cannot control resources (অভিজাততন্ত্র: সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী ছোট গোষ্ঠী এবং সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এমন অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে স্তরবিন্যাসগত সম্পর্কের একটি ফলাফল হিসেবে অভিজাতদের আবির্ভাব ঘটে (হরিয়ান্তো, ২০১৭)।
কোনো দল বা মানুষ যখন তথাকথিত এলিট বা অভিজাত হয়ে যান, তখন তাঁরা সাধারণ মানুষের সাথে দূরত্ব তৈরি করেন, যাতে তাঁদের ক্ষমতা ভোগ ও মালিকানা নিয়ে কোনো বাদ-বিবাদের সুযোগ না থাকে। এতে সম্প্রদায়ভিত্তিক জ্ঞানের রূপান্তর বন্ধ হয়ে যায়। যেমন শিক্ষাজীবনে ভালো ছাত্র থেকে খারাপ ছাত্রদের মধ্যে যে জ্ঞান বিতরণ হওয়ার কথা ছিল, সেটা বাধাগ্রস্ত হয়। এই প্রতাপশালী ছাত্ররা যেহেতু স্বতন্ত্র জ্ঞানকে সাম্প্রদায়িক ক্ষমতায়নে রূপান্তর করতে শেখে না, সেহেতু তারা ভাত-কাপড়ের কেরানিগিরির মধ্যে নিজের আমিত্ব জাহির করে। এই কেরানিগিরি ক্ষমতায়নের পরিক্রমায় একসময় স্যার/ম্যাডাম সম্বোধন পেয়ে নিজেদের প্রতাপশালী এলিট বা অভিজাত ভাবেন এবং যখন-তখন মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমার যে বন্ধুটি কম্পিউটার প্রকৌশলী হয়েছে, সে চাইলে হয়তো মেয়েদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের প্রোগ্রামিং করে বিল গেটসকে ধাক্কা লাগিয়ে দিতে পারত অথবা যে বন্ধুটি ডাক্তার হয়েছে সে প্রজনন ক্ষমতায়নের পদ্ধতি আবিষ্কার করে মাদার তেরেসার নোবেলটি ছিনিয়ে নিতে পারত! কিন্তু না, তারা কিছু হলো না বরং নিজেদের মাথাটি কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে ভাত-কাপড় উপার্জনের কেরানি হয়ে গেল। নিজেদের ভাত-কাপড় এবং মা-বাপের ভরণপোষণের সংস্থান করতে করতে নাভিশ্বাস ওঠে তাদের। আর বাকিটা সময় কেরানি জীবনের ছবি ফেসবুকে আপলোড দিয়ে মনে করেন, বেশ ভালো আছি…।
আমার কেন জানি সস্তা কেরানি জীবন পছন্দ হলো না। তাই আমি বেছে নিলাম গবেষণার পথ, যা অনেকটা কাঁটা বিছানো কঠিন পথ। আমি পিএইচডিতে ফোকাস করলাম, যেখানে বাংলাদেশের সম্প্রদায়ভিত্তিক ক্ষমতায়নের মডেল তৈরি হবে বলে আশা করি। পিএইচডি অনেকভাবে করা যায়, কিন্তু সব থেকে কঠিন প্রক্রিয়াটি হচ্ছে নতুন থিওরি বা তত্ত্ব উদ্ভাবন। আমার অস্ট্রেলিয়ান সুপারভাইজার ছিলেন বয়সে অত্যন্ত নবীন এবং আমার থেকেও বয়সে ছোট। তিনি গবেষণা শুরু করার আগেই জানিয়ে দিলেন আমাকে সব করতে হবে। আমি রাতদিন এক করে কাজ করতে করতে প্রথম বর্ষের কনফার্মেশন সেমিনারের দুই সপ্তাহ আগে মানসিক রোগ বাইপোলারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। সবার সহযোগিতায় আবার সুস্থ হয়ে সেমিনারে সফলভাবে পাস করলাম। বদৌলতে বালি (ইন্দোনেশিয়া) আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’ জিতলাম।
আমি যখন আমার পিএইচডি গবেষণায় ক্ষমতায়নের মডেল নিয়ে লেখালেখি করছি, তখন চারদিক থেকে আবার কেরানিদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। যেমন পিএইচডি করে অনেক বড় হয়ে গেছ কি না, নিজের ঢোল নিজে বাজাও কেন, গবেষণা করে কি বাংলাদেশকে উলটায়ে দিবা নাকি? স্বভাববশত আমি কখনো এসবের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না, কিন্তু অনেক সময় নিয়ে এই ভাত–কাপড়ের স্বাচ্ছন্দ্যে তুষ্ট কেরানিদের গবেষণার আওতায় নিয়ে এলাম। ধারণাটি এমন—‘ঐতিহ্য–বিশ্বাসঘাতক’, যারা নিজেদের ঐতিহ্যকে স্বীকার করে না এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞান হস্তান্তরেও অংশগ্রহণ নেয় না। এই আচরণ বাংলাদেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ক্ষমতায়নের জন্য বড় বাধা বটে।
আমরা সবাই জানি, বাংলার ইতিহাসে মীর জাফর নামে এক বিশ্বাসঘাতক ছিল। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এখন থেকে প্রায় ২৬৮ বছর আগে ১৭৫৭ সালে। সেই থেকে তাঁর নামটি বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক হয়ে আছে এবং একধরনের গালিতেও পরিণত হয়েছে। তবে জাতিগত আবেগ ও চেতনায় মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকে এক পাশে রেখে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আর বাস্তবতা নিয়েও ভাবার অবকাশ রয়েছে। অর্থাৎ তখনকার ক্ষমতায়ন ও রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দু–একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বয়স কত ছিল? তিনি কী রাজনীতি, সমরনীতি ও দেশ পরিচালনা তথা সামাল দেওয়ার মতো পরিপক্ব বা পরিণত ছিলেন? তাঁর মতো একজন কম বয়সী নবাবের পক্ষে কি শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে মোকাবিলা করা সম্ভব কি না? আমরা এই গবেষণাটি এখনো ঠিকমতো করে উঠতে পারিনি। মীর জাফররূপী বিশ্বাসঘাতকের আগমনও থামেনি। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর থেকে এই বাংলায় বিশ্বাসঘাতকেরা জন্ম নিয়েই চলেছে। অথচ যে ইংরেজ বাহিনী সারা বিশ্বে মীর জাফর তৈরি করেছিল, তাদের কেউ বিশ্বাসঘাতক বলে না।
লেখক: শাহিদা খানম, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা