ছোঁয়া যায় না

ফাইল ছবি

হুট করে কাউকে না জানিয়ে আজ বাংলাদেশে চলে এলাম। উদ্দেশ্য, সবাইকে সারপ্রাইজ দেব। আত্মীয়স্বজন সবাই বহুদিন থেকেই দেশে আসার জন্য বলছিল। কিন্তু আসব আসব করে বিভিন্ন কারণে আর আসা হয়নি।

বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে গ্রামের বাড়িতে চলে এলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে সোজা বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাবা-মা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছিলেন। আমাকে দেখেই দুজনে চমকে উঠলেন। অবাক হলেও দুজনের চোখেমুখে ফুটে উঠল আনন্দের এক ঝিলিক। অবশ্য তা অল্প সময়ের জন্য। একটু পরই দুজনের মুখেই আমি অভিমানের রং দেখতে পেলাম। দুজনের কেউ আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর আদুরে গলায় বললাম,

-কেমন আছো মা?
মা কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবার বললাম,
-কী ব্যাপার, আমাকে দেখে তোমরা খুশি হওনি? হঠাৎ করে মুখ অন্ধকার করে ফেললে যে।
-কে তোর মা? তোর কি মা-বাবা আছে? তোর কি তাদের কথা মনে আছে?
-এটা কী বললা, মা? তোমাদের কথা মনে থাকবে না? বিশ্বাস করো মা, প্রায়ই ইচ্ছা হতো চলে আসি। তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুয়ে থাকি।
-তাহলে এলি না কেন?
-মা, আসলে পড়ালেখার পাশাপাশি কাজও তো করতে হয়। এ ছাড়া আরও কিছু ঝামেলাও ছিল। সবকিছু গুছিয়ে আসি আসি করে আর আসা হয়নি। আর তা ছাড়া আমেরিকা তো আর ঢাকা-চট্টগ্রাম না যে বাসে উঠলাম আর চলে এলাম।
-তাই বলে ছয় বছর?
-সরি মা। আমি জানি এটা ঠিক হয়নি। অন্যায় হয়ে গেছে। প্লিজ আর রাগ করে থেকো না।

-আমি রাগ করিনি বাবা। তুই তো আমার কলিজা, আমি কেন তোর ওপর রাগ করব। মনে আছে, তুই শেষবার যেদিন চলে গিয়েছিলি, আমি বাসার সামনের গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

-মনে আছে মা। আমি চোখ বন্ধ করলেই সে দৃশ্য এখনো দেখতে পাই।
-সেদিন যখন তুই চলে যাচ্ছিলি, মনে হচ্ছিল আমিও তোর সঙ্গে চলে যাই। যতক্ষণ তোকে দেখা গেছে, ততক্ষণই পেছন থেকে আমি তোকে দেখেছি। একসময় তোর বাবা বলল, ঘরে চলো, ওকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। আমি তোর বাবাকে বললাম, তুমি যাও। আমি আমার ছেলেটার পথের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকব আর কাঁদব।

মা কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদতে লাগলেন।
-জানিস, আমি আজও প্রতিদিন ওই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর জন্য কাঁদি। আর ভাবি, তুই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবি। সন্তানকে না দেখে থাকার কষ্টটা অনেক কঠিনরে বাবা।

খেয়াল করলাম, বাবা অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছেন। বুঝলাম, বাবা খুব বেশি অভিমান করেছেন। মা আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বাবাকে ডাকার জন্য বললেন। আমি বাবাকে ডাকলাম, কিন্তু উনি ঘুরলেন না। শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-কী বলবি বল। আমি শুনছি।

-বাবা, তুমি অনেক রাগ করেছ, তাই না?
বাবা কোনো কথা বললেন না। মা-ই আবার কথা বললেন,
-রাগ করবে না তো কী করবে? আমি যখন স্ট্রোক করলাম, তখন তুই এলি না। তারপর তোর বাবা মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে গেল। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পেল। মাথায় রক্তক্ষরণ হয়ে কোমায় চলে গেল। তখনো এলি না। মানুষটা কতটা দিন কোমায় পড়ে ছিল, জানিস?

-মা, আমি ভেবেছিলাম, বাবা দ্রুতই কোমা থেকে ফিরে আসবেন। তারপর আমি দেশে আসব। তখন যদি দেশে আসতাম, বাবা তো আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। আমাকে ছুঁতে পারতেন না।

-কথা বলতে না পারুক, তোর গলার স্বর তো শুনতে পেত। তোর বাবা তোকে ছুঁতে না পারলেও তুই তো তোর বাবাকে ছুঁতে পারতি?

-তুমি ঠিক বলেছ, মা। আমার আসা উচিত ছিল। বাবা, একটু এদিকে তাকাও। আমি তোমার মুখটা একটু প্রাণভরে দেখি। কত দিন তোমার সহজ-সরল মুখটা দেখিনি।

বাবা এবারও কোনো সাড়া দিলেন না। মা আমাকে ইশারা দিয়ে বোঝালেন, বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। আমি পায়ের জুতা খুলে মা-বাবার মাঝখানে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। দুই হাতে দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা-মা আমাকে মাঝখানে রেখে দুই পাশ থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর দুজনেই কাঁদতে লাগলেন। আমি অনেক কষ্টে আমার কান্না চেপে রাখলাম। কারণ, আমার চোখে জল দেখে মা-বাবা কষ্ট পাক, সেটা আমি চাই না। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, মা আমার চোখের জল সহ্য করতে পারেন না।

কতক্ষণ বাবা-মায়ের মাঝখানে শুয়ে ছিলাম, বলতে পারব না। হঠাৎ পিঠে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম, বড় ভাই পাশে বসে আছেন। কান্না চোখে ভাই বললেন,

-কি রে, কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে দেশে এলি? আমরা তো কেউ জানি না যে তুই এসেছিস। পাশের বাসার একটা ছেলে বাসায় গিয়ে বলল, সে নাকি তোকে কবরস্থানের দিকে আসতে দেখেছে। শুনেই দৌড়ে চলে এলাম। চল বাসায় চল। এভাবে বাবা-মায়ের কবরে আর কতক্ষণ শুয়ে থাকবি?

আমি ভাইয়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে একইভাবে দুই কবরের ওপর শুয়ে রইলাম। ভাই আর কিছু না বলে চুপ করে পাশে বসে রইলেন। হঠাৎ মনে হলো, বাবা কবর থেকে বলে উঠলেন,

-যা, এখন বাসায় যা। এত দূর থেকে জার্নি করে এসেছিস। এখন বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট কর। পরে আবার আসিস, তোর সঙ্গে অনেক কথা বলার আছে।

মা বললেন,
-দাঁড়া আমিও তোর সঙ্গে যাই। চল, তোরে একটু ভর্তা বানিয়ে দিই। তুই তো আবার ভর্তা ছাড়া ভাত খেতে পারিস না।
মায়ের কথা শুনে বাবা বললেন,
-কোথায় যাও তুমি? আমরা তো চাইলেও আর এখান থেকে যেতে পারব না।

বাবার কথা শুনে মা আবার কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-বাবা, আমি তো তোর সঙ্গে যেতে পারব না। তোর কী কী খেতে ইচ্ছা হয়, তোর ভাবিকে বলিস। ও তোকে রান্না করে খাওয়াবে। আর শোন, ঘরে ঢুকে ভালো করে গোসল করে নিবি। এতক্ষণ কবরস্থানে শুয়েছিলি। এখানকার মাটিতে অনেক পোকামাকড়। কি না কি গায়ে লেগেছে, কে জানে। ভালোমতো সাবান দিয়ে গোসল না করলে শরীরে আবার চুলকানি হবে। আরেকটা কথা, ভাত খাওয়ার সময় হাতের কাছে পানি রাখবি। তোর তো আবার ভাত খেতে গেলেই তাড়াহুড়া। ধীরে ধীরে খাবি। না হলে খাবার গলায় আটকে আবার কষ্ট পাবি। যা, বাসায় যা।

আমি মা-বাবার কবরে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। একটু দূর গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে কবরের দিকে তাকাতেই দেখলাম, মা-বাবা দুজনেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুজনের চোখ থেকে এখনো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

আজ আমি আবার আমেরিকা চলে যাচ্ছি। বিদায় নেওয়ার জন্য বাবা-মায়ের কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কবরের মাটিতে হাত দিয়ে দুজনকে সালাম করলাম। ঠিক সে সময় কবরের পাশের গাছ থেকে একটি পাতা আমার মাথায় ঝরে পড়ল। মনে হলো, ওটা পাতা নয়, আমার মায়ের হাত। উনি পাতা হয়ে আমার মাথা ছুঁয়ে আমাকে আশীর্বাদ করলেন। পাশে দাঁড়ানো বড় ভাইকে বললাম,
-ভাইয়া, আমি কি বাবা-মায়ের সঙ্গে একটু একা থাকতে পারি?

ভাই কিছু না বলে আমাকে একা রেখে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাকিয়ে দেখলাম, মা-বাবা দুজনেই কাঁদছেন। মাকে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু কেন জানি কিছুই বলতে পারলাম না। অনেক কষ্টে কান্না চেপে বললাম,

-মা, আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা দুজনে ভালো থেকো।
মা ভেজা চোখে আমার চোখের দিকে তাকালেন। তারপর কান্নাভেজা গলায় বললেন,
-আবার কবে আসবি, বাবা?

-জানি না মা। আর এসে কী লাভ বলো? তোমাদের তো ছোঁয়া যায় না। আর তোমরাও তো আমাকে ছুঁতে পারো না, বুকে জড়িয়ে ধরতে পারো না।

-আমরা তোকে ছুঁতে না পারলাম, তাতে কী, তুই এলে তোকে তো একটু দেখতে পারব। সন্তানের মুখ দেখতে পাওয়া যে কত শান্তির, তা তুই বাবা না হলে বুঝবি না।

-ঠিক আছে মা, আগে বিয়ে করি, বাবা হই, তখন না হয় বুঝব। প্লিজ আর কান্না করো না। দেখো, আমি শিগগিরই তোমাদের দেখতে চলে আসব।

বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিজের চোখের জল লুকাতে দ্রুত কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এলাম। পা বাড়ালাম সামনের দিকে। অনুভব করলাম, আমার চোখ থেকে পানি ঝরছে। ইচ্ছা হলো একবার পেছনে ফিরে দেখি আর চিৎকার করে মাকে বলি, ‘বাবা-মাকে দেখার জন্য সন্তানের কবরস্থানে আসাটা যে কী কষ্টের, সেটা তোমরা বুঝবে না মা।’

কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। এমনকি পেছনে ঘুরে দেখার সাহসটাও হলো না। কারণ, আমার চোখের জল দেখে মা কষ্ট পান, সেটা আমি চাই না।

বি: দ্রষ্টব্য:
পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করছি। আমার মা-বাবাসহ যেসব মা-বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, আল্লাহ তাঁদের বেহেশত নসিব করুন। আর যেসব মা-বাবা এখনো বেঁচে আছেন, আল্লাহ তাঁদের লম্বা জীবন দান করুন।
*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র