ভিয়েনা-ভ্রাতিস্লাভার পথে, বন্ধুত্ব ও বৈজ্ঞানিক সংলাপের ভ্রমণ

ছবি: লেখকের পাঠানো

এসসিএমআইডি গ্লোবাল মিটিং ২০২৫ এবং এক মানবিক সংযোগের গল্পের কথা আজ তুলে ধরব।

বসন্তের আলো ছড়িয়ে পড়া মুহূর্তে আমি এসেছি ইউরোপের হৃদয়ে অবস্থিত ভিয়েনা শহরে—যেখানে সংগীত, স্থাপত্য আর চিন্তার নান্দনিকতা মিলেমিশে গড়ে তোলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এখানেই অনুষ্ঠিত হলো এসসিএমআইডি গ্লোবাল মিটিং ২০২৫, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের আয়োজনে। ১১ থেকে ১৫ এপ্রিল, এটি ছিল শুধু একটি সম্মেলন নয়; বরং বিশ্ব স্বাস্থ্যচিন্তার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্মিলিত প্রয়াস। সম্মেলনের আলোকছায়ায় কিছু উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরা হলো—

১. উদ্দেশ্য ও পরিসর

এটি শুধু একাডেমিক জ্ঞানচর্চার মঞ্চ নয়, বরং বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য ও সংক্রমণ প্রতিরোধব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সংলাপের ক্ষেত্র।

২. বৈজ্ঞানিক বৈচিত্র্য

• প্লেনারি সেশন ও সিম্পোজিয়াম: সমসাময়িক গবেষণা ও বাস্তব কেস স্টাডির উপস্থাপনা

• পোস্টার ও এবস্ট্রাক্ট: তরুণ গবেষকদের ভাবনা ও সম্ভাবনা প্রকাশের সুযোগ

• ওয়ার্কশপ ও হ্যান্ডস-অন সেশন: বাস্তব প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি আয়ত্তের ক্ষেত্র

• নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট: ভবিষ্যতের সহযোগিতা ও উদ্ভাবনের সূত্রপাত।

৩. ভেন্যু ও শহরের মেজাজ

ভিয়েনা—ইউরোপের শিল্প, সংস্কৃতি ও সংগীতের প্রাণকেন্দ্র। সম্মেলনের গাম্ভীর্য ও শহরের ঐতিহ্য মিলেমিশে এক চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা এনে দেয়।

৪. ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

• নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি ও প্রযুক্তির বিকাশ

• মহামারি প্রস্তুতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্যনীতি

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা এখানে একত্রিত হন রোগপ্রতিরোধ, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স, টিকাদান কৌশল ও ইনোভেটিভ চিকিৎসা নিয়ে আলোচনায়। এই আলোচনায় অংশ নিয়েছি আমার শৈশবের বন্ধু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চিকিৎসক নাজমুলের সঙ্গে—বাংলাদেশ থেকে এসেছেন আরও কয়েকজন প্রতিযোগী এই সম্মেলনে অংশ নিতে। ঠিক দুই বছর পর আমাদের পুনর্মিলন হলো এই ভিয়েনা শহরে।

ছবি: লেখকের পাঠানো

নাজমুল বলল, ‘দোস্ত শোন, একটা কাজ আছে তোর জন্য। আমরা ফাইজার, অক্সফোর্ড আর KI (Karolinska Institutet is one of Europe’s largest medical universities)-এর মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক গড়তে আগ্রহী। তুই যদি একটু সেতুবন্ধের কাজ করিস…’

আমি হেসে বললাম, ‘তুই সেই আগের মতোই, সুযোগ পেলেই দেশের জন্য কিছু করতেই হবে! ঠিক আছে, দেখা যাক কী করা যায়। আমাদের তো সব সময়ই এমন স্বপ্ন ছিল, মনে আছে?’

একটি কফি ব্রেকের সুযোগে আমরা নিরিবিলি এক কোণে বসে আলোচনা শুরু করি।

নাজমুল বলল, ‘আমি চাই, বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর সঙ্গে অক্সফোর্ড আর কারোলিনস্কার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর লিংক হোক—রিসার্চ, ট্রেনিং, ইনোভেশন—সবকিছুতেই পার্টনারশিপ দরকার।’

আমি বললাম, ‘তোর মতো আমিও ভাবছি, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার এক রকম তাগিদ কাজ করে…দোস্ত, আমাদের অভিজ্ঞতা আর সংযোগ যদি একত্রিত হয়, তাহলে সত্যিই একটা বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।’

তখনই মনে পড়ে সম্ভবত ২০১৪–১৫ সালে সুইডেনে আসা আমাদের আরেক বাল্যবন্ধু মাহবুবুর রাজ্জাক, অধ্যাপক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), তার কথা। সে এসেছিল KTH–তে (Royal Institute of Technology)। আমি তাকে আমার বড় ভাই মান্নান মৃধা, অধ্যাপক, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, KTH-এর সঙ্গে যুক্ত করে দিই। সেই সংযোগের ফলেই ২০১৬ সালে বুয়েটে চালু হয় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, যা বর্তমানে এক যুগান্তকারী প্রকল্প এবং নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক গর্বজনক অর্জন।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

হয়তো এবারও তেমনই কিছু হবে…আলোচনার সূচনা তো হলো, এবার দেখা যাক কত দূর এগোতে পারি।

যা–ই হোক, অক্সফোর্ড, কারোলিন্সকা ও ফাইজারের সঙ্গে আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল অনেকটাই এ রকম—

গতকাল আমাদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক আলাপ হয়েছিল। সেই আলোচনায় আমি ভবিষ্যতে একটি সম্ভাব্য যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব তুলেছিলাম, যার লক্ষ্য হবে একটি নিরাপদ ও টেকসই বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ লক্ষ্য পূরণে আমাদের প্রয়োজন সীমান্ত অতিক্রম করা অভিজ্ঞতা, সম্পদ এবং জীবাণু ও সংক্রমণবিষয়ক গভীর জ্ঞানের সমন্বয়।

আমি বলেছি, আমি চাই তোমরা বাংলাদেশের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালগুলোর সঙ্গে চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করো। সংক্রমণ এবং নানাবিধ রোগসংক্রান্ত জটিলতা মোকাবিলায় আমাদের মধ্যে যৌথভাবে কাজ করার বিশাল সুযোগ রয়েছে, যা হয়তো তোমাদের আগ্রহ ও কৌতূহলকেও উসকে দেবে।

অক্সফোর্ড ও কারোলিন্সকার মধ্যে একটি কার্যকর অংশীদারত্ব গড়ে উঠলে তা একদিকে যেমন স্থানীয় স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে, অন্যদিকে তেমনি বৈশ্বিক পর্যায়েও টেকসই সমাধানের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

ছবি: লেখকের পাঠানো

সম্মেলনের বাইরের জীবন: দুই বন্ধু, দুই অনুভবের মিলন

সম্মেলনের কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে আমরা একটু অবকাশ নিতে চলে যাই স্লোভাকিয়ার রাজধানী ভ্রাতিস্লাভা—ট্রেনে মাত্র এক ঘণ্টার পথ, অথচ যেন এক ভিন্ন পৃথিবী।

ট্রেনে উঠেই নাজমুল বলে, ‘তুই জানিস, শেষ কবে নিজের জন্য এভাবে সময় বের করেছি, তা মনে নেই।’

আমি বলি, ‘এই মুহূর্তটাই তো জীবন দোস্ত, কাজের চাপেই আমরা এসব ভুলে যাই।’

ভিয়েনা—সংগীতের শহর, অপেরার ছায়া, শিল্পের ধ্রুপদি সৌন্দর্য। ভ্রাতিস্লাভা—নীরব কবিতা, মধ্যযুগীয় শহর, ইতিহাসের স্তব্ধ ভাষা।

শেনব্রুন প্যালেসে দাঁড়িয়ে নাজমুল বলে, ‘এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে সময় থেমে গেছে…মনে পড়ছে সেই রাত জাগা দিনগুলোর কথা।’

আমি বলি, ‘ভাবিনি কখনো আমরা এভাবে দুই মহাদেশে কাজ করব, আবার দেখা হবে ভ্রাতৃত্বের এমন মুহূর্তে।’

দানিয়ুব নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের জীবনের অনেক অনুচ্চারিত অধ্যায় উঠে আসে। দানিয়ুব নদী ইউরোপের অন্যতম দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক নদী। প্রায় ২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদী রাশিয়ার ভলগার পরেই দ্বিতীয় দীর্ঘতম। জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে উৎসারিত দানিয়ুব নদী বহু পথ পেরিয়ে এসে মিশেছে কালো সাগরে। এই নদী ১০টি দেশ অতিক্রম করে, যা ইউরোপে সবচেয়ে বেশি দেশ ছুঁয়ে যাওয়া নদী। এর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ কিছু শহর—ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, ব্রাতিস্লাভা ও বেলগ্রেড।

দানিয়ুব কেবল একটি নদী নয়, এটি ইউরোপের বাণিজ্য ও নৌপরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ শিরা। রাইন-মেইন-দানিয়ুব ক্যানেলের মাধ্যমে এটি উত্তর সাগরের সঙ্গেও যুক্ত।

এই নদীর ধারে ছড়িয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাসাদ আর প্রাচীন সভ্যতার ছোঁয়া। পাশাপাশি এটি নানা জলজ প্রাণী ও পাখির আশ্রয়স্থল হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেমও গড়ে তুলেছে।

হাঁটার ফাঁকে অনেক কথার মাঝে নাজমুল বলতে শুরু করল, ‘তোর লেখা পড়ি মাঝে মাঝে। ভালো লাগে, তবে কষ্টও হয়—তুই অনেক দূরে, আর আমরা বাংলাদেশে। কখন দেশে আসবি?’

আমি বললাম, ‘দূরত্ব থাকলেও মন তো কাছেই থাকে, তাই না? মাঝে মাঝে একটু ভুল পথে হাঁটাই তো আসল বন্ধুত্ব।’

পাথরের রাস্তা, পুরোনো টাওয়ার আর স্নিগ্ধ বিকেলের ভ্রাতিস্লাভা—সব যেন মিশে যায় আমাদের বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতায়। রাত পোহালেই বাংলা নববর্ষ, আমাকে ফিরতে হবে স্টকহোমে। নাজমুল যাবে গ্রিসে, গ্রিস থেকে পরের দিন সান্তরিনি, সান্তরিনি ভ্রমণ শেষে লন্ডন, তারপর বাংলাদেশে।

ছবি: লেখকের পাঠানো

বিজ্ঞান ও মানবতার এক অভিন্ন যাত্রা

ভিয়েনা ও ভ্রাতিস্লাভা—দুটি শহর, দুটি অভিজ্ঞতা। একদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্যচিন্তার অগ্রগতি, অন্যদিকে হৃদয়ের পুরোনো বন্ধনের পুনর্জাগরণ। এই সফর আমাকে শিখিয়েছে—বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন, তা মানবিক সংযোগ ছাড়া পূর্ণতা পায় না।

বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর সহানুভূতির মধ্যেই তো জীবনের আসল ভ্রমণ। আর সেই ভ্রমণেই আমরা খুঁজে পাই আমাদের নিজস্ব মানবিক পরিচয়। এই সফর শুধু স্মৃতি নয়, ভবিষ্যতের পথচিত্রও তুলে ধরে। সম্মেলনের আলোচনায় উঠে এসেছে এক বাস্তব প্রত্যাশা—বাংলাদেশের মেডিকেল হাসপাতালগুলো যদি অক্সফোর্ড, কারোলিন্সকা বা ফাইজারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গবেষণা ও প্রশিক্ষণে অংশ নেয়, তবে সংক্রমণজনিত রোগ মোকাবিলায় একটি কার্যকর ও যুগোপযোগী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

বিশ্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা হতে পারে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের সেতুবন্ধ—যেখানে দেশীয় বাস্তবতা এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা মিলে তৈরি হতে পারে টেকসই সমাধান। আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, যৌথ গবেষণা ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু নিজের চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করবে না, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তার পথেও অবদান রাখতে পারবেন।

*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন