রোজা আসলেই মনে পড়ে বাড়াদী গ্রামের কথা
বাড়াদী গ্রামের ধোপাপাড়ার তেমাথায় বিশুর কলঘরের সামনে পাড়ার ছেলেবুড়ো সব জমায়েত হয়েছে।
আজ চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল থেকে রোজা শুরু হবে। তাই সবাই আগ্রহ নিয়ে ঠাকুরবাড়ির বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। কে সবার আগে চাঁদের দেখা পায় সেটা নিয়ে চলছে মনে মনে এক ধরনের প্রতিযোগিতা। প্রথম দিনের চাঁদ খুঁজে পাওয়া এমনিতেই কঠিন আর সেটা থাকেও সামান্য সময়ের জন্য। তাই সবাই যার যার মতো করে খুঁজছে। হঠাৎ হয়তোবা কারও চোখে পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ মামা আসসালামু আলাইকুম বলে চিৎকার। এরপর বাকি সবাইকে দেখিয়ে দেওয়া। ওই যে তিনটা বাঁশের পাতা একসঙ্গে দুলছে, ঠিক তার আধহাত ওপরেই উঠেছে চাঁদমামা। সবাই দেখে আর সালাম দেয়।
এরপর সবাই খুশিমনে মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদের দিকে রওনা দেয়। অবশ্য মসজিদের ছাদ থেকেও চাঁদ দেখে মসজিদ পাড়ার ছেলেপুলেরা। মসজিদে এসে শুরু হয় গল্প। চাঁদটার জন্ম কী আজকেই, হয়েছে না কি গতকাল। মুরুব্বিরা বলেন আরে না রে বাপু, যেই চিকন চাঁদ আজকেই জন্ম হয়েছে। আর দেখলে না বেশিক্ষণ আকাশে থাকলও না। আগের দিনের চাঁদ হলে পেটটা থাকতো মোটা। আর উজ্জ্বলতাও থাকতো বেশি, আকাশে থাকতো অনেকক্ষণ। সবাই তার এই অকাট্য যুক্তি মেনে নেয়।
মাগরিবের নামাজের পর শুরু হয় এশার নামাজের জন্য অপেক্ষা। কারণ আজ থেকে এশার নামাজের পর তারাবি পড়া হবে। এত দিন সূরা তারাবি পড়লেও এইবার থেকে খতম তারাবি পড়া হবে।
খাজানগর মাদ্রাসা থেকে এক তরুণ হাফেজ আগেভাগেই চলে এসেছে খতম তারাবি পড়ানোর জন্য।
যেদিন চাঁদ দেখা যাবে, সেদিন থেকেই তারাবি শুরু হবে। তাই হাফেজ সাহেব এসে পড়েছেন কয়েক দিন আগেই। এসেই উনি পাড়ার মাতুব্বর মতিয়ার রহমান মন্টু সাহেবের বাড়িতে উঠেছেন। সারা দিন নামাজ কালামের ফাঁকে সেই তরুণ গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে দলবেঁধে কখনো গাদন কখনওবা ফুটবল খেলতে নেমে পড়ছেন। ফর্সা টুকটুকে চেহারার সেই তরুণ কিছুক্ষণ খেলাধুলা করার পর তাঁর চেহারা হয়ে যায় টুকটুকে লাল। তবুও তাঁর ক্লান্তি নেই। বিকেল হলেই পাড়ার তরুণদের সঙ্গে করে গ্রামের পেছনের অবারিত মাঠে হাটতে বেরিয়ে পড়েন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন গ্রামেরই একজন।
এশার নামাজে মুসল্লির সমাগম বেড়ে যায়। মসজিদ ভর্তি হয়ে বারান্দাও একসময় ভর্তি হয়ে যায়। তখন মসজিদের সামনের লম্বা উঠোনে চটের ছালা বিছিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই দলবেঁধে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে তারাবি পড়েন। তরুণ হাফেজ চেষ্টা করেন কোরআনের আয়াতগুলোকে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে যতদ্রুত সম্ভব পড়ে যেতে। তাহলে অন্ততপক্ষে নামাজটা দ্রুত শেষ করা যাবে।
শিশুকিশোরদের তখন বাড়তি খুশির সময়। কারণ, প্রতিদিনই কেউ না কেউ নামাজের পর মিলাদের আয়োজন করেন। আর মিলাদ শেষে থাকে সিন্নি। গ্রামের মানুষ বড় টিনের গামলায় করে ক্ষীর বার খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে আসেন। সঙ্গে কলার পাতা। সবার হাতে হাতে কলার পাতা দিয়ে সিন্নি বিলি করা হয়। একটু অবস্থাসম্পন্নরা খিচুড়ির সঙ্গে মুরগির মাংসের তরকারিও দেন।
আবার অনেকেই ঝামেলা কমাতে নিয়ে আসেন বাতাসা। বাতাসা হলে শিশুদের খুশি আরও বেড়ে যায়।
কারণ, তাঁরা তখন এক হাতে বাতাসা নিয়ে সেই হাত পেছনে লুকিয়ে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দেয়। যিনি সিন্নি বিলি করেন তিনি ব্যাপারটা জানেন তবুও রোজা উপলক্ষে ছেলেদের হাতে তুলে দেন আরও দুটো বাড়তি বাতাসা। মসজিদে নামাজ পড়তে আসা তখন এক ধরনের উৎসব মনে হয়। এছাড়া শবে কদরের রাতে তারাবির পরে চলে নফল নামাজ পড়া। তখন শিশুদের মধ্যে আলাপ চলে, কে কত রাকাত নফল নামাজ পড়েছেন। কেউ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলে পাশ থেকে আরেকজন কুনুইয়ের গুঁতো দিয়ে তাকে জাগিয়ে দেয়। এরপর বাড়ি এসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েই আবার ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে ফিরে আসতে হয়।
ফজরের নামাজের আগেই সারা গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। আশেপাশের বিভিন্ন মসজিদের মাইক্রোফোন থেকে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায়। মা জননীরা উঠুন, সেহরি রান্না শুরু করুন। এরপর একসময় বলা হয় ঘুম থেকে উঠুন সেহরি খান, সেহরির সময় হয়েছে। মায়েরা সবার আগে উঠে রান্নাঘরে চলে যান।
পাশাপাশি আশেপাশের বাড়ির মহিলাদেরও জাগিয়ে দেন। ও বু উঠবু না, সেহরির সময় হয়ে গেছে তো।
এছাড়া পাড়ার মানুষেরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ডাকতে বেরিয়ে পড়েন। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে এসে নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করেন উনারা যতক্ষণ না বাড়ির ভেতর থেকে পুরুষ মানুষ কেউ সাড়া দিচ্ছেন।
সাড়া পাবার পর একইভাবে পরের বাড়িটার সামনে যেয়ে ডাকাডাকি শুরু হয়। এরপর একসময় ফজরের আজান পড়ে। তখন আবার সবাই দলবেঁধে ফজরের নামাজ পড়তে যায়।
সময় এবং নদীর স্রোত কখনো থেমে থাকে না। নদীর মতো আমাদের জীবনও বয়ে যায়। সেই প্রবাহ এসে একসময় এসে মেশে সাগরে, তারপর মহাসাগরে। এভাবেই পুরো পৃথিবী বাধা পড়ে একই বন্ধনে।
বাড়াদী গ্রামের একজন শিশু এখন প্রশান্ত মসাগরের একটা দ্বীপ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী। কিন্তু তার স্মৃতিতে সবসময়ই সমুজ্জ্বল বাড়াদী গ্রামের স্মৃতি। তাই শত ব্যস্ততায়ও সে তার সন্তানদের মধ্যে নিজের শৈশবের স্মৃতি বিনির্মাণের চেষ্টায় থাকে। তাদের বাসার বারান্দা থেকেই নতুন চাঁদ দেখা যায়। তবুও আরও ভালোভাবে দেখার জন্য সে বাসার পাশের উঁচু পার্কে চলে যায় ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে। এরপর চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে শৈশবের ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠে, চাঁদ মামা আসসালামু আলাইকুম বলে। তার দেখাদেখি ছেলেমেয়ে দুটো চিৎকার করে ওঠে।
এরপর তারা বাড়াদী গ্রামের মতো পায়ে হেঁটে বাসার কাছেই অবস্থিত মসজিদে যায় তারাবির নামাজ পড়তে। সেখানে গেলেই তরুণের মনে হয় সে যেন বাড়াদী গ্রামের তাদের পাড়ার মসজিদে নামাজ পড়তে গেছে। সিজদায় গিয়ে সে প্রাণভরে জায়নামাজের মাদুরের ঘ্রাণ নেয়। মসজিদে চলে খতম তারাবি পড়া।
অনেকেই শুরুর দশ রাকাত পড়ে বেরিয়ে পড়েন। তখন মসজিদের ভেতরে জায়গা পাওয়া যায়। যারা নামাজে আসেন তাদের মধ্যে অনেকেই সঙ্গে করে কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসেন। কেউ হয়তোবা নিয়ে আসেন তার দোকানের ডোনাট, আবার কেউ নিয়ে আসেন নিজের গাছের পেয়ারা, কেউবা নিয়ে আসেন মজাদার ইফতারি, কেউবা নিয়ে আসেন সুস্বাদু জিলাপি। আবার অনেকেই দোকান থেকে একবাক্স খেজুর কিনে নিয়ে আসেন। নামাজের ফাঁকে সবাই সেগুলোর স্বাদ নেন। এ যেন বাড়াদী গ্রামের মিলাদের পর সিন্নি বিলিরই আরেক রূপ।
তারাবির শেষে জামাতেই পড়া হয় বিতর নামাজ। বিতর নামাজের পর হুজুর সামান্য বয়ান করেন। তখন মনে হয় এ যেন কুষ্টিয়ার বাড়াদী গ্রামের হুজুর আবদুল মালেকের বয়ান। গ্রামে থাকতে সে হুজুরের বয়ানের সময় হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। এখনো সে মুসল্লিদের ভিড়ের মধ্যে থেকে সামনে বসা হুজুরের মুখটা দেখার চেষ্টা করে। সব হুজুরই কি চমৎকার সব কথা বলেন। এই যেমন সেদিন হুজুর বলছিলেন ‘হুসনে আখলাক’ সম্মন্ধে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চরিত্র ছিল সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র। তার চরিত্রে ছিল শিশুর সরলতা। সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। তিনি ছোটবড় সবাইকে সম্মান দিয়ে আদবের সঙ্গে কথা বলতেন। তার এ ব্যবহার দেখেই কত মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মের ছাতার তলে হাজির হতো। কথাগুলো শুনলে মনে হয় যেন তাদের পাড়ার মসজিদের মালেক চাচাই বয়ান করছেন। তরুণ ভাবে আহা সারাটা জীবন যদি এমন একটা চরিত্রের কাছাকাছি চরিত্র নিয়েও পার করে দেওয়া যেত।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]