বন্যার মর্মান্তিক চিত্র ও বাংলাদেশের অস্তিত্বের লড়াই
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও আজ সেই নদীগুলোই দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর আমাদের ঘরবাড়ি, ফসল এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের স্বপ্নগুলোকে ভেসে যেতে দেখি প্রলয়ঙ্করী বন্যার স্রোতে। বন্যা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয়, এটি একটি কূটনৈতিক সমস্যার প্রতিফলন, যা কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশকে জর্জরিত করে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে পানি ভাগাভাগি নিয়ে চলমান এই সংকট, যা স্বাধীনতার এত বছর পরও সমাধান হয়নি, তা আমাদের প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত করছে।
বাংলাদেশের নদীগুলোর বেশির ভাগের উৎস ভারত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা—এসব নদীর ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের লাখো কৃষকের জীবিকা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আমরা শুধু শুনেছি প্রতিশ্রুতি, আর দেখেছি আমাদের ভূমির শুকিয়ে যাওয়া, আমাদের ফসলের নষ্ট হওয়া। তিস্তা নদীর পানি নিয়ে আলোচনা, যা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়ে গেছে, তা যেন বাংলাদেশের কৃষকদের জীবনের অনিশ্চয়তারই প্রতিচ্ছবি। আর উজান থেকে পানি আসার কারণে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার প্রকোপ বাড়ে।
বিশ্ব সম্প্রদায়, যারা নিজেদের মানবতার রক্ষক হিসেবে প্রচার করে, এই সংকটের প্রতি সম্পূর্ণভাবে উদাসীন। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আদালত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ করে যে ছোট দেশগুলোর সমস্যা তাদের কাছে কতটা গুরুত্বহীন। যে দেশে প্রতিবছর লাখো মানুষ গৃহহীন হয়, সেই দেশের কণ্ঠস্বর কেন বিশ্বমঞ্চে এতটা নীরব? পৃথিবীজুড়ে যারা মানবাধিকারের কথা বলে, তাদের কাছে এই নীরবতা কি শুধু দৃষ্টির অগোচরে থাকা একটি সমস্যা, নাকি এটি একটি সম্পূর্ণ উদাসীনতার উদাহরণ?
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কিছু সুপারিশ ও সমাধান অত্যন্ত জরুরি।
প্রথমত, জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি বিশেষ পানিসম্পদ–বিষয়ক কমিশন গঠন করা উচিত, যা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানিবণ্টন নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করবে এবং একটি স্থায়ী চুক্তি প্রস্তাব করবে। এই কমিশনকে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে, যাতে এই চুক্তি বাধ্যতামূলক এবং উভয় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়।
দ্বিতীয়ত, সার্ক বা বিমসটেকের মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা ফোরাম গঠন করতে হবে, যেখানে সদস্যদেশগুলো একসঙ্গে বসে জলসম্পদের ন্যায্য ব্যবহারের বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা ও সমন্বয় করবে। এই ফোরামে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যৌথ উদ্যোগ, যেমন সীমান্তের কাছে বাঁধ নির্মাণ এবং পানি সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভার তৈরি করার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সরকারকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি সংরক্ষণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি জাতীয় মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে হবে। এর মধ্যে বিশেষভাবে নির্ধারিত এলাকায় জলাধার তৈরি, নদীগুলোর খননকাজ বৃদ্ধি এবং বন্যা পূর্বাভাসের জন্য উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন করতে হবে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাঁধ ও সেচ প্রকল্পগুলোকে আরও কার্যকরী করতে হবে।
চতুর্থত, প্রতিটি বন্যাপ্রবণ এলাকায় জনগণের জন্য নিয়মিত সচেতনতা কর্মশালা এবং জরুরি প্রস্তুতির মহড়া আয়োজন করতে হবে। এতে অংশগ্রহণ করতে হবে স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠনকে। বন্যার পূর্বাভাস পেলে দ্রুত কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।
পঞ্চম, দেশের সব রাজনৈতিক দলের উচিত একটি জাতীয় সংকটকালীন ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করা, যার উদ্দেশ্য হবে জাতির সংকট মোকাবিলায় একযোগে কাজ করা। এই ফ্রন্টের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে, বিশেষ করে দুর্যোগের সময়ে রাস্তা অবরোধ, ধর্মঘট ও সংঘাত বন্ধ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থের জন্য দলীয় মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে সংকট সমাধানে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার আহ্বান জানানো উচিত।
বাংলাদেশ আজ একটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কূটনৈতিক জটিলতা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলছে। এই অবস্থায় দেশের সব স্তরের মানুষের উচিত একত্র হয়ে সমস্যার সমাধানে কাজ করা। যদি আমরা এখনই এই সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ না নিই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই উচিত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো, নয়তো ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
আসুন, সবাই মিলে এই সংকট মোকাবিলা করে দেশের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করি। আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও নৈতিক দায়িত্ববোধই পারে এই বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে। এটা আমাদের জাতির প্রতি দায়িত্ব, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি প্রতিশ্রুতি।
*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন
*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]