অস্ট্রেলিয়ানা পাইওনিয়ার ভিলেজে এক দিন
ব্যক্তিগতভাবে আমি গ্রামের মানুষ হওয়াতে যেকোন জায়গার গ্রামের প্রতি একটা আলাদা টান আছে। আমার মতে আসলে একটা দেশের ভিত তৈরি হয় গ্রামে। পাশাপাশি ইতিহাসটাও আমার আগ্রহের বিষয়। যা–ই হোক, মনে মনে অনেক দিন ধরেই এমনটা একটা জায়গার সন্ধান করছিলাম, যেখানে গেলে একই সঙ্গে এই দুটো বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে। অস্ট্রেলিয়ানা পাইওনিয়ার ভিলেজে গিয়ে সেই আশাটা পুরোপুরি পূর্ণ হলো।
অস্ট্রেলিয়ানা পাইওনিয়ার ভিলেজে আসুন এবং এক শ বছরেরও বেশি আগের জীবনের পরিবেশ এবং ক্রিয়াকলাপের অভিজ্ঞতা নিন। ভিলেজের ওয়েবসাইটে ঠিক এই কথাটায় লেখা আছে। একুশ শতককে পেছনে ফেলে কম্পিউটার, টেলিভিশন এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের আগে একটি যুগে ফিরে যাওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যায় এখানে বেড়াতে গেলে। সেটা এমন একটা সময় ছিল যখন রুটি বাড়িতে তৈরি করা হতো। দুধ পাওয়া যেত সরাসরি গরুর কাছ থেকে। আর কথাবার্তা হতো কেবল সামনাসামনি। এখানে গেলে অতীতের গ্রামের মাঠ এবং ইমারতগুলো সামনাসামনি দেখা যায়। আর নিজেকে ফিরিয়ে নেওয়া যায় অতীতের সেই সময়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে, আপনি যেন উনিশ শতকের কোনো রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
সিডনি থেকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের পথ। আমাদের বাসা মিন্টো থেকেও একই দূরত্ব। স্কুল হলিডে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ভালো জায়গা খুঁজছিলাম। তখন ইনস্টাগ্রামে ক্যাম্পাসের জুনিয়র সোনিয়ার কিছু ছবি দেখে জায়গাটা খুব পছন্দ হলো। ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম জায়গাটার নাম। এরপর রোববার সকাল সকাল উঠে রওনা দিয়ে দিলাম। মোটরওয়ে এম–৫ এবং এম–৭ ছাড়িয়ে রাস্তা যখন গ্রামের দিকে মোড় নিল, তখন রাস্তার দুপাশের সবুজ খেত দেখে চোখ জুড়িয়ে এল। এই সবুজটা অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ সবুজের মতো ধূসর না। কারণ, এখানে নিয়মিত সেচ দেয়া হয়। ফলে সেটা বাংলাদেশের মতো গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।
ভিলেজের প্রবেশদ্বারে একজন নারী আমাদের স্বাগত জানাল। তার পোশাকপরিচ্ছদ সেই আদিকালের। তিনি আমাদের টিকেট এবং তথ্যবই সরবরাহ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে খুব সংক্ষিপ্তভাবে রাস্তাটা বলে দিলেন। পার্কিংয়ে গাড়ি পার্ক করেই বেরিয়ে পড়লাম। শুরুতেই হাতের ডান দিকে কয়েকটা বার-বি-কিউ–এর ছাউনি। সেখানে বেশকিছু পরিবার বসে গেছে তাদের সদস্যদের নিয়ে। ঠিক তার উল্টোদিকে হাতের বাঁ পাশে রয়েছে ছোটদের ট্রেন। অবশ্য ছোটদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য বড়দেরকেও তাদের সঙ্গে চড়তে হচ্ছে। একটু এগোলেই ডান দিকে রয়েছে হকসবুরি উডক্রাফট এর শোরুম। তার সঙ্গেই লাগোয়া রয়েছে মালপত্র বহনের কুরাজং রেলওয়ে স্টেশন। এই দোকানটাতে কাঠের তৈরি অনেক ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। সেখানে পুরোনো আমলের টু-ইন-ওয়ান ক্যাসেট প্লেয়ারও দেখলাম। আর পেয়ে গেলাম কাঠের তৈরি হাতে ঘোরানো লাটিম। বাচ্চারাও কিছু জিনিস কিনল। সেগুলো হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা মুশকিল। তাই দোকানিদের অনুরোধ করলাম সেগুলো তাদের জিম্মায় রেখে দিতে। তারা রাজি হয়ে গেল।
এরপর আমরা অন্যসব জিনিস দেখার জন্য তাড়াহুড়া করছিলাম দেখে দোকানি ভদ্রলোক বললেন, বন্ধু এটা অস্ট্রেলিয়া এখানে এতো তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। আমি বললাম, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। এরপর উনি টিকেট কাউন্টার দেখিয়ে দিলেন। আমরা টিকেট কাউন্টারে গিয়ে ট্রেনে চড়ার এবং ট্রাক্টরে চড়ার টিকেট করে নিলাম। এরপর ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেনটা একই জায়গার মধ্যে তিনবার চক্কর দিল। সেই পুরোনো আমলের বাষ্প ইঞ্জিনচালিত ট্রেন। ঝকঝক শব্দ করে এগিয়ে চলল। ট্রেনে চড়ার সময় আশেপাশে খেয়াল রাখতে হয়। কারণ, সেখানে অনেক পশুপাখির ছোট ছোট কিন্তু সুন্দর ভাস্কর্য রয়েছে। আমাদের ছেলে রায়ান শুরুতেই কচ্ছপ আবিষ্কার করে ফেলল, যেটা আমরা দেখিনি। পরেরবার ও দেখিয়ে দিল।
ট্রেন সেশনের উল্টোদিকে রাস্তার অন্যপাশেই একটা কাঠের ঘেরা জায়গার মধ্যে দুটো স্বাস্থ্যবান ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। উৎসাহী মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমরা সূচি দেখে সামনে এগিয়ে ভিলেজের মূল রাস্তাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। এই রাস্তার দুইপাশে সারি ধরে জাতিস্মর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সব পুরোনো আমলের ইমারত। একিনের কুঁড়েঘর, যেটা আসলে পুরোনো আমলের ডাক্তারখানা। দ্য ডেম্পার ক্যাম্প যেটা আসলে হালকা নাস্তার একটা রেস্তোরাঁ। আরও আছে, শিয়ারিং শেড, ভিলেজ স্যুভেনির এবং ইনফরমেশন সেন্টার, ম্যাংগোল্ড কটেজ, দ্য বি হাউজ, দ্য স্মেল্টিং শেড, ঘোড়ার আস্তাবল, এটকিনসের কামারশালা, কার্টরাইট কটেজ, কেস কটেজ, পেরি হাউজ।
এই রাস্তার মাথায় রয়েছে একটা থানা। তার পাশেই ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়ার অফিস। মোড়ের বা দিকে রয়েছে ডাকঘর। আর ডানদিকে রয়েছে ফার্মে ব্যবহৃত জিনিসপত্র তৈরির বিভিন্ন দোকান। সেখানে মুরগির ফার্ম, ধোপাশালা, ছুতার মিস্ত্রির দোকান সবই অক্ষত আছে। মোড়ের একদম ওপরে একটা পুরোনো আমলের চাপকল। এটা দেখেই রায়ান চাপ দিয়ে পানি তুলতে আরম্ভ করে দিল। সেখানে একজন দাঁড়িয়ে ছিলেন পুরো গ্রামটা আমাদেরকে ঘুরে দেখানোর জন্য। সদা হাসিখুশি একজন মাঝবয়সী মহিলা। আমাদেরকে রাস্তার দুই পাশের ইমারতগুলো ইতিহাস বলছিলেন। রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার সময় হঠাৎ হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াচ্ছিল, কখনো শার্লক হোমসের সাজের মানুষ। আবার কখনো এসে দাঁড়াচ্ছিল পুরোনো আমলের বাজনাদার। আবার কখনোবা বড় চাকার সাইকেল চালিয়ে কেউ চলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে।
আমরা ভিলেজ ট্যুর শেষ করে ইমারতগুলো আলাদা আলাদাভাবে দেখার জন্য সবর ভেতরে প্রবেশ করলাম। তখন সেগুলোর আসল সৌন্দর্য টের পেলাম। সবকিছুই সেই আগের সময়ে আটকে রাখা হয়েছে। দরজা–জানালা থেকে শুরু করে আসবাব সবকিছুই মোটামুটি অক্ষত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর আমরা মূল রাস্তায় ফিরে এসে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ম্যাকমোহনের সিনেমা হলে ঢুকলাম। সেখানেও সবই অক্ষত আছে। তার পেছনেই রাখা আছে ১৯১২ সালের বন্যার সময় ব্যবহৃত নৌকা। তার পেছনেই রয়েছে দুটো ছাগলের খামার। ছাগলের ঘরগুলোও সেই আগেকার আমলের। বাচ্চারা খামারে গিয়ে ছাগলের সঙ্গে কিছু সময় কাটাল। এরপর একটু এগিয়ে গেলেই ভেড়ার আর ছোট ঘোড়ার খামার। সেখানে ওদেরকে খাবার খাওয়ানো যায়, যেটা মাত্র দুই ডলার দিয়ে আগে থেকে কিনে রাখতে হয়।
এরপর আমরা স্যুভেনিরের দোকানে এসে মাত্র পাঁচ ডলারের বিনিময়ে আগেকার আমলের পোশাক পরে নিলাম। এরপর কাঠের তৈরি খেলনা বন্দুক নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ালাম। আমাদেরকে দেখে অনেকেই ছবি তুলছিল। এই পোশাকে অনেক মজা করলাম আমরা। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বললাম, আপনার কাছে না কি অনেক ক্যাশ আছে। যা আছে দিয়ে দেন তাড়াতাড়ি। শুনে কাউন্টারের ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে বললেন, আমি শুধু ইফপস ব্যবহার করি বলে মেশিনটা এগিয়ে দিলেন। আমি বললাম, তাহলে আপনি বেঁচে গেলেন। এরপর আমরা গেলাম কাঠের দোকনাটায়। সেখানেও গিয়ে ডাকাতির অভিনয় করলাম। উনারা বললেন, আমাদের কাছেও ক্যাশ নেই। আমি বললাম, চলেন আমরা ছবি তুলি যে আমরা আপনাদেরকে বন্দুকের মুখে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। উনারা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। অন্য দুজন দর্শনার্থী আমাদের সবার ছবি তুলে দিলেন। এরপর মজা করে বললেন, ভেবেছিলাম, পরের বছর বাংলাদেশ যাব। তোমার ডাকাতের পোশাক দেখে সিদ্ধান্ত বদল করলাম। শুনে আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
ঘুরতে ঘুরতে আমাদের অনেক ক্ষিধে পেয়ে গিয়েছিল। এরপর অক্সবরো সরাইখানায় ঢুকে খাবারের অর্ডার করলাম। সিডনির তুলনায় খাবারের দাম অনেক সস্তা মনে হলো। খাবারের জন্য অপেক্ষার সময় মাইকে ঘোষণা দিচ্ছিল যে আগেকার আমলের মতো কলম আর কালি দিয়ে লেখার উৎসব হচ্ছে। বাচ্চারা চলে গেল সেখানে। এখানে কেউ যদি সূচি ভুলেও যায় তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ, সময়ে সময়ে মাইকে ঘোষণা করা হয় কোন জায়গায় কী কী ঘটছে। খাবার আসার পর আমরা একবাক্যে স্বীকার করলাম খাবারগুলো অত্যন্ত সুস্বাদু। খেতে খেতে স্কুল খোলার সময় হয়ে গেল। স্কুলটা মাত্র এক ঘণ্টার জন্য খোলা রাখা হয় যাতে মানুষজন ভেতরে গিয়ে জিনিসপত্র নষ্ট করতে না পারে। স্কুলে পুরোনো আমলের সবকিছুই হুবহু রাখা আছে। বাড়তি পাওনা হিসাবে বেত হাতে একজন শিক্ষক রয়েছে। আর সঙ্গে আছে একজন আয়া। বলাই বাহুল্য উনারা সবাই এইসব চরিত্রে অভিনয় করছেন। আমি শিক্ষকের হাতে বেত দেখে বললাম, আপনাকে দেখে আমার হাইস্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। যখন প্রতিদিন বেতের বাড়ি ছিল আমার জন্য ডাল-ভাত। আপনি আমাকে বেতের বাড়ি দেয়ার ভ্যান করেন। আমার মেয়ে একটা ছবি তুলে দিক আমাদের। উনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।
এরপর আমরা আবার মূল রাস্তায় ফিরে এলাম। সেখানে আগেকার আমলের একটা বিচারব্যবস্থার ছোট নাটিকা অভিনয় করে দেখানো হলো। দর্শকদের মধ্যে একজন ছোট বাচ্চা চোরের অভিনয় করলো। বিচারক তার বিচার করে দশ ঘা বেত্রাঘাত নিধারণ করলেন। তারপর মিছেমিছি বেত মারা হলো। সবাই নাটিকাটা দেখে অনেক মজা পেলেন। এর মধ্যেই আমরা ট্রাকে চড়ে ফেলেছিলাম। এছাড়াও এক সময় কীভাবে চাবুক চালাতে হয়, তারও নমুনা দেখানো হলো। অনেক উৎসাহী দর্শনার্থী নিজের হাতে চাবুক নিয়ে চর্চা শুরু করলেন। এভাবে চলতে চলতে কখন যে একটা পুরো দিন শেষ হয়ে গেছে আমরা টেরই পায়নি। মাইকে বলা হচ্ছিল আর এক ঘণ্টা সময় আছে। দর্শনার্থীরা যেন নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেন।
আমরা আবার কাঠের দোকানে ফিরে আসলাম। সেখানে একজন আমাদের হাত মকশো করে জাদু দেখালেন। এটাতে বাচ্চারা খুবই আনন্দ পেল। আমি কাঠের দোকানে এসে দোকানিদেরকে বাংলাদেশে আমার গ্রামের বাড়ি চরভবানীপুরের বালির মেঠোপথ, ঢেঁকি, হারিকেন, রাখাল, শিশুদের হাঁড়িকুড়ি খেলার ছবি দেখলাম। উনারা খুবই চমৎকৃত হলেন যে এই একবিংশ শতাব্দীতেও পৃথিবীতে এগুলো স্বমহিমায় টিকে আছে। আমি তখন বললাম, আমি যেহেতু গ্রামে আমার শৈশব এবং কৈশোর কাটিয়েছি তাই গ্রামের প্রতি আমার ভালোবাসা অত্যন্ত প্রকট। উনারা বললেন, তোমার উচ্ছ্বাসে সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। আমি বললাম, সত্যি কথা বলতে কি তোমাদেরকে ফেলে আমাদের যেতে ইচ্ছে করছে না। শুনে উনারা বললেন, তুমি চাইলেই কিন্তু এখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করতে পার। আমি বললাম, বাচ্চা দুটো বড় হয়ে গেলে আমি তোমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিব।
এরপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময় হকসবুরি নদীর কাছে থেমে সেখানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। নদীর স্নিগ্ধ বাতাসে শরীরটা জুড়িয়ে গেল। আর নদীর পাড়ের বাড়িগুলোর সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করল। আমরা পরিকল্পনা করলাম। আমরা অবশ্যই আবারও এই গ্রামটাতে আসব। বাচ্চারাও আমার সঙ্গে নির্দ্বিধায় একমত হলো। আসলে সভ্যতা বলি আর শহর বলি, সবকিছুর গোড়াপত্তন তো সেই গ্রামেই হয়েছিল।