শিশুশিক্ষা: বাংলাদেশ বনাম সুইডেন

জার্মান শিশুরা ফোর্থ গ্রেডের শেষে (শিশুদের গড় বয়স তখন ১০ বছর) অন্য দেশের শিক্ষার্থীর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০ বছর ধরে এ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে
ছবি: ডয়চে ভেলে

বাংলাদেশে কথায় কথায় বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এখন শুধু এই কথায় বললেই কী শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হবে? এর ওপর বেস্ট প্র্যাকটিস করতে হবে, জানতে হবে প্রকৃত শিক্ষা কী এবং কেন শিক্ষা ইত্যাদি। যদিও শিক্ষা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই কি সঠিক শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব? পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি কর্মজীবনের পথ নির্দেশনার গাইডলাইন মাত্র। আমাদের দৈনিক শিক্ষা বলেও যে একটি কথা রয়েছে, তার সমন্বয়ে যখন পুঁথিগত শিক্ষার আবির্ভাব ঘটে এবং সেই দৈনিক শিক্ষা যদি মানবকল্যাণে সুন্দর ও সময়োপযোগী হয়, তা যদি ‘ক্রিয়েট সাম গুড ভ্যালু ফর ম্যানকাইন্ড’ তখনই এ দৈনিক শিক্ষার সঙ্গে পুঁথিগত শিক্ষার মিশ্রণের প্রতিফলনকে বলতে পারি সুশিক্ষা। তাই আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, শুধু শিক্ষা নয় ‘সুশিক্ষাই হোক জাতির মেরুদণ্ড’। এখন প্রশ্ন, কী করে পাব এই সুশিক্ষা? আছে কি আমাদের মাঝে এমন কোনো উদাহরণ, যা তুলে ধরার মতো? অবশ্যই আছে।

ইউরোপের শিশু শিক্ষার ধরন আমাকে প্রথমে অবাক করেছে, পরে মুগ্ধ। তা কী করে সম্ভব? প্রশ্নটি খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে উত্তরটি পেতে বেশ সময় লেগেছে, তাই লেখাটি এর আগে লিখতে পারিনি।

হ্যাঁ, বলব কিছু ঘটনা, সঙ্গে বর্ণনা দেব সুইডেনের শিশু শিক্ষার ধরন। উদ্দেশ্য একটিই আর তা হলো, যদি বাংলাদেশের শিশু শিক্ষার সঙ্গে এখানকার শিশু শিক্ষার অমিল থাকে, তবে সেই অমিলটা খুঁজে বের করা। যদি দেখা যায়, সেটা আমাদের জন্য ভালো, তাহলে ভালো জিনিসগুলো আমরা অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারি।

সুইডেনে জন্মের প্রথম বছর শিশু তার মায়ের সঙ্গে সময় কাটায়। পরে তাকে সুইডিশ ডাগিসে (কিন্ডারগার্টেন বা ডে–কেয়ার শিক্ষা প্রশিক্ষণ) ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ডাগিসে মায়েরা শিশুর সঙ্গে থাকেন। আস্তে আস্তে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষাবিদ ও শিশুদের একটি সমন্বয় ঘটতে থাকে এবং মায়েদের উপস্থিতি কমতে থাকে। তারপর সকাল থেকে বিকেল অবধি শিশুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ডাগিসে।

শিশুর বয়স ছয় বছর হওয়া পর্যন্ত তাদের নানা বিষয়ের ওপর নানাভাবে হাতেনাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়। ছয়টি বছর ডাগিসে এরা শেখে বিভিন্ন বিষয়; যেমন শেয়ার ভ্যালু, মনুষ্যত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, একতা, সামাজিকতা। এককথায় বলা যেতে পারে, এখান থেকে জীবন গড়ার শুরুটাকে মজবুত করে তৈরি করতে সাহায্য করা হয়।

একজন ডাগিসের শিশুর মধ্যে সচেতনতার ছাপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি বারবার। দেখেছি, যখন আমার ছেলেমেয়ে ডাগিস থেকে বাড়িতে এসেছে। আমি যদি কোথাও কোনো ভুল করেছি সঙ্গে সঙ্গে তারা বলেছে, বাবা তুমি এটা এভাবে না করে এভাবে কর।

আমাদের ডাগিসের শিক্ষকেরা এটা এভাবে করতে বলেছেন। আমি অবাক হয়েছি আর তাদের থেকে নতুন নতুন বিষয় শিখেছি। শেখার সঙ্গে সঙ্গে তারাও বুঝেছে বাড়িতে ও সমাজে তারা কত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয় ছয় বছর বয়সে, যা না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়।

ছয় বছর বয়সে কোনোরকম প্রেশার (চাপ প্রয়োগ) ছাড়া একজন শিশুকে গড়ে তোলা, যেখানে তার শিশুকাল হারিয়ে যায়নি, যেখানে সে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে জীবনের পরিকাঠামো তৈরিতে যা যা দরকার তার সব পেয়েছে। যার কারণে জীবনে চলার পথে দ্বন্দ্ব নয় প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে সে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে শুরু করে।

এরপর ডাগিস ছেড়ে স্কুলের জীবন শুরু। জীবনের নতুন অধ্যায়। জানা, দেখা, নিজের হাতে সবকিছু তৈরি করা। নিজের চেষ্টায় কিছু করা। দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা। নতুন ও পুরোনোর সংমিশ্রণে চিন্তার উন্নয়ন করা। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করা। অজানা ও অচেনাকে চেনা। সবকিছুর সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে পড়া, যা এদের জীবনকে পরিপূর্ণতা দিতে সাহায্য করে।

৬ বছর থেকে ১৫ বছর বয়সে এরা শিক্ষার বেসিকের সঙ্গে সুন্দরভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের শিক্ষায় জীবনের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ছবি তারা পেয়ে থাকে বিধায় তারা বেশ সচেতন হয়ে ওঠে—তারা কী হতে চায় তাদের কর্মজীবনে।

আমি কখনো দেখিনি আমার ছেলেমেয়েকে বাড়িতে বই পড়তে বা লেখাপড়া করতে। মাঝেমধ্যে তাদের জিজ্ঞেস করেছি, কি কোনো হোম ওয়ার্ক নেই? তারা বলেছে,

-বাবা তুমি কত ঘণ্টা কাজ কর?
-আট ঘণ্টা।
-বাড়িতে এসে কেন অফিসের কাজ কর না?
-কেন, আমি তো অফিসেই আমার কাজ শেষ করে এসেছি, বাড়িতে কেন সেই কাজ করব?
তারা তখন বলেছে, স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্য স্কুলের কাজ স্কুলে শেষ করা। বাড়ি এসে খেলাধুলা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানো, মজা করা—এসব করতেও তো সময় ও মন দরকার।

করোনা মহামারির কারণে জার্মান শিশুরা স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে পড়াশোনা করেছে, এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে পড়াশোনার ওপর
ছবি: সংগৃহীত

আমি কখনো তাদের লেখাপড়া নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিনি। তবে খেলাধুলার ব্যাপারে বরং বেশি সময় দিয়েছি। তারা জীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তেমন কিছু মিস করেছে বলে আমার জানা নেই। এটা আমার ছেলেমেয়েদের সৌভাগ্য হয়েছে বলে আমি মনে করি। যখন যা প্রয়োজন এবং যখন যা করার সময়, তা করতে পারার মধ্যেই কিন্তু রয়েছে আসল আনন্দ।

যদি ফিরে যাই আমার জীবনের শুরুতে, আমাদের ছোটবেলার সময়ের সঙ্গে কিছুটা মিল এখানে আছে। যেমন আমরা স্কুলের পরে খেলাধুলা করেছি, দুষ্টুমি করেছি, নদীতে গিয়ে সাঁতার কেটেছি। তবে এখানকার মতো সব ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতি বা সুযোগ–সুবিধা ছিল না তখন, থাকলে মিস করতাম না। তবে বাংলাদেশে বর্তমান শিশু শিক্ষার ধরন যা শুনেছি বা দেখেছি, সেটা বেশ আলাদা। যেমন পিঠে উটের মতো করে বইয়ের বোঝা তুলে দেওয়া। স্কুল থেকে ফিরে বন্ধ ঘরে গৃহশিক্ষকের কাছে দীর্ঘ সময় পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া। তারপর মা–বাবার কাছে পড়া, পড়া আর পড়া।

এখানে একটি বিষয় এড়িয়ে গেলে চলবে না আর তা হলো, যারা world class খেলোয়াড় হতে চায়, তাদের activities সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে ভিন্ন। কারণ, এলিট স্পোর্টসে দরকার প্রচুর মোটিভেশন, ডেডিকেশন, সাফার ও অফার। যেহেতু কথায় রয়েছে Winner takes it all so one must work harder than others. এ ক্ষেত্রে এলিট ক্রীড়াবিদদের জীবনের কিছু মজার সময় তারা মিস করে বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য। ঠিক তেমনিভাবে যদি কেউ এলিট শিক্ষার জন্য পুরো সময় ইনভেস্ট করতে চায়, যেমন শুধু ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার কারণে জীবনের দুই–তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করে, তখন দেখা যায় তারা শৈশব ও কৈশোরের অনেক কিছু মিস করেছে, যা পরে হাজার চেষ্টা করলেও সেটা পূরণ করা সম্ভব হয় না।

এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় দরকার সুন্দর পরিকাঠামোর। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পুরো সময়ের ওপর সুন্দর ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। কারণ, মানবজীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবন একবারই আসে বারবার নয়, এ বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। একদিন শিশুর শৈশব, কৈশোর শেষ হয়ে যাবে, জীবনের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবন শুরু হবে। তখন টাকা পয়সা, গাড়ি, বাড়ি সবই হবে, তবে জীবনের পরিপূর্ণতা হয়তো আসবে না!

ইউরোপের শিক্ষায় রয়েছে সুশিক্ষা, সুচিন্তা, সুভাবনা। যেখানে কোনো কিছুই বাদ দেওয়া হয় না। সবকিছুই রয়েছে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থায়। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে চাই সেটা হলো, ইউরোপের শিক্ষা পদ্ধতি সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ার এক চাবিকাঠি।

বাংলাদেশ তার শিক্ষা পরিকাঠামোকে এমন করে তৈরি করতে পারবে বলে আমি মনে করি। সেই সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রাখতে পোলো দিয়ে মাছ ধরা শিখতে হবে। মাদক সেবন থেকে নতুন প্রজন্মকে দূরে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানে সাহায্য করতে হবে। সারা দিন পরিশ্রমের পরও সমাজের আর দশ জনের কথা ভাবতে হবে, এলাকার শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে। সুশিক্ষায় গড়ে ওঠা একজন মহান মানুষ নিজেকে অভিহিত করা হয়তো খুব বেশি কিছু নয়। যারা সত্যিকারের ভালো মানুষ তারা এমনই হয়! দেশের প্রতিটি গ্রামে যদি এ ধরনের হাজারো মানুষের দৈনিক শিক্ষার প্রতিফলন হয়, তাহলে অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা এবং ধর্ম, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করা ও একই সঙ্গে ভণ্ডামি ও অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ ও জাতির খেদমত করা সম্ভব। কারণ, সুইডেনের শিক্ষাব্যবস্থায় সুইডিশ জাতির জাতীয় সংগীতের প্রতিশ্রুতির ওপর দৈনিক শিক্ষার বেস্ট প্র্যাকটিস রয়েছে।

আমাদের প্রতিদিনের সেই কমিটমেন্ট, যা আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সুইডেনের মতো মানুষ আমাদের সমাজে প্রয়োজন, যাঁরা পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে দৈনিক শিক্ষার বেস্ট প্র্যাকটিসের সমন্বয় ঘটিয়ে সুশিক্ষার জন্য কাজ করবেন। অরাজকতা, কুশিক্ষা ও দুর্নীতি ধ্বংস হোক, মানবতা এবং দৈনিক শিক্ষার সমন্বয়ে জয় হোক সুশিক্ষার। কারণ, Well and all round education is the global passport to the future, for tomorrow belongs to those who prepare for it today.