বাঙালির আত্মঘাতী সংস্কৃতি

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ নামে বহুল পঠিত একটি বই আছে। বইটিতে নীরদ চৌধুরী আত্মঘাতী বাঙালীর স্বরূপ সন্ধান করেছেন। গোটা বঙ্গভূমি এবং বাঙালি সমাজ আগে কী অবস্থায় ছিল, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ধীরে ধীরে সুউচ্চ চূড়ায় আহরণ করার পর বর্তমানে কোথায় এসে নেমেছে, তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।

বাঙালি জীবনে দুটি বিষয় ব্যাপক প্রধান্য বিস্তার করে আছে, রমণী ও রসনা। তবে রসনাকে বাঙালি যতটুকু প্রাধান্য দেয়, রমণীকে রাখে ততটুকু আবছা ছায়ায়। রসনা বা ‘রসনা বিলাস’ অর্থাৎ জিবের আনন্দ উপভোগ করা, অর্থাৎ খাবার বা স্বাদের মাধ্যমে সুখ ও আনন্দ লাভ করা। এখানে ‘রসনা’ বলতে জিব বা স্বাদ গ্রহণকারী ইন্দ্রিয়কে বোঝায় এবং ‘বিলাস’ বলতে আরাম, সুখভোগ বা শৌখিনতাকে বোঝায়। তাই একসঙ্গে ‘রসনা বিলাস’ বলতে বোঝায় সুস্বাদু ও শৌখিন খাবার উপভোগ করার মাধ্যমে জিবের তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ করা। এই জিবের তৃপ্তি বাঙালির এক আত্মঘাতী সংস্কৃতি। মনে হয় আদিকাল থেকে বাঙালির উদ্ভাবনী বুদ্ধি উদরেই আটকে আছে। উদর থেকে ঊর্ধ্বে উঠছে না।

প্রাচীন বাংলার মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতামৃত থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলার নারী চরিত্রগুলো খুবই মমতাময়ী। প্রত্যাশিতজন বাড়ির আঙিনায় প্রবেশমাত্রই রান্নাঘরে লুচি, বেসম ব্যঞ্জন রন্ধনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নারীরা। শরৎ সাহিত্যের নারীরা এদিক দিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। এখানেও প্রধান্য পেয়েছে উদর।

আমার ছোট মামা ছিলেন খুবই শৌখিন খাদ্যবিলাসী।

বিশাল জায়গাজমি লোক–লস্কর নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। আমরা স্কুল ছুটির ফাঁকে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে তাকে সঙ্গ দিতাম। ধানি জমি থেকে ধান–চাল আসত, চষা খেত থেকে আসত তরিতরকারি, গরুর গোয়াল থেকে আসত খাটি গরুর দুধ, খাটি গাওয়া ঘি, মাখন ও মাংস। পুকুর অথবা বিল থেকে আসত বিভিন্ন ধরনের তাজা মাছ। ভাপ ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে ঘি খাওয়া ছিল মামার খাদ্যবিলাস। শেষ বয়সে স্থূলতার কারণে খুব একটা চলাফেরা করতে পারতেন না। তার ওপর রোগশোক ঝাঁপিয়ে পড়ে দেহের ওপর। অল্প বয়সেই বিছানা নিলেন। শেষ সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, বলেছিলেন, ‘আমি খেতে খেতেই মারা গেলাম।’ খনার বচনেই আছে, ‘উনা ভাতে দুনা বল, অতি ভাতে রসাতল’। খাদ্য জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন, তবে অতিরিক্ততায় বুদ্ধি–বিবেক উদরেই নাশ হয়ে যায়।

উদরের প্রতি আগ্রহ আধুনিক কালেও থেমে নেই।

আমার এক বন্ধু দেশ ভ্রমণে প্রচুর আগ্রহ। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া চষে বেড়ান। মাঝেমধ্যেই বন্ধুবান্ধব সহকারে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। যখনই ভ্রমণে বের হন, তখনই আগ্রহ জাগে হয়তো নতুন কোনো তথ্য পাব। ভিন্ন দেশের ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ইতিহাস জানতে পাব। কিন্তু না, তার ফেসবুকের পাতাজুড়ে শুধু খাবার আর খাবার। কোথায় কালাভুনা মাংস পাওয়া যায়, কোথায় গরুর পায়ের নেহারি, জবজবে তেলে কষানো গরুর ভুঁড়ি, কোথায় চকচকে ইলিশের ডিমভাজি, এসবের হাঁড়িপাতিলসহ ছবি। আমার রাগ ওঠে না, তবে হতাশ হই। কারণ পৃথিবীতে অস্ত্র দ্বারা যত মানুষ মরে, তার চেয়ে অধিকসংখ্যক মানুষ মরে অতিরিক্ত আহার ও পানক্রিয়ায়।

আমাদের দেশে রান্নার প্রণালি নিয়ে যতগুলো বই আছে, ততগুলো বিজ্ঞানের বই নেই। যতগুলো সাহিত্য পত্রিকা আছে ততগুলো বিজ্ঞান সাময়িকী নেই। যতসংখ্যক কবি আছেন ততসংখ্যক বিজ্ঞানী নেই। আমরা যেন উদরেই আটকে আছি, ব্রেন অবধি উদ্ভাবনী শক্তি পৌঁছানোর ধমনিটা ব্লক হয়ে গেছে। বছরের অন্যান্য দিন যেভাবেই কাটাই না কেন, পয়লা বৈশাখ এলেই আমরা এক অনন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই যে আমরা কে কত বড় বাঙালি। সারা বছর পিৎজা, বার্গার নিয়ে টানাটানি করলেও ওই দিন আমাদের পান্তাভাত খাওয়া চাই–ই চাই। হতাশ হই, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পয়লা বৈশাখে পান্তা–ইলিশ হবে নাকি ইলিশ–পান্তা হবে, তা নিয়ে বিস্তর তর্কে লিপ্ত হন। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হয়ে গেছে তবুও আমরা পান্তা–ইলিশ, ইলিশ–পান্তা বিতর্ক থেকে বের হতে পারিনি।

আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।

কিন্তু আমরা তো বন্দুকের একটা গুলিও বানাতে পারি না, ধার করা গুলি দিয়ে কী দেশ রক্ষা হয়? অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের নাম শুনেই নাকি থানার সিপাহসালাররা পালিয়ে গেছে, এমন যুদ্ধে তো গুলির প্রয়োজন থাকার কথা না। মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে আমরাও দৌড়াদৌড়ি করেছি, কিন্তু বন্দুক–গুলি–গ্রেনেড ছাড়া কোনো কিছু সম্ভব হয়নি। আমাদের গোলা বারুদ তৈরির কারখানা গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি চীনের সহায়তায় স্থাপিত হয় ১৯৭০–এ। ৭১-এ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি কোনো উৎপাদনেই যেতে পারেনি। কাজেই ধার করা বন্দুক, গ্রেনেড দিয়েই আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পরও কি আমরা দেশরক্ষার জন্য সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করতে পারছি? আমরা যদি উদরেই আটকে থাকি, তাহলে এগুলো করব কখন? খাবারের প্রতি এক অদ্ভুত আর্কষণ নিয়ে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে একটি টিভি সিরিজ। ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ সিরিজটি বিপুল সাড়া ফেলেছে। দর্শকেরা হুমড়ি খেয়ে দেখেছেন ‘বোয়াল মাছের ঝোল’, ‘খাসির পায়া’ ‘হাঁসের সালুন’ পর্বগুলো।

আমাদের ঘরে ঘরে আজ টেলিভিশন, ওয়াস মেশিন, ডিশ মেশিন, ফ্রিজ, হাতে হাতে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ঘড়ি, ক্যামেরা স্যামসং সামগ্রী। স্যামসং দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি। দক্ষিণ কোরিয়া টেলিভিশান ল্যাপটপ ছাড়াও গাড়ি, সমুদ্রগামী আধুনিক জাহাজ, অ্যারোস্পেসসামগ্রী তৈরি করে এক যুগান্তকারী কার্যক্রম সৃস্টি করেছে। স্বাধীনতার ২৪ বছরের মধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়া শিল্পে অভূতভাবে এগিয়ে গেছে আর আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছরে উদর নিয়েই পড়ে আছি।

শোনা যায় মেট্রোরেল তৈরিতে দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার বা স্থপতিদের কোনো ভূমিকা নেই। পুরো স্থাপনা তৈরি করে দিয়ে গেছে বৈদেশিক কোম্পানি। এমনকি রংতুলির কাজগুলো করেছেন বিদেশিরা। যদি এমন হয়েই থাকে, তাহলে তা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। আমাদের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়াররা পারেন না তা নয়, তাঁদের সুযোগ দেওয়া হয় না। তাই তো তাঁরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন বিসিএস ক্যাডার হতে। আর সেখানে গিয়েই দেশের তরুণেরা যা তৈরি করতে পারেন, সেটাও বিদেশ থেকে কিনে আনেন। বিদেশ থেকে কিনে আনাটাই লাভজনক, সহজেই কিছু ডলার পকেটে আসে।

দেশপ্রেমেও আমাদের জুড়ি নেই। সারা বছর কোনো খবর না থাকলেও ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর দেশপ্রেমের ঠেলায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এই দিনগুলো না এলে আমরা বুঝতেই পারতাম না যে আমাদের দেশ দেশপ্রেমিকদের এক হোলসেল ডিপো। আমরা যে এক আত্মঘাতী পথে এগিয়ে চলেছি, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। যদি দেশ শক্তিশালী না হয়, তোমার ঘরও নিরাপদ নয়, যদি চরিত্র দুর্বল হয়, কোনো পতাকাই তোমাকে রক্ষা করবে না।