‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’
১৯ জুলাই। হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণদিবস। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। মনটা অসম্ভব উদাস হয়ে আছে আমার। এমন সময় ছোট ভাই সকালের ফোন। কী করছ, আপু? বললাম, তেমন কিছু নয়, বৃষ্টি দেখি। তুমি কী করছ সকাল? আজ ডিউটি নেই?
সকাল একজন পুলিশ অফিসার। অল্প বয়সে অনেক সুনাম কুড়িয়েছে কাজে। হঠাৎ আমার সঙ্গে তার পরিচয় কোনো এক বইমেলায়। সেই ছোটবেলা থেকে বই পড়া আমার নেশা। হুমায়ূন আহমেদ তাতে যোগ করেছেন স্বপ্ন আর আনন্দের অপরূপ সুর। অন্য প্রকাশের স্টলে সেদিন বেলা দুইটা থেকে বসে আছি। বই কিনব। অটোগ্রাফসহ। লেখক হুমায়ূন আহমেদ আজ আসতেও পারেন। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সন্ধ্যা হয়ে এল প্রায়। তাঁর দেখা নেই। নতুন বইগুলো কিনে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলেছি বাসার পথে। কোনো কারণ ছাড়াই ভয় ভয় লাগছে। তাড়াহুড়া করে হেঁটে যাচ্ছি বলেই হয়তো পাশ থেকে প্রচুর টিপ্পনী শুনতে পাচ্ছি। সদ্য চিকিৎসক হয়েছি। অতিরিক্ত সাহসী হওয়ায় নিজের গালে চড় দিতে ইচ্ছা করছে। এমন সময় দেখলাম, পাশে পাশে হাঁটছে কেউ। পরনে পুলিশের পোশাক। বলল, আপু, ভয় পাবেন না। আমরা আছি না? বাকি পথটুকু কেটে গেল নির্বিঘ্ন। সেই হাসিখুশি পুলিশ সদস্যই সকাল। হাঁটতে হাঁটতে জেনে নিলাম ওর পরিচয়। জানলাম, আমারই মতো হুমায়ূন স্যারের গল্প, উপন্যাস, নাটক , সিনেমা, ভ্রমণকাহিনিসহ সবকিছুর জন্য পাগল। রিকশা ঠিক করে দিল বাসায় যাওয়ার। ওকে জানালাম, হুমায়ূন স্যারের অটোগ্রাফসহ একটা বই নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। সকাল বলল, আপু, আমি তো আছি, ঠিকানা আর টাকা দিয়ে যান, পাঠিয়ে দেব। ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ বইটা স্যারের অটোগ্রাফসহ সকাল ঠিকই পোস্ট করেছিল। সেই থেকে পরিচয়।
আমার বিয়ের সময় ‘তিথির নীল তোয়ালে’ বইটা উপহার দিয়েছিল সকাল। আবীর, আমার স্বামী তখন সদ্য পাস করেছে আমারই মতো। ওর বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা দেখে বিয়ে প্রায় ভেঙে যায় যায় অবস্থা। তখন নীল তোয়ালেতে মুখ লুকিয়ে কত কেঁদেছি আমি। ভালোবাসার কাছে অনিশ্চিত জীবনের ভাবনা হার মেনেছে।
যাক, সকালের কথা বলছিলাম। হুমায়ূন স্যারের বইয়ের অনেক চরিত্রের সঙ্গে ওর খুব মিল। ‘তেতুল বনে জোছনা’ বইয়ের নায়ক চিকিৎসক আনিসের মতো গ্রামে পোস্টিং ওর। অভিজাত ঘরের নবনীর মতো মিষ্টি মেয়েকে বিয়ে করে ঢাকায় রেখে গেছে সে। দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করা। বিদেশে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষের সেবা করব বলে সকাল কোথাও গেল না। মন খারাপ করে সকাল তখন বলত, আপু, নদীর পাশে জোছনাবিলাস করার সাথি বোধ হয় হারালাম। তারপর মাস ছয়েক আর কোনো যোগাযোগ নেই। তারপর মেঘলা এক বিকেলে সকাল ফোন করে জানাল, ওর বউ চলে এসেছে ওর কাছে। ওরা দেশেই থাকবে।
হিমুর মতো কিছু কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা সকালেরও মনে হয় আছে। যেবার সিঙ্গাপুরে হৃদ্রোগের চিকিৎসার জন্য স্যার গেলেন, সেবার এত টেনশন হচ্ছিল, অথচ সকাল মুখস্থ বলে দিল, স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে তাদের দারুচিনি দ্বীপে ঘুরে, সেন্ট মার্টিনের মাটির ঘরে জোছনা দেখে। শুভ্রর মতো সাদাসিধে, কানা বাবার মতো এক ছেলে ওদের। মিসির আলীর মতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে কত সমস্যার সমাধান সে করে। একবার নাকি সত্যিকারের বাকের ভাইয়ের মতো একজনের দেখা সে পেয়েছিল। তবে ‘কোথাও কেউ নেই’–এর মতো এই বাকের ভাইকে বিপদে পড়তে সে দেয়নি। তার ভালোবাসার মুনা নাকি বাস্তব জীবনে বাকের ভাইয়ের সঙ্গে সুখে সংসার করছে।
তবে তার চাকরিজীবনের সবচেয়ে সফল ঘটনা ঘটেছিল যশোরে। লোকমুখে শুনেছিল, শহরে একটা অল্প বয়সী মেয়ে আছে, যে মা হয়েছে কয়েক মাস হলো। মা হওয়ার আগপর্যন্ত পড়াশোনা, কাজকর্ম সবকিছুতেই সে চৌকস ছিল কিন্তু মা হওয়ার পর কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছে। আমি শুনে বললাম, সকাল, হয়তো তার ডিপ্রেশন হয়েছে, একটু ডাক্তার দেখাতে বলবে। সকাল নাকি তার আপনজনকে ডাক্তার দেখাতে বলেছিল। কিছুদিন পর মেয়েটা আরও অসুস্থ হয়ে যেতে লাগল, অথচ চিকিৎসাধীন অবস্থায় এমন তো হওয়ার কথা নয়। মিসির আলীর কথা চিন্তা করে সকাল নাকি একজন নারী পুলিশ কনস্টেবলকে ছদ্মবেশে ওই বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছিল। মাসখানেক পর ওই কনস্টেবলই ওই নারীর স্বামীকে হাতেনাতে ধরেছে খাবারে অল্প পরিমাণ কীটনাশক মেশানোর সময়। কী আনন্দ তার সেদিন। আমার কাছেই অবাক লেগেছিল শুনে, এই মানুষের কেউ কেউ ফেরেশতার মতো আর কেউ সাক্ষাৎ শয়তান। কেমন করে সম্ভব।
হিমুর মতো কিছু কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা সকালেরও মনে হয় আছে। যেবার সিঙ্গাপুরে হৃদ্রোগের চিকিৎসার জন্য স্যার গেলেন, সেবার এত টেনশন হচ্ছিল, অথচ সকাল মুখস্থ বলে দিল, স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। অথচ হুমায়ূন আহমেদ অসুস্থ হওয়ার পর আমেরিকায় চিকিৎসা করতে গেলেন, কেমো নিলেন, সফল অস্ত্রোপচারের পর বাসায় গেলেন, সকাল বলে দিল, আপু, উনি কিন্তু আর ফিরছেন না দেশে। স্যার হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন, সেটা আমরা জানলাম। কঠিন কষ্ট হয়েছে জেনে, যেদিন উনি ‘মেঘের ওপর বাড়ি’তে চলে গেছেন। তাঁর বই প্রায় সবই আছে সংগ্রহে। বারবার পড়ি, অথচ তিনি নেই। মনে হয়, এই তো সেদিন কতগুলো নতুন বই নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। পৃথিবীর সব সম্পদ দুই হাতে ধরে।
আজ সকালের ফোন পেয়ে বললাম, আজ ছুটি আমার, সকাল। সকালেরও নাকি কাজ নেই। বলল, চলো আপু, সবাইকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে যাই। দুই পরিবারের সবাই হলুদ পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরবে, হিমুর মতো, বাচ্চারাও বাদ যাবে না। স্যার তো বলেই গেছেন,
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো এক বরষায়।’
তাঁকে আমরা দেখতে পাব না কিন্তু তিনি যে আছেন জীবনে মিশে। নয়ন তাঁকে পাবে না দেখতে কিন্তু তিনি তো রয়েছেন নয়নে নয়নে।