কলকাতার সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুসন্ধান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ ইতিহাসচর্চায় ক্রমে বাড়ছে রাজনৈতিকীকরণ। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের অর্ধশতক পেরিয়ে এমনটাই মনে করছে এপার-ওপার দুই বাংলারই প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ। তাদের উষ্মা, ইতিহাসচর্চায় অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ হয়ে গেছে। ফলে ইতিহাসচর্চায় সাধারণ মানুষ কিংবা তরুণদের আগ্রহ কম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে এখন কে কবে ঘোষণা করেছেন, কোনো নেতা কোনো তারিখে কী বলেছেন, এটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই ইতিহাসে সাধারণ মানুষ যেন কিছুটা উপেক্ষিত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের আবহে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছিল মানুষের ত্যাগের কথা, ক্ষুদ্র রাজনীতির বেড়াজাল ভেঙে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আর্তি। স্পষ্টতই এ ঘূর্ণিপাক থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন আরও বেশি করে মানুষের কথা তুলে ধরা, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-যুবাদের লড়াইয়ের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। এ ইতিহাসচর্চার আকর উপাদান হতে পারে সমকালীন সংবাদপত্র।

১২ জুলাই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশেষ বক্তৃতা সভায় উঠে এল তেমনই এক মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ, যেখানে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ। আলোচনার শুরুতে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক ইতিহাসচর্চায় সংবাদপত্রের গুরুত্ব। সেই সূত্র ধরেই মুখ্য বক্তা অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু এড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ শুধু কঠিন নয়, একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সেই অপূর্ণতাকেই পূর্ণ করেছিল কলকাতা থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দুই জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর। শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, সেই সময় এই দুই পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো একের পর এক রোমাঞ্চকর প্রতিবেদন। সেখানে কখনো উঠে আসত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অকুতোভয় কলকাতার ছাত্রদের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের কাহিনি, আবার কখনো জায়গা করে নিত পাকিস্তানি সরকারের আধিকারিক হয়েও ভারতীয় ভাইদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এক মহকুমা শাসকের ভালোবাসায় মোড়া আবেদন। রাজনৈতিক চর্বিতচর্বণের বাইরে এমন আখ্যানের অনুসন্ধানই আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় বড় বেশি করে প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানের সমাপ্তির ভাষণে এ প্রয়োজনীয়তার কথাই তুলে ধরেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অলক কুমার ঘোষ। ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের প্রাঞ্জল উপস্থিতি এবং অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন রেখে গেল এমন বক্তৃতার সার্থকতা ও আশু প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত।