বাড়ির নাম শাহানা-পাশের বাড়ির মেয়েটার গল্প

‘বাড়ির নাম শাহানা’ সিনেমায় দীপা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনান সিদ্দিকাছবি : প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

অনেক দিন হয়ে গেল লেখালেখি থেকে দূরে। কিন্তু এই ছবিটা দেখে মনে হলো এটা নিয়ে না লিখলে অবিচার হবে। ছবির শো ছিল রোববার বেলা সাড়ে তিনটার সময়। আমি সাধারণত রোববার কোনো ব্যস্ততা রাখি না, কারণ সোমবার আবার অফিস আছে। তাই রোববার এই সময়টা ভাত খেয়ে একটা ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস দীর্ঘদিনের। সেই মোতাবেক আজও ঘুমাতে গেলাম, কিন্তু গিন্নিকে বলে রাখলাম, তিনটার সময় জাগিয়ে দিতে। আমাদের বাসা থেকে সিনেমা হলের দূরত্ব ৩০ মিনিটের ড্রাইভ। গিন্নি তিনটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই জাগিয়ে দিল। উঠে তৈরি হয়ে যেতে যেতে কয়েক মিনিটের দেরি হয়ে গেল।

হলে ঢুকেই প্রথম যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল সেটা হলো দীপাদের পরিবারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মামা–মামি তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। সেই লোকের আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। আর এদিকে দীপাও ১৭ বছর বয়সে একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, তাই এর চেয়ে ভালো ছেলে পাওয়া সম্ভব না। উপরন্তু, ছেলে থাকে বিদেশে। এই সব কথাবার্তা দীপা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে শুনছে। এরপর ছবির কাহিনি এগিয়ে চলল নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। আর তার সাথে এগিয়ে চলল দীপার গল্প। পাশাপাশি এগিয়ে চলল দীপাদের পরিবারের গল্পও। আর এর সবকিছুই এগিয়ে চলল দীপাদের বাড়িটাকে কেন্দ্র করে, যার নাম-শাহানা বাড়ি।

এই ছবি দেখতে গিয়ে ভীষণ রকমের স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হয়ে গেলাম। যখন দীপা বাসে করে কর্মস্থলে যাচ্ছিল, তখন যে সেতুর ওপর দিয়ে বাসটা যাচ্ছিল, সেটার সাথে আমার তারুণ্যের অনেক স্মৃতি জড়িত। এখনো দেশে গেলে আমি সব সময় ফেরির পথের টিকিট কাটি বাচ্চাদের ফেরির পরিবেশটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। ফেরি পার হয়ে বাসটা এই সেতু পার হয়ে আমাদের জেলা শহরে প্রবেশ করে। এ ছাড়া যেসব ঘরবাড়ির ছবি দেখানো হয়েছে, সেগুলো আমাদের দেশের নব্বই দশকের আটপৌরে জীবনের প্রতিচ্ছবি। ছবিতে দেখানো প্রতিটি জিনিস আমাদের এবং আগের প্রজন্মকে স্মৃতিকাতর করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

কোথা থেকে শুরু করব। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে একজন পত্রিকা পড়ছে আর বাকি সবাই মনোযোগী শ্রোতা। সেখান থেকে সরু পথ পার হয়ে শাহানা বাড়ি। বাড়ির সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই ইটের সলিং করা রাস্তা। তারপর বারান্দা। এক পাশে কলপাড়। বারান্দার সামনেই উঠানে পড়ে আছে একটা স্টিলের ফ্রেমের চেয়ার। ছোট বারান্দার এক পাশে ডাইনিং টেবিল। বাড়ির পেছনে ছোট একটা সবজি আর ফুলের বাগান। তার মধ্যেই একটা পাতকুয়া। এ যেন নব্বই দশকের একটা বাড়ির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। বাড়ির সদস্যদের দিকে নজর দেওয়া যাক। বাবা, মা, ভাই আর দীপা। এই নিয়ে ছোট একটা পরিবার। বাড়িতে আছে একজন কাজের সাহায্যকারী মেয়ে।

প্রতিবেশীদের আছে দুরবিন দৃষ্টি। পাড়ায় আরও আছে সুখময়। যার অকালে বউ মরে গেছে। দীপাদের বিপদ–আপদে সব সময়ই হাজির থাকে এই সুখময়। তাই দীপার মা তাকে অত্যধিক স্নেহ করেন। দীপার বড় মামা তাদের পরিবারের কর্তা। মামি তার অর্ধাঙ্গিনী। তারাই দীপাদের পরিবারের ভাগ্যের নিয়ন্তা। এ ছাড়া কিছু সময়ের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে প্রবাস জীবনের বাস্তবতা। একজন প্রবাসী হিসেবে এই অংশটা খুবই রিলেট করতে পেরেছি। খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই প্রবাস জীবনের একটা বাস্তব চিত্র দেখানো হয়েছে। অবশ্য ছবির শেষে বিষয়টা বলাও হয়েছে। বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত।

এইবার আসি পারিপার্শ্বিকের বিবরণে। এই ছবির সেট নির্মাণ এত নিখুঁত। যাঁরা দেখবেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একবাক্যে স্বীকার করবেন। রান্নাঘরের মাছ কুটা। বিদ্যুৎ চলে গেলে হারিকেন জ্বালিয়ে দেওয়া। টিভিতে সেই সময়ের অনুষ্ঠান দেখানো। যেমন সেই সময়ের বিতর্ক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ম্যাক গাইভারের আবহসংগীত আপনাকে সেই সময়ে ফিরিয়ে নেবে। দেয়ালের চুনকাম যেন গায়ে না লাগে, তার জন্য দেয়ালের গায়ে দৈনিক পত্রিকা লাগানো। ঘরের জানালায় আটপৌরে পর্দা। সুখময় খেতে বসে খেজুরের পাতার পাটিতে। আর দীপা বসে কাঠের পিঁড়িটা টেনে নিয়ে। পাড়ার দোকানে পাওয়া যায় চা আর নিমকি বিস্কুট যেটাকে আবার ইংরেজিতে বলে বিস্কিট। পাড়ার সরু গলির পাশে খোলা ড্রেন।

জিন ছাড়াতে আসা ওঝার গলাবাজি। পরিদের বাড়ি যাওয়ার পথে খেতের মধ্যের আলের দৃশ্য। সেটা পার হয়ে বাঁশঝাড়ের নিচের পথ। পরিদের মাটির দেয়ালের বাড়ি। দীপার মামার পুকুর। সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য। গ্রামে ডাক্তার কেউ গেলেই তাকে দিয়ে প্রেশারটা মাপিয়ে নেওয়া। পরির একমাত্র সম্বল একটা কাচের মার্বেল। বাড়ির কাজের মেয়ের কণ্ঠের গীত। কানে হেডফোন লাগিয়ে ওয়াকম্যানে গান শোনা। এর বাইরে আছে হৃদয়স্পর্শী আবহসংগীত। আমার ধারণা পরিচালক ইচ্ছা করেই আবহসংগীতে সুরের আধিক্য না রেখে খালি গলার গানকে প্রাধান্য দিয়েছেন সময়টা ধরার জন্য।

আমি ইচ্ছা করেই গল্পটার কথা এড়িয়ে গেলাম। আমি শুধু ছবিটার একটা প্রতিচ্ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম। আসলে আমার শব্দভান্ডার অতি সীমাবদ্ধ, তাই হয়তোবা অতটা প্রকাশ করতে পারলাম না, যতটা অনুভব করেছি এবং করছি। এই ছবি আমার মনে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে। বলা হয়ে থাকে আমরা একবারই বাঁচি শৈশবে। আর বাকিটা জীবন পার করি শৈশবের স্মৃতিচারণা করে। আমি বলি স্মৃতির জাবর কেটে। তাই এই ছবিটা আমাদের প্রজন্মকে স্মৃতির ভেলায় ভাসাবে নিশ্চতভাবেই। আর ছবিটা দেখার পর খুব আফসোস হলো পরবর্তী প্রজন্মকে সাথে না আনার জন্য। এই ছবিটা আমি আরও বারবার দেখতে চাই পরবর্তী প্রজন্মকে সাথে নিয়ে। ওরা দেখুক, জানুক কেমন ছিল আমাদের সময়টা।

আমি তাই এই ছবিটা অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসার জন্য স্ক্রিনস্কোপ এবং দেশি ইভেন্টসকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমি এখন রিলেট করতে পারছি কেন এই ছবিকে বাংলাদেশ থেকে অস্কারে পাঠানো হয়েছে। কারণ, এই ছবিতে বাংলাদেশের একটা সময়ের বাস্তব খণ্ড চিত্র দেখানো হয়েছে। আমি কোনো সিনেমাবোদ্ধা বা সমালোচক নই। এই ছবিটা দেখে আমি যেটুকু অনুভব করেছি তার কিঞ্চিৎ অংশ প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম শুধু। আমার তাই সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে হলে গিয়ে সপরিবার ছবিটা দেখুন। নিজে ভাসুন স্মৃতির সাগরে আর বন্ধন তৈরি করুন পরবর্তী প্রজন্মের সাথে।

সংবাদ সম্মেলনে ‘বাড়ির নাম শাহানা’ টিম
ছবি: নাজমুল হক

ইদানীংকার বাংলা নাটক, ছবি যা–ই দেখি মনে হয় দেশটা যেন অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তার মধ্যে এমন বিশুদ্ধ বিনোদন খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে বিনোদনের অনেক মাধ্যম আছে। কিন্তু দিন শেষে যেটা মনের মধ্যে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসে, সেটাই আমাদের মনে থাকে। এই ছবি নিশ্চৎভাবেই আমাদের মনে দাগ কাটবে। আর পরবর্তী প্রজন্ম অনেক প্রশ্ন করবে, এটা কী, ওটা কী? ওরা কেন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিল। কেন প্রতিবাদ করল না। ওরা জানবে একসময় আমাদের জীবন কেটেছে কোনো প্রকারের ডিভাইস ছাড়া। ওরা দেখবে চাপকল থেকে শুরু করে পাতকুয়া।

পরিশেষে এই ছবির সাথে যুক্ত প্রত্যেককে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ এমন পরিচ্ছন্ন একটা বিনোদনের ব্যবস্থা করার জন্য। আপনাদের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র এগিয়ে যাক। বিশ্ব দরবারে আসন করে নিক।

*লেখক: মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

দূর পরবাস–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]