কানাডায় স্কুল: শেষ কনসার্ট এবং কৃতজ্ঞতা
স্কুলজীবনের শেষ কনসার্ট হয়ে গেল ছোট মেয়ে দিঠির। ধরতে গেলে সেই সঙ্গে শেষ হয়ে গেল মা–বাবার সঙ্গে স্কুলের সম্পৃক্ততা, যার শুরু হয়েছিল বড় মেয়ে স্বাতীর কিন্ডারগার্টেন শুরুর সময় থেকে। কিন্ডারগার্টেন থেকে হাইস্কুলের শেষ পর্যন্ত প্রতিবছরের শেষে একটা করে কনসার্ট হতো স্কুলে। বেশ কয় বছর পর এই শেষ কনসার্টে গিয়েছিলাম।
এখানকার প্রায় সব স্কুলেই প্রাথমিক শিক্ষার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মিউজিক ক্লাস বাধ্যতামূলক। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কিছুটা ঐচ্ছিক এবং কেউ কেউ চাইলে ব্যান্ড, জ্যাজ ব্যান্ডে যোগ দিতে পারে এবং যেকোনো দু–একটটা যন্ত্র বাজানো শিখতে পারে। সেসব ক্লাসে রেগুলার ক্লাসের চেয়ে বেশি সময় দিতে হয়, বিশেষ করে রিহার্সালের জন্য। বাজেট কমে যাওয়ায় এই সাবজেক্টের শিক্ষককে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক সময় ডোনেশন চান শিক্ষকেরা, তারপরও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ছাত্রছাত্রীদের জন্য। ছাত্রছাত্রীরাও কষ্ট করে লাঞ্চের সময় বা স্কুল শুরুর আগে বা পরে এ ক্লাস করে।
আমার মেয়েরা প্রথম থেকেই তাদের মিউজিক ক্লাস এবং সেই শিক্ষকদেরকে প্রচণ্ড পছন্দ করে। অসাধারণ সব শিক্ষক ওরা পেয়েছিল বিগত এতগুলো বছরে। আমরাও মুগ্ধ, কৃতজ্ঞ, যেভাবে সন্তানের মতো ভালোবাসা দিয়েছেন তাঁরা।
বিশেষ করে ক্লাস টেন থেকে, হাইস্কুলে হঠাৎ করেই পড়াশোনার চাপ প্রচণ্ড রকমভাবে বেড়ে যায় এখানে। টেন, ইলেভেন, টুয়েলভ—এই পুরো তিন বছর ব্যান্ড বা কয়্যারে লাগাতার সময় দেওয়া, দুপুরে না খেয়ে কিংবা ভোরে বা ছুটির পরে সেই ক্লাস করে যাওয়া বেশ কষ্ট সাধ্য। কিন্তু একমাত্র এই শিক্ষককেই ছাত্রছাত্রীরা এই তিন বছর একনাগাড়ে পায়, সে জন্য তাদের সম্পর্কটাও হয় ভিন্ন। অন্য সাবজেক্টগুলোর শিক্ষককে হয়তো মাত্র এক সেমিস্টারেই পায়, তাই তেমন কোনো দৃঢ় বন্ধন তৈরি হতে পারে না। প্রচণ্ড চাপের এ সময়টাতে এই শিক্ষককে দেখেছি নিজ দায়িত্বে ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে, নানাভাবে সহযোগিতা সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। তাই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কৃতজ্ঞতা আমাদের সন্তানদের প্রতিও। আমাদের মতো অনাবাসীদের সন্তানেরা এ দেশে দ্বিতীয় প্রজন্ম। মা–বাবার সংস্কৃতি এবং তাদের নিজেদের জন্মস্থান বা দেশের সংস্কৃতির ভিন্নতা সামলাতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়। বাড়িতে মা–বাবা বেশির ভাগ সময় নিজেদের বেড়ে ওঠার অভ্যস্ততায় জীবনাচরণ করতে থাকেন, সন্তানেরা ঘরের বাইরের সময়টাতে এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে কাটায়—দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে সমঝোতা করে তারা বেশ কষ্ট করেই।
এর মাঝেও তারা ঠিকঠাক পড়াশোনা করে, ভালো রেজাল্ট করে। আমার মেয়েরা তাও স্কুলের কর্মকাণ্ডের বাইরে ভলান্টিয়ার কাজ করা ছাড়া তেমন কিছু করে না। কিন্তু আমি বেশ কয়েকজনকে চিনি, যারা মা–বাবার সঙ্গে সপ্তাহান্তে নিয়মিত বিভিন্ন আয়োজনে যোগ দেয়, কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়, স্কুলের বাইরে নানা ক্লাসে যায়, তারপরও প্রচণ্ড পরিশ্রম করে অনেক ভালো রেজাল্ট করে।
আমি সত্যি অবাক হয়ে যাই, কীভাবে এই ছাত্রছাত্রীরা এত কিছুর পর এত ভালো রেজাল্ট করে। আবার এ শিক্ষকেরা এতটা সময় ও মনোযোগ ছাত্রছাত্রীদের দেন।
আমাদের মায়েরা যেভাবে যত্ন দিয়ে আমাদের লালন–পালন করেছেন, আমরা অতটা সময় ও যত্ন ওদের দিতে পারি না। তারপরও সন্তানদের এ পরিশ্রম কি সব দেশেই বর্তমান প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য!
সব মায়ের পক্ষ থেকে বর্তমান প্রজন্মের সন্তানদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। যেসব শিক্ষক এতটা বছর আমাদের সন্তানদের সুরে-গানে ও ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। স্কুলের এ শেষ কনসার্টে এ সুরেরই অনুরণন উঠেছিল যেন।
*লেখক: আফরিন জাহান হাসি, ক্যালগেরি কানাডা
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]