৬ দিনের ব‍্যাবধানে কানাডার দুটি লেকে ডুবে গেল আমাদের তিনটি উজ্জ্বল তারা

মৃত্যুপ্রতীকী ছবি

কানাডা—দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্ত লেক আর নিঃসঙ্গ বনে ঘেরা। বিশাল এই দেশটির অনেক পর্যটন স্পটগুলোতে পাওয়া যায় না মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক।

ছোট বড় মিলিয়ে দেশটিতে প্রায় ২০ লাখ লেক রয়েছে।

লেক গুলির ২টি ঘটে গেল এমন দুটি ট্র্যাজেডি, যা বাংলাদেশি কমিউনিটির হৃদয়ে বড় ধরনের দাগ কেটে গেল। মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে তিনজন অনন্য মেধাবী ও মূল্যবান বাংলাদেশি প্রাণ হারালেন কানাডার ঠান্ডা পানির গভীরে । লেকগুলোর বরফ গলে গেলেও এখনো পানি প্রচন্ড ঠান্ডা। উল্লেখ্য লম্বা উইন্টার থাকার পর কানাডায় এখন চলছে স্প্রিং এবং ২০ জুন থেকে সামার শুরু হবে ।

দুইজন অন্টারিওর স্টার্জন লেকে ক্যানো উল্টে এবং একজন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ওকানাগান লেকে ডুবে মারা যান ।

স্টার্জন লেক: আনন্দ ভ্রমণের নির্মম সমাপ্তি

৮ জুন, রোববার দুপুর। অন্টারিও প্রদেশের কাওয়ার্থা অঞ্চলের নৈসর্গিক স্টার্জন লেকে একটি কটেজ ভ্রমণে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামান এবং তাঁর বন্ধু আব্দুল্লাহ হিল রাকিব, যিনি ছিলেন Team Group-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিজিএমইএ-এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং Twelve Clothing-এর প্রতিষ্ঠাতা।

তাঁরা দুই বন্ধু একটি ক্যানোতে লেকের পানিতে একটি ক‍্যানো লিয়ে নামেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন এক কিশোর, যিনি পরে সাঁতরে পাড়ে ফিরতে সক্ষম হন। এক সময়ে ক‍্যানো টি উল্টে যায়। ঠান্ডা পানির শীতলতা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা মারা যান।

তাঁদের পরিবারের সদস্যরা তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ কেউ সেই মুহূর্তের ভিডিওও ধারণ করছিলেন—কেউ ভাবতেও পারেননি, মুহূর্তের মধ্যেই সেই হাসিমুখ হয়ে উঠবে স্মৃতির শেষ চিহ্ন।

কারা ছিলেন এই দুইজন?

আব্দুল্লাহ হিল রাকিব শুধু একজন উদ্যোক্তা ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক নতুন ভাবনার প্রবর্তক। পোশাকখাতে অটোমেশন, AI ইন্টিগ্রেশন, ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং নিয়ে যিনি ভাবতেন আগামীর জন্য। তাঁর তৈরি Twelve Clothing এখন বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড।

সাইফুজ্জামান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক অফিসার, অভিজ্ঞ বোয়িং ৭৮৭ ক্যাপ্টেন। কানাডায় এসেছিলেন বড় মেয়েকে দেখতে, যিনি টরন্টোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। জীবনের প্রিয় সময়গুলোর মধ্যে একটি কাটানোর জন্যই এই ভ্রমণ ছিল—যেটি হয়ে গেল তাঁর জীবনের শেষ গন্তব্য।

ওকানাগান লেক: নিখোঁজ প্রতিভা শাশ্বত সৌম্য

মাত্র কয়েক দিন আগে, ২ জুন সকালে, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কেলোনার ওকানাগান লেক থেকে উদ্ধার করা হয় আরেক বাংলাদেশি তরুণ, শাশ্বত সৌম্যর মরদেহ। যিনি ছিলেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্র (সিজিপিএ ৪.০০), পরে শিক্ষকতা করেছেন বুয়েট ও ব্র্যাক-এ এবং উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন আমেরিকার এমআইটি-তে।

ঘটনার কিছুদিন আগেই তিনি কানাডার বিখ্যাত UBC-তে তাঁর AI গবেষণা উপস্থাপন করেন এবং সেখানে কাজের অফার পান। অথচ সেই আনন্দের মুহূর্তও শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় এক মর্মান্তিক শোকে।

মৃত্যুর কারণ এখনও অস্পষ্ট। পুলিশ বলছে, কোনো অপরাধের প্রমাণ মেলেনি।

তিন মৃত্যু, এক অভিন্ন ব্যর্থতা: নিরাপত্তা ও সচেতনতার অভাব

তিনটি ঘটনাই ঘটেছে লেকের পানিতে। আর তিনটিতেই অনুপস্থিত ছিল নিরাপত্তার মৌলিক উপাদান—লাইফ জ্যাকেট।

অনেকের কাছে কানাডার লেক গুলি দেখতে যতটা শান্ত, ভেতরে ততটাই নির্মম। ঠান্ডা পানি শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমিয়ে দেয়। কয়েক মিনিটেই শুরু হয় হাইপোথার্মিয়া, যা অজান্তেই প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অনেকেই ভাবেন সাঁতার জানলেই নিরাপদ, কিন্তু কানাডার ঠান্ডা হ্রদের জন্য ধারণাটি সঠিক নয়। সবচেয়ে অভিজ্ঞরাও প্রস্তুতি ছাড়া অসহায় হয়ে পড়েন। লাইফ জ্যাকেট, আবহাওয়া জ্ঞান, পানির ধরন, এবং নৌকা চালানোর ট্রেনিং—এসব ছাড়াই লেকে নামা মানে একরকম জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনা ।

লেকে নামার আগে যা করনীয় :

  • লাইফ জ্যাকেট পরা নিশ্চিত করা।

  • লেকে নামার আগে আবহাওয়া ও নিরাপত্তা নিয়ম মেনে চলা ।

  • নৌকা বা ক্যানো চালানোর আগে মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহন করা ।

এই তিনজন কর্মময় মানুষ আমাদের মাঝে আর ফিরে আসবেন না । ভবিষ্যতে এ ধরনের মৃত্যু আর না ঘটে সে বিষয়টা সবারই মাথায় রাখা জরুরী।

লেখক: কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটর