বৈশ্বিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস ও ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের জি–২০ বার্তা
বিশ্ব রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে বহুপাক্ষিকতার সংকট ও বৈশ্বিক ক্ষমতার অসম বণ্টন নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জি–২০ সম্মেলনে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা এই সংকটকে আরও স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে। যদিও তাঁর পুরো বক্তব্য প্রকাশিত হয়নি, তবুও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো যে সারমর্ম তুলে ধরেছে, তা থেকে বোঝা যায় যে তিনি বিশ্বব্যবস্থার মৌলিক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
বহুপাক্ষিকতার পতন ও বৈশ্বিক সংঘাতের ছায়া
স্টাবের প্রধান উদ্বেগ হলো বহুপাক্ষিকতার ক্রমাগত দুর্বলতা। তিনি উল্লেখ করেন যে ইউক্রেন যুদ্ধ গাজা পরিস্থিতি ও সুদানের মানবিক বিপর্যয়ের মতো বড় সংকটে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা স্পষ্টভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ সংকটগুলো মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার অকার্যকারিতা তুলে ধরে।
স্টাবের মতে বহুপাক্ষিকতার মূল শক্তি হলো নিয়ম প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় দেশগুলো প্রায়ই লেনদেনভিত্তিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে, যার ফলে আন্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ হ্রাস, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কঠোর শর্ত, ভূরাজনৈতিক দুর্বলতা, সামাজিক সংকট ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ক্ষতি বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে।
অন্যায় ক্ষমতাকাঠামোর সমালোচনা
স্টাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার কাঠামো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সে সময়ের ভূরাজনৈতিক ধারণা এখন আর কার্যকর নয়, তবুও পুরোনো কাঠামো অপরিবর্তিত রয়েছে। এই কাঠামো বর্তমান বৈশ্বিক শক্তিসাম্যের প্রতিফলন ঘটায় না, তাই এটি অন্যায়।
স্টাবের মতে, এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় উঠে আসছে, কিন্তু তাদের প্রতিনিধিত্ব এখনো সীমিত। এই বৈষম্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা দুর্বল করে।
বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা ও ঝুঁকি
স্টাব বলেন যে বিশ্ব এখন বহুমেরু বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে বহু দেশ এবং অঞ্চল প্রভাবশালী ভূমিকা নিচ্ছে। এটি বাহ্যিকভাবে ইতিবাচক মনে হলেও তিনি সতর্ক করেন যে এই বহুমেরুত্ব প্রায়ই লেনদেনভিত্তিক রাজনীতিকে উৎসাহিত করে যা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সহযোগিতার কাঠামোকে দুর্বল করে দিতে পারে।
স্টাবের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শক্তিশালী বহুপাক্ষিক কাঠামো ছাড়া বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা সংঘাত বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই প্রয়োজন শক্তির ভারসাম্য ও নিয়মভিত্তিক নতুন আন্তর্জাতিক কাঠামো।
পশ্চিমাদের প্রতি কঠিন বার্তা
স্টাব খোলাখুলিভাবে বলেন যে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকার করতে হবে যে তারা আর আগের মতো বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে না। বিশ্ব এখন এমন পর্যায়ে, যেখানে কোনো শক্তিই এককভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবে না। তাই পশ্চিমাদের প্রয়োজন ক্ষমতার বণ্টনে উদারতা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা। তিনি সতর্ক করেন যে যদি পশ্চিমারা সংস্কারের পথে না হাঁটে তাহলে তারা নিজেরাই বৈশ্বিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক হয়ে যেতে পারে।
শান্তি প্রচেষ্টায় সক্রিয় ভূমিকা
স্টাব শুধু সমালোচনা করেননি, তিনি সমাধানের পথও দেখিয়েছেন। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে সংলাপের আয়োজনের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন। যদিও এটি বিতর্কিত একটি প্রস্তাব, তবু এতে বোঝা যায় যে তিনি বৈশ্বিক উত্তেজনা কমাতে সম্ভাব্য সব পথ খুঁজে দেখতে আগ্রহী।
বিশ্লেষণ
স্টাবের বক্তব্য এমন সময়ে এসেছে যখন বৈশ্বিক বিভাজন স্পষ্টভাবে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন রাশিয়া ইউরোপ ও গ্লোবাল সাউথের সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য একটি শক্তিশালী নিয়মভিত্তিক কাঠামোর প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
বক্তব্যের তিনটি মূল তাৎপর্য
প্রথমত, ক্ষমতার ন্যায্য বণ্টনের প্রশ্ন ভবিষ্যতের বিশ্বব্যবস্থা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দ্বিতীয়ত, বহুপাক্ষিকতার দুর্বলতা থেকে তৈরি হওয়া সংঘাতের ঝুঁকি তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
তৃতীয়ত, ফিনল্যান্ডের মতো ছোট দেশও বিশ্ব রাজনীতিতে নৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারে, স্টাবের বক্তব্যে তা প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট স্টাবের বার্তা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। তাঁর বক্তব্য প্রমাণ করে যে ন্যায় ভারসাম্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে নতুন করে বৈশ্বিক কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। ক্ষমতার নতুন পুনর্বিন্যাসের সময়ে যদি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা সংস্কার না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ আরও অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
জি–২০ কী
এটি একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যা অর্থনৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। এটি ১৯৯৯ সালে এশীয় আর্থিক সংকটের পর একটি সংলাপ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই হাজার আট সাল থেকে এটি শীর্ষ নেতাদের আলোচনার মঞ্চে পরিণত হয়। এর কোনো স্থায়ী সেক্রেটারিয়েট নেই এবং প্রতিবছর প্রেসিডেন্সি পরিবর্তিত হয়। ট্রায়োকা পদ্ধতিতে বর্তমান, পূর্ববর্তী ও আগামী প্রেসিডেন্ট দেশ একসঙ্গে কাজ পরিচালনা করে।
উদ্দেশ্য কী
—এক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
—দুই আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার
—তিন দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়ন
—চার বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা ও নীতি সংলাপ
সদস্য ও ভূমিকা
জি–২০–এ রয়েছে উনিশটি দেশ ও দুটি আঞ্চলিক সংগঠন। প্রতিটি সদস্য দেশ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতি সমন্বয় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও উন্নয়ন ইস্যুতে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের জন্য জি–২০–এর প্রভাব ও সম্ভাবনা
জি–২০ এখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র। বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতিসহায়তা নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সমীকরণ জি–২০–এর সিদ্ধান্ত দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।
—বাংলাদেশ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে
—প্রথমত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংলাপে সক্রিয়তা বৃদ্ধি
—দ্বিতীয়ত জলবায়ু পরিবর্তনে নৈতিক নেতৃত্ব
—তৃতীয়ত বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের পুনর্গঠনে অংশগ্রহণ
—চতুর্থত শান্তি এবং মধ্যস্থতায় ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ব্যবহার
—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতির ঝুঁকি
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ হ্রাস, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কঠোর শর্ত, ভূরাজনৈতিক দুর্বলতা, সামাজিক সংকট ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ক্ষতি বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে। জি–২০ এর মতো শক্তিকেন্দ্রের কাছে এটি বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সংকটময় করতে পারে।
সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি
রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার পতন, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, বিচার প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা ও জাতীয় ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক সুইডেন
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]