টরন্টো, বাংলাদেশের রাজনীতি, নিজের অভিজ্ঞতা
টরন্টো। টরন্টোর নাম শুনলেই চোখের সামনে এক আলোঝলমল শহরের ছবি ভেসে ওঠে, কানাডার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শহর। টরন্টো ঢাকার মতো বিশাল শহর, শপিংমল আর রেস্তোরাঁয় ঠাসা, স্বাভাবিকভাবে কাজকর্মের সুযোগ–সুবিধা বেশি। সেই ধারণাবশত মন্ট্রিয়ল থেকে টরন্টো যাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকি। এর মধ্যে আমার ছেলেটা টরন্টোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। এবার রুনাকে টরন্টোতে মুভ করার কথা বললে সেও রাজি হয়ে যায়, যদিও সে এত দিন আমার এ প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে এসেছে।
উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের এ সুন্দর শহরে আসার আমাদের প্রায় তিন মাস হতে চলল। ড্যানফোর্থের অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। আসলে এ কয়েক মাস আগেও তো আমাদের দুজনের জীবনই ছিল একই ছন্দে বাঁধা। সাতসকালে কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতো সে ছন্দপতন হলো। মাসকয়েক কেটে গেল নিজেদের ঘরদোর ঠিকঠাক সাজিয়ে–গুছিয়ে নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হতে, বা বলা ভালো বদলে যাওয়া জীবনের তালে তাল মেলাতে। সবে শহরটাকে আমরা চিনতে শিখেছি। টরন্টোর শান্ত শোভার আনাচকানাচ ছড়িয়ে রয়েছে নাগরিক প্রাণচঞ্চলতা। মন্ট্রিয়লের চেয়ে টরন্টোতে জীবনযাত্রা অনেক ব্যয়বহুল। বসে থেকে গা ঝাড়া দিয়ে খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমার অদেখা ও অচেনা এ নগর সম্পর্কে তৃষ্ণা মিটতে না মিটতেই একরকম তাড়াহুড়া করেই আমার সেই পুরোনো পেশা রেস্তোরাঁর চাকরিতে যোগ দিই। সুবিশাল লেক অন্টারিওর গা ঘেঁষে অবস্থিত লেজেন্ডারি সি এন টাওয়ারের ওপরে স্কাই ভিউ রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ শুরু করি। খুব চালু হোটেল। কাস্টমার ঠাসা থাকে সব সময়।
আজ শনিবার। লং উইকেন্ডের প্রথম দিন। করোনাকালে আত্মগোপন করে থাকা টরন্টো শহরটা যেন একটু একটু করে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। ফলের হালকা মিঠে রোদ্দুরে ওক, মেপলের লাল, হলুদ, কমলার অপার্থিব রঙবাহার চারিদিকে। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় রেস্তোরাঁর রঙিন কাচের জানালাগুলোকে যে কী সুন্দর লাগছে! অস্তমিত ক্লান্ত সূর্যটা যেন হাসছে আমাদের দিকে চেয়ে। আজকের সন্ধ্যাটা যেন একটু বেশি রকমের স্নিগ্ধ, সুন্দর ও মনোরম মনে হতে লাগল। একের পর এক ঝলমলে সব নারী–পুরুষ রেস্তোরাঁয় ঢুকছে। তারা সারা সপ্তাহের চাকরি আর সংসারের ঝক্কি সামলে উইকেন্ড ইভিনিংয়ে রিল্যাক্স করতে চায়। রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করা ঝলমল পায়ের রঙিন ইশারা আমার মনেও গোপনে দোলা দিয়ে যায়। ক্রমশ লোক সমাগম বাড়তে থাকে। সতর্ক আমি এগিয়ে যেতে থাকি আর এদিক–ওদিক তাকাতে থাকি। খাবারের মেনু হাতে নিয়ে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে টেবিলের দিকে এগিয়ে যাই, কাস্টমাররা কী কী খেতে চায়, সেসব জিজ্ঞাসা করতে থাকি।
উত্তর-পশ্চিম কোনায় মৃদু স্নিগ্ধ আলোয় বসা দুজন কাস্টমার আমাকে লক্ষ করছিল। আমি তাদের দিকে ফিরে তাকালাম, একজন শ্বেতকায় ও অপরজন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত বলে মনে হলো। একজনের পরনে ক্যাশমেয়ার স্যুট, গায়ে নেভি ব্লু লাইট জ্যাকেট, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। কালো মোটা ফ্রেমের ভারী চশমায় স্মিত হাসিমুখ। পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নের ভেতরে বলেই মনে হয় বয়স। অপরজনের গায়ে মেরুন রঙের লাইট জ্যাকেট, গালে কাঁচাপাকা দাড়ি, বয়স ৫০ বয়স, বেঁটেখাটো, মাথায় পরিমিত টাক।
আমি কাউন্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করব, এমন সময় শ্বেতকায় লোকটি আমাকে ইশারায় কাছে ডাকল।
হ্যালো, ইয়াং ম্যান? আর ইউ বিজি?
নো। নট এট অল। থ্যাংকস।
হাউ আর ইউ?
ফাইন। থ্যাংকস ফর আস্কিং।
হোয়ার আর ইউ ফ্রম?
বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ, দ্য ল্যান্ড অব গার্মেন্ট। আই লাইক বাংলাদেশ। ক্যান ইউ গিভ আস সামটাইম সো দ্যাট উই কান চুজ আওয়ার অর্ডার?
শিয়োর।
বলেই আমি তাদের মেনু পছন্দ করার সময় দিয়ে পাশের টেবিলের দিকে গেলাম।
কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও লোকটাকে নিয়ে আমি ভাবতে থাকলাম। বাংলাদেশকে চিনে এবং ভালোবাসে জেনে তার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। একজন কানাডিয়ান মানুষ আমার দেশকে চেনে, পছন্দ করে, বিষয়টা আমার কাছে বেশ সম্মানের মনে হলো। লোকটাকে এর আগেও দেখেছি। এলিভেটরেও দু–এক দিন দেখা হয়েছে, তবে কথা হয়নি। সাধারণত উইকেন্ডে সে এ রেস্তোরাঁয় আসে, উত্তর পশ্চিম কোনার ওই টেবিলটাতে বসে। কখনো একা আসে, কখনো দুই একজন সঙ্গে নিয়ে আসে।
একটু পরেই লোকটি হাত বাড়িয়ে ইশারা করলে কাছে যেয়ে খাবার অর্ডারটি নিলাম। কিচেনে গিয়ে খাবার এনে যত্নসহকারে পরিবেশন করলাম।
নিজেদের পছন্দের খাবার সামনে পেয়ে তাঁরা হাসিমুখে খাবার শুরু করে দিয়েছেন। আমি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে খাওয়া দেখতে থাকি। গরম বিফ স্টেক ও ম্যাশ পটেটো থেকে ধোঁয়া উড়ছিল।
টেবিলের ওপর চোখ রেখে আমি পূর্বের প্রসঙ্গ টেনে বলি, আই এম এস্টোনিশড, ইউ নো মাই কান্ট্রি!
ইয়েস, দ্য আই হেড নট বিন দেয়ার এনিটাইম। বাট আই হেড বিন ইন ইন্ডিয়া ফর সাম টাইম।
রিসেন্টলি।
আমি তাঁর পূর্বালাপের সূত্র ধরে জানতে চাই, হাউ ডু ইউ নো মাই কান্ট্রি?
ধূমায়িত বিফ স্টেকে কামড় দিতে দিতে তিনি বললেন, বেসিক্যালি আই নো ইয়োর কান্ট্রি ফর গার্মেন্টস। এভরিবডি লাইকস ইয়োর কান্ট্রিস গার্মেন্টস। আই অ্যাম অলসো আ ফ্যান অব ইয়োর কান্ট্রিস গার্মেন্ট। আই মাইসেলফ ইজ আ টেইলর। মাই নেম ইজ জন। মাই টেইলরিং শপ ইজ অন ফ্রন্ট স্ট্রিট। আই ম্যাক ড্রেস এক্সক্লুসিভলি ফর ফিল্ম স্টারস, হকি প্লেয়ারস-দ্যাট ইজ অনলি ফর সেলিব্রিটিজ।
ও আই সি।
বাট আই অলসো নো ইয়োর কান্ট্রি অ্যান্ড পিপল ফর এনাদার রিজন।
ও আই সি। দেন হাউ ডিড ইউ সি আওয়ার পিপল?
সুড আই টেল ইউ দা আনপ্লেজ্যান্ট ট্রুথ?
অফকোর্স। হোয়াই নট?
ভদ্রলোক আমার চোখের দিকে তাকালেন, প্রথমে কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন বলে মনে হলো, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ শক্ত করে উচ্চারণ করলেন, ইয়োর পিপল আর কোয়ার্লসাম। আই মাস্ট সে, ইয়োর পিপল আর কোয়ার্লসাম।
আমার দেশকে নিয়ে একটু আগে প্রশংসা শোনার পর এমন নিন্দাসূচক বক্তব্য শোনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। হতচকিত হয়ে আশপাশে তাকাতে থাকলাম, নিশ্চিত হতে চাইলাম রেস্তোরাঁর অন্য কোনো স্টাফ বা কাস্টমার আমাদের কথোপকথন শুনছে কি না। লক্ষ করলাম সবাই নিজ নিজ কাজ ও খাবার নিয়ে ব্যস্ত। কিছুটা আশ্বস্থ হলাম। যাক, তাহলে আমাদের দেশের মানুষ সম্পর্কে এমন নিন্দাসূচক কথা অন্যরা শুনতে পায়নি।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে জনকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাউ ডিড ইউ কাম টু সে দ্যাট অ্যাবাউট আওয়ার পিপল?
আমার প্রশ্ন শুনে সে চোখ থেকে চশমাটা আস্তে করে নিয়ে টেবিলে রাখল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, সে অনেক লম্বা কথা, যদি তোমার শোনার সময় থাকে, তবে বলতে পারি। সময় আছে?
আমি আশপাশের টেবিলে তাকিয়ে দেখলাম, নতুন কোনো কাস্টমার নেই। আমি জনকে বললাম, বলতে পারো, আমার শোনার সময় আছে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে বাইফোকাল লেন্সের চশমাটা চোখ থেকে খুলে ভালো করে মুছে নিয়ে নাকের ডগায় ঠিক করে বসাল। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে ধূমায়িত বিফ স্টেকের শেষ অংশটুকু চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আমার দোকান থেকে সেদিন টরন্টো কনভেনশন সেন্টারের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম, দেখলাম, দুই দল মানুষ পরস্পর আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। একদল স্বাগত জানাচ্ছে তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, আরেক দল নিন্দাবাদ দিচ্ছে। পরস্পরকে গালাগাল করছে। দায়িত্বে থাকা টরন্টো পুলিশের সদস্যরা সতর্ক চোখে হাঁটাহাঁটি করছেন। কারও হাতে হ্যান্ডকাফ, কারও হাতে প্রশিক্ষিত কুকুর। চারিদিকে যেন একরকম যুদ্ধাবস্থা। আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। কৌতূহলি হয়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশের এক সদস্যের কাছে জানতে চাইলাম তারা কারা? এভাবে মারমুখী অঙ্গভঙ্গি করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে কেন? মনে করছিলাম, বিশ্ব মানবাধিকার কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে বুঝি তারা স্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশটি জানাল, দুই দলের বাড়ি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে। একদল সরকারি দলের সমর্থক, আরেক দল বিরোধী দলের। বাংলাদেশে বাড়ি হলেও এখন সবার বসবাস কানাডায়। সবাই কানাডার নাগরিকত্বও নিয়েছেন। নিজের দেশকে ভুলতে পারেননি বলেই এ দেশে ঝড় তুলছেন। বিস্মিত হলাম আমি। কথাগুলো বলার সময় জনের কপালের শিরাগুলো ক্ষোভে ও রাগে ফুলে উঠেছে।
আমি বেশ লজ্জা পাই। আর সেটা লুকোতে অন্য কাস্টমারের টেবিলের দিকে তাকাই। তাদের সামনে আমি আর সহজ হতে পারিনি। যা হোক, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আমি জনের কথার প্রতিবাদ করতে চাইলাম, কিন্তু সে প্রমাণসহকারে এবং এত সাবলিলভাবে ছবির মতো তার বিরূপ অভিজ্ঞতার ঘটনাটির বর্ণনা দিল যে আমার চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমার মনে হলো জন যদি কথাগুলো এভাবে আমার মুখের ওপর না বলে আমার গালে কষে চড় মারত তা–ও ভালো ছিল।
জনের কথা শেষ হতে না হতেই পাশে বসা দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিকটি বলল, আমার নাম যোগেশ। আমি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। জনের সঙ্গে আমি একমত। এখানে তোমাদের মতো অন্য কোনো দেশের এভাবে রাজনৈতিক দল নেই। সংগঠন নেই, আঞ্চলিক সমিতি নেই। আমাদের ভারতীয়দেরও নেই। আছে আমাদের দেশের সম্মিলিত অ্যাসোসিয়েশন। এ অ্যাসোসিয়েশন সবার স্বার্থ রক্ষা করে। নিজের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এলে সংবর্ধনা দেয়। বিদেশে বসে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার কোনো প্রয়োজন আছে?
জন ও যোগেশের কথাগুলো আমার মধ্যে যেন একটা ঢেউয়ের মতো তুলছে। তাদের কথার কোনো উত্তর দিতে পারিনি। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছিলাম—দেশের ভাবমূর্তি শেষ করে জিন্দাবাদের নিন্দাবাদের স্লোগান কেন দিতে হবে? নিজের অর্থ ব্যয় করে, নিজেদের দ্বিধাবিভক্তি মানুষকে দেখিয়ে কেন, এভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে হবে? বিদেশিরা আমাদের নিয়ে এমন বিরুপ আলোচনা করবে কেন? একটা বড় দীর্ঘশ্বাস আমার বুক খালি করে বেরিয়ে এল। চোখ দুটো যেন হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এল। আমি ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটের চেয়েও বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি, সেসব প্রশ্নের উত্তরে নিজস্ব কোনো সমাধান তুলে ধরতে পারছিলাম না। তাদের কথাগুলো যেন তীরের মতো আমার কানে বিঁধছিল আর আমি বুকচাপা এক দুঃখ ও কষ্টের সাগরের গভীর তলদেশে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার সুপারভাইজার পিটারের ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। দ্রুত কাউন্টারের দিকে হাঁটা দিলাম…।