দেশ নিয়ে কেন আশাবাদী
দেশ আসলে কী? এটা কি শুধুই একটা ভূখণ্ড? নাকি সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী? নাকি এটা শুধুই বুকের গভীরে ধারণ করা একটা অনুভূতি মাত্র? আমার কাছে দেশ মানে এর সব কটি। তবে প্রবাসী হিসেবে এখন তৃতীয়টিই সবচেয়ে বেশি সত্যি। সেই দেশ নিয়ে আমি বরাবরই ভীষণ রকমের আশাবাদী। কারণ, দেশকে যে সাধারণ মানুষেরা ধারণ করে আমি তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের দেশের কৃষক, পোশাককর্মী, প্রবাসী শ্রমিক এরাই দেশের চালিকা শক্তি। এর বাইরে আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। আরও আছে কায়িক শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুক। সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশের কাজে অবদান রেখে চলেছে।
দেশ নিয়ে আমরা আসলে হতাশা প্রকাশ করি না। আমাদের যেটুকু হতাশা তার সবটুকুজুড়েই আমাদের নেতৃত্ব। আরও সহজ করে বললে রাজনৈতিক দল আর সর্বগ্রাসী আমলাতন্ত্র হচ্ছে আমাদের হতাশার মূল কারণ। সংবিধান অনুযায়ী যাদের আসলে প্রজাতন্ত্রের মানে জনগণের চাকর হয়ে থাকার কথা, তারা হয়ে বসেছিল দেশের মালিক। তাই সাধারণ জনগণ দেশকে আর ধারণ করতে সাহস করত না। কিন্তু ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুথানে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর দেশের মালিকানা রাতারাতি বদলে গেছে। এখন দেশের মানুষদের পাশাপাশি প্রবাসীরাও নিজেকে দেশের মালিক মনে করছেন।
কাগজে–কলমে আমাদের সক্ষমতা নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন ছিল। আমরা এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছি, তার অঙ্ক কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু এই সব তাত্ত্বিক এবং গাণিতিক হিসাবের বাইরেও আমাদের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যার বলে আমরা সব সময়ই অসম্ভবকে সম্ভব করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি বারবার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল যেকোনো হিসাবেই একটা অসমযুদ্ধ। আমাদের কোনোভাবেই জয়ের সম্ভাবনা ছিল না। একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিপরীতে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে আমরা সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম দেশকে ভালোবাসলে আর নিজেকে দেশের মালিক মনে করলে সবই সম্ভব।
এ তো গেল ইতিহাসের কথা। এবার আসা যাক সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে। চব্বিশ সালে এসে জেনারেশন জি বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে যেন আমাদের নতুন করে স্বাধীনতা এনে দিল। এই স্বাধীনতা কথা বলার। এই স্বাধীনতা নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার। এই স্বাধীনতা অন্যায়ের প্রতিবাদের। এই স্বাধীনতা দেশের প্রকৃত মালিকানার। ছাত্ররা বুঝিয়ে দিল দেশের আসল মালিক দেশের সরকারপ্রধান আর তার চাটুকার রাজনৈতিক নেতা–কর্মী এবং আমলারা নয়। আর সেটা সম্ভব হলো সবার একজোট হয়ে রাস্তায় নামার ফলে। পাখির মতো গুলি করে তাদের মারা হলো কিন্তু একজন মরলে দাঁড়িয়ে গেল আরও দশজন। সেই দশজন মারা গেলে দাঁড়িয়ে গেল আরও এক শজন। এভাবে সংখ্যাটা বাড়তেই থাকল। অবশেষে এল সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের আগপর্যন্ত দেশে কোনো শাসনব্যবস্থা ছিল না। তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ আর ডাকাত। সুযোগসন্ধানীরা নিজের প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা করতে শুরু করল। বিশেষ করে হাতে গোনা কিছু মানুষ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করতে শুরু করল। তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উপাসনালয় কিছুই রেহাই পাচ্ছিল না। তখন আবার দেশের সাধারণ মানুষই তাদের পাশে এসে দাঁড়াল। তারা রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করল। কোনো অপকর্মের সংবাদ পেলেই সেটা এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করা হলো।
আর ডাকাতদের বিরুদ্ধে মানুষ সবাই এক হয়ে গেল। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় মানুষ উৎসব করে রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করল। শহরের মানুষেরা যারা এত দিন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তারা এই প্রথম নিজেদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ পেল। তৈরি হলো একটা নতুন সংস্কৃতি। মানুষ নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে শিখল। অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা পেল। আসলে আমরা সবাই যে একই দেশের একই মায়ের সন্তান। তাই আমরা দেশটাকে অনেক ভালোবাসি। এত দিন সেটা প্রকাশ করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই নতুন বিপদ আমাদের আবার একতাবদ্ধ করে দেশকে ভালোবাসতে শেখাল।
এর পরপরই এল প্রলয়ংকরী বন্যা। এটাকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক বন্যাও বলা হচ্ছে। কারণ এই বন্যাটা হয়েছে একেবারেই হঠাৎ করে। এ ধরনের বন্যার ইংরেজিতে একটা নাম আছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড। ফ্ল্যাশ ফ্লাডে পানি দ্রুত সরে যায় কিন্তু আমাদের পানি দ্রুত সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। উজানের দেশে বেশির ভাগ নদীতেই বাঁধ দেওয়া। তাই আমাদের দেশের নদীগুলো মৃতপ্রায়। তাই যখন হঠাৎ করে অনেক পানি চলে এসেছে, তখন সেটা দুপাশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্লাবিত করেছে। আর নদী মরে যাওয়াতে এই পানি বের হওয়ারও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। যদিও আমাদের দেশের পানিবিজ্ঞানীরা অদ্ভুত সব কথা বলছেন। তাঁরা কেউই নদী মরে যাওয়ার কারণে বন্যার পানি আটকে থাকার কথা বলছেন না।
যাহোক, দেশের মানুষ যখন বন্যায় অসহায় হয়ে পড়ল, তখন আবার আমরা একজোট হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ালাম। যেটা আগেই বলেছিলাম যেকোনো বিপদ দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসাটাকে জাগিয়ে দেয়। ৫ আগস্টের ক্রান্তিকাল পার হয়ে নতুন সরকারের জন্য এই বন্যা মোকাবিলা বেশ কঠিন হয়ে পড়ত যদি না সাধারণ মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে না আসত। এত দিন সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারের কবলে পড়ে নিজ দেশেই নিজেকে অচ্ছুৎ মনে করত। এবার স্বাধীন দেশে যেন সেই দমবন্ধ হয়ে আটকে থাকা ভালোবাসাটা প্রকাশ করার সুযোগ পেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্রে আমরা একটা অসম্ভব রকমের সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। দলে দলে সারি সারি মানুষ বন্যার্তদের জন্য সাহায্য নিয়ে হাজির হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল একদল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে এটা আমার মনের মণিকোঠায় আঁকা হয়ে থাকবে। একেবারে মায়ের কোলের শিশু থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই সাহায্য নিয়ে এসেছে। এমন না যে সবাই টাকা নিয়ে এসেছে। যার যার সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে বন্যার্তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিশু এসেছে তার মাটির ব্যাংকে জমা করা শখের টাকাগুলো নিয়ে। মা নিয়ে এসেছে তার বাচ্চার অব্যবহৃত ও পুরোনো কাপড়। কেউ নিয়ে এসেছে পানি, কেউ নিয়ে এসেছে শুকনা খাবার। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ।
এটা তো গেল দেশের মানুষের কথা। প্রবাসীরা যতই বিদেশে থাকুক, তাদের মনটা সব সময়ই পড়ে থাকে দেশে। তারা দেশের যেকোনো প্রয়োজনে তাই অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলে। যেমন ৫ আগস্টের আগে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরিতে প্রবাসীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বন্যার সময় তারা আবারও দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়াল। ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে শুরু করে সামষ্টিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তহবিল সংগ্রহ করা হলো এবং হচ্ছে। এই প্রথম প্রবাসীরা যেন দেশকে নতুন করে ধারণ করল। দেশে তার আত্মীয়স্বজন বন্যা আক্রান্ত হোক বা না হোক ধর্ম–বর্ণ–এলাকানির্বিশেষে সবাই একজোট হয়ে দেশে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসার প্রকাশ দেখতে পারাটাও অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার।
দেশের শিক্ষিত এবং প্রবাসের বন্ধুদের আড্ডায় আমি সব সময়ই একটা কথা বলতাম। সেটা হলো আমরা যারা দেশের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তারা কখনোই দেশকে ওউন করি না। প্রবাসী বন্ধুদের বলতাম আমরা তো আরও বেশি ওউন করি না। কারণ আমরা কখনোই দেশের কোনো কাজে আসি না। এবার দেখলাম ভিন্ন চিত্র। আসলে আমরা সবাই আমাদের মাতৃভূমিকে প্রচণ্ড ভালোবাসি এবং ভীষণভাবে ওউন করি। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আমরা সেটা প্রকাশ করতাম না। এখন যখন দেশের আকাশে মুক্তির বাতাস বইছে, তখন আমরা সবাই বুকভরে নিশ্বাস নেওয়ার পাশাপাশি বুঝতে পারছি আমরা আসলে দেশকে কতটা ভালোবাসি। আমি স্বপ্ন দেখি এই ভালোবাসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়বে। আর যে দেশের মানুষ দেশকে এমন গভীরভাবে ভালোবাসে, সেই দেশ কখনোই পথ হারাবে না। আমি দেশকে নিয়ে তাই ভীষণভাবে আশাবাদী।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]