ডাউন হাউসে এক দিন: ডারউইনের ঘরগেরস্তি

চার্লস ও উইলিয়াম ডারউইন
ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তাঁর সময়ের অন্য সবাইকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দিয়ে। যারা জীববিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছি, তাদের কাছেও সেই তত্ত্বের বিস্ময় খুব সহজে কাটার মতো নয়। লন্ডনে পিএইচডির প্রায় শেষ প্রান্তে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় লরেন্স ইমপির সঙ্গে। বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে যে আমরা একসঙ্গে হলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেই দিন কাটিয়ে দিতে পারি।

তাকে বলেছিলাম, সে যদি আমাকে যুক্তরাজ্যে একটা জিনিসের অভিজ্ঞতা মিস না করতে বলে, সেটা কী হবে? সে বলেছিল, যদি তুমি ডাউন হাউসে—চার্লস ডারউইনের বাড়ি, যেখান থেকেই তিনি তাঁর গবেষণা করে গেছেন আমৃত্যু—না গিয়ে থাকো, তাহলে অবশ্যই যাওয়া উচিত! আমার আবার বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার পড়তে এবং সুযোগ পেলে নিতে ভালো লাগে। ডারউইন যেহেতু এখন নেই, তাই ডাউন হাউসে চার্লস ডারউইনের ঘরগেরস্তির অভিজ্ঞতা নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি তাঁর ডারউইন হয়ে ওঠার গল্প!

ডাউন হাইস

দ্বিতলবিশিষ্ট একটা ইংলিশ বাড়ি, যার সঙ্গে আছে লাগোয়া অরচার্ড (ডান পাশে) এবং ফুলবাগান (পেছনে)। বাগানের পরেই আছে সরু কিচেন গার্ডেন, যা অরচার্ডের সঙ্গে কিছু অংশ লাগোয়া। কিচেন গার্ডেনের পর আছে বিখ্যাত জায়গা স্যান্ডওয়াক, যেখানে হেঁটে হেঁটে চার্লস হারিয়ে যেতেন নতুন নতুন তত্ত্বের জগতে।

বাড়ির নিচতলায় এখন ইংলিশ হেরিটেজের অভ্যর্থনাকক্ষ ও বিক্রয়কেন্দ্র। ঢুকতে দিতে হয় ১৬ পাউন্ড। লবি পার হতেই ডান পাশে পড়বে ড্রয়িংরুম, বাঁ পাশে লাগোয়া স্টাডিরুম, তার পাশেই বিলিয়ার্ডরুম। এর ঠিক উল্টো দিকে বড় ডাইনিংরুম এবং লাগোয়া রসুইঘর।

বিক্রয়কেন্দ্রের ঠিক ওপরতলায়ই আছে ডারউইনের বিভিন্ন মজার তথ্য ও সংগ্রহ নিয়ে একটা কক্ষ। তার পাশেই ছোট্ট কক্ষে ‘দ্য ভয়েজ অব বিগল’ বা ‘বিগলের সমুদ্রযাত্রা’ নামে স্মৃতিকথা লিখতে যে যে উপকরণ ব্যবহার করেছেন, তা নিয়ে এক সংগ্রহ। তার পাশের কক্ষেই অডিও-ভিজ্যুয়াল আছে—ডারউইনের দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল বিগল জাহাজে, তা নিয়ে। তার পাশের রুমেই আছে ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ নিয়ে সংগ্রহ। এর উল্টো দিকে ডারউইনের পরিবারের সবার ছবি এবং কর্ম নিয়ে একটা কক্ষ, পাশেই শয়নকক্ষ আর একটা ছোট্ট লাইব্রেরি (এখানে পুরোনো বই খুব সস্তায় পাওয়া যায়)।

‘সেকেলে’ ডারউইন

ডারউইন-এমার ড্রয়িংরুম
ছবি: ইংলিশ হেরিটেজের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ডাউন হাউসে এক দিন: ডারউইনের ঘরগেরস্তি

ডারউইন সেই সময়ে সমুদ্রাভিযানে যাওয়ার ফলে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে গবেষকদের নমুনা পাঠানোর সুবাদে তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন বিগলের যাত্রা শেষে ইংল্যান্ডে ফেরার আগেই। চাইলেই তিনি তখনকার ডাকসাইটে, প্রতিষ্ঠিত এবং খ্যাতনামা নারী বেছে নিতে পারতেন জীবনসঙ্গী হিসেবে!

কারণ, প্রগতিশীল ঘরের মেয়েরাই তখন প্রফেশনাল ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারতেন!

কিন্তু ডারউইন প্রগতিশীলতার দিকে হাঁটলেন না, তিনি সোজা চলে গেলেন তাঁর পরিবারের পরিসরে। বিয়ে করলেন তাঁর কাজিন এবং একসঙ্গে বেড়ে ওঠা এমা ওয়েজউডকে, যিনি কিনা পুরোদস্তুর ঘরসংসার সামলাতে রাজি!

পারিবারিক ডারউইন

ডারউইন-এমা দম্পতির ছিল ঘরভর্তি সন্তান, ১০ জন। এর মধ্যে তিনজন ছোটবেলায় মারা যান। ডারউইনকে বলা হয় বিজ্ঞানী বাবা! তাঁর প্রথম সন্তান উইলিয়াম জন্মান ১৮৩৯ সালে। এর পর থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত উইলিয়াম কখন কাঁদে, হাসে, হাঁচি দেয়, হেঁচকি তোলে বা সুড়সুড়ি দিলে সাড়া দেয় কীভাবে বা দেয় কি না ইত্যাদি মজার ঘটনা লেখা আছে তাঁর ডায়েরিতে। ৩৭ বছর পর উইলিয়ামকে নিয়ে সংগ্রহ করা ডেটা প্রকাশ করেন মাইন্ড জার্নালে ১৮৭৭ সালে।

এন ডারউইন ছিল ডারউইন-এমা দম্পতির প্রথম কন্যা। মাত্র ১০ বছর বয়সে মারা যান সপ্তাহখানেক তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করার পর, সম্ভবত টাইফয়েড হয়েছিল। এ শোক ডারউইন আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর পর থেকেই তিনি চার্চে প্রার্থনা করতে যাওয়া বন্ধ করে দেন। অন্যদিকে, এমা ছিলেন ধার্মিক। তাই প্রতি রোববার ডারউইন নিজে পরিবারকে প্রার্থনা করতে চার্চে নামিয়ে দিতেন এবং নিয়ে আসতেন। নিজে যেতেন না।

ডারউইন-এমা দম্পতির সন্তানদের মধ্যে যাঁরা বিখ্যাত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্যার জর্জ ডারউইন (ব্রিটিশ ভূপদার্থবিদ, যাঁকে ধরা হয় ‘জোয়ার’ গবেষণায় অগ্রপথিক), স্যার ফ্রান্সিস ডারউইন (চিকিৎসক হয়েও রোগী না দেখে, বাবার সঙ্গে গাছের শারীরতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং বাবার সঙ্গে একটা বইও লিখেছিলেন।

তাঁকে গাছের স্টোমাটা কীভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে গবেষণায় অগ্রপথিক ধরা হয়), লিওনার্ড ডারউইন (২০ বছর সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তারপর হন আইনপ্রণেতাও), এবং স্যার হোরেস ডারউইন (যিনি প্রতিষ্ঠা করেন কেমব্রিজ সায়েন্টিফিক ইনস্ট্রুমেন্ট কোম্পানি, যা ব্রিটেনকে যন্ত্রপাতি তৈরির সক্ষমতায় নিয়ে যায় জার্মানির সমপর্যায়ে এবং পরবর্তী সময়ে যা ব্রিটেনকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সহায়তা করে)।

তবে আমি বলব এলিজাবেথ ডারউইনের কথা, যিনি মা-বাবার সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন আজীবন, ফলে বিয়ে পর্যন্ত করেননি। করে গেছেন বাবার সব গবেষণায় সহায়তা। পারিবারিক সহায়তা বড় কিছু অর্জনে কীভাবে অপরিহার্য, তার উদাহরণ ডারউইন-এলিজাবেথ বাবা-কন্যা জুটি।

অসুখের সঙ্গে বসবাস

কিছুদিন পরপরই অসুখে পড়তেন চার্লস ডারউইন। লক্ষণ ছিল মোটামুটি এমন—পাকস্থলীর যন্ত্রণা, অবসাদ, মাথা ঘোরানো, ভয়ে শিউরে ওঠা, মূর্ছা যাওয়া ইত্যাদি। তাঁর এ অসুখের দুটি সম্ভাব্য কারণের কথা শোনা যায়। এক হলো ‘দুশ্চিন্তা’! মজার ব্যাপার হলো, তাঁর অসুস্থতার সময় পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যখনই তিনি নতুন কোনো প্রমাণ বা আইডিয়া খুঁজে পেয়েছেন এবং তা প্রকাশ করতে যাচ্ছেন, তখনই তাঁর অসুখ দেখা দিয়েছে!

যেহেতু তাঁর বিশ্বাস ছিল পর্যাপ্ত ‘প্রমাণ ছাড়া তত্ত্ব আসলে কোনো তত্ত্বই না’ এবং সেই সময়ে বায়োলজি ছিল খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে, ডিএনএর গঠন আবিষ্কৃত হয়নি, তাই পর্যাপ্ত প্রমাণও হাতে নেই। আবার কোনো একটা নতুন পর্যবেক্ষণে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, সেটাকে কীভাবে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরবেন—এ উদ্বেগের ফলেই হয়তো দেখা দিত নানা লক্ষণ!

আরেক ধারণা অনুসারে, ডারউইন চ্যাগাস ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। লাতিন আমেরিকায় গবেষণার নমুনা সংগ্রহের সময় ১২৮ দিন তিনি গ্রামীণ পরিবেশে এবং খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছিলেন। সেখানে কিসিং বাগের কামড় খেয়ে ছিলেন, ডায়েরিতে এর উল্লেখ আছে। এ কামড় এত বেশি পরিমাণ ছিল যে তা হয়তো পরবর্তী সময়ে তাঁর পৌনঃপুনিক শারীরিক অসুস্থতার কারণ হয়ে থাকতে পারে। আমার ধারণা, মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগই ছিল তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কারণ!

ডারউইন কীভাবে ‘ডারউইন’

সাধারণত প্রায় সব বিজ্ঞানীকে গবেষণা করার জন্য কোনো না কোনো একাডেমিক অথবা গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে নিজেকে যুক্ত করতে হয়। সেই প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে কোনো তত্ত্বের ওপর কাজ করার জন্য আর্থিক এবং জনবলের জোগান মেলে। চার্লস ডারউইনের ক্ষেত্রে এসব প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার কোনো বাধ্যতা ছিল না। তিনি পৈতৃক সূত্রে অঢেল সম্পদ পেয়েছিলেন, যা নিজের গবেষণায় জীবনভর ব্যয় করতে পেরেছেন।

এর ফলে উনি কী নিয়ে কাজ করবেন, তাতে অন্য কোনো কিছুর প্রভাব ছিল না। সঙ্গে তাঁর সংগ্রহ করা বিশাল নমুনার সংগ্রহ কারও সঙ্গে শেয়ার করতে হয়নি। অনেক হিসাব-নিকাশ করে তিনি সস্ত্রীক লন্ডনের কোলাহলময় জীবন ছেড়ে মোটামুটি গবেষণার জন্য উপযুক্ত, বেশ বড় এবং নিরিবিলি পরিবেশযুক্ত কেন্টের ডাউন হাইসে চলে আসেন।

সময়ের সদ্ব্যবহার

নীরবে-নিভৃতে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে ডারউইনের যোগাযোগ ছিল নিরবচ্ছিন্ন। সেটা ছিল মূলত চিঠিপত্রের মাধ্যমে। এক চিঠিপত্র এবং ডাক বিভাগের পারসেল সার্ভিস ব্যবহার করে তিনি তাবৎ দুনিয়ার সঙ্গে রক্ষা করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ এবং পাঠিয়েছেন ও গ্রহণ করেছেন অগণিত নমুনা। ধারণা করা হয়, তিনি তাঁর ডাউন হাইসের জীবনে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ চিঠিপত্র আদান-প্রদান করেছেন। ১৮৫১ সালে তাঁর ডাক বিভাগের বিলের পরিমাণ ছিল ২০ পাউন্ড, যা কিনা আজকের বাজারে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ পাউন্ডের সমান! এ টাকা দিয়ে প্রায় তিনজনের কমনওয়েলথ স্কলারের (লন্ডনের বাইরে) মাসিক বৃত্তি দেওয়া যাবে! পরিবারজুড়েই ছিল চিঠিপত্রের প্রতি দুর্বলতা। চিঠি নিয়ে খুব মজার একটা কবিতাও পাওয়া গেল সংগ্রহকক্ষে।

ডারউইন পরিবারের কবিতা—
চিঠি লিখো, লিখে চিঠি
ভালো উপদেশে বড় হয়ে উঠি,
বাবা, মা, ভাই, বোন
একে অন্যের পরামর্শক হোন।

স্টাডিরুম

ডারউইনের স্টাডিরুম
ছবি: ইংলিশ হেরিটেজের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

মূলত তিনটি কাজ করার ডেস্ককে কেন্দ্র করে ডারউইনের স্টাডিরুম। এ কক্ষের এক পাশে শুধু জানালা আছে। সেই পাশে দুই জানালার পাশে আছে দুই ডেস্ক। একটিতে মাইক্রোস্কোপ এবং আনুষঙ্গিক কিছু যন্ত্রপাতি রাখা, যা ডান পাশের জানালার সঙ্গে লাগোয়া, যাতে পর্যাপ্ত আলো আসতে পারে এবং মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করতে কোনো সমস্যা না হয়।

আরেকটিতে সাজানো থাকত ছোট ছোট শিশিতে ভরা নানা রকম প্রক্রিয়াজাত করা জীব-নমুনা আর ছোট ছোট নোট। এর পাশেই একটা আর্ম-চেয়ার (ছবিতে গোল টেবিলের পাশে)। ডারউইন বৈজ্ঞানিক লেখার জন্য কোনো টেবিল ব্যবহার করতেন না, বরং তাঁর একটি কাঠের বোর্ড ছিল, যা সেই চেয়ারের হাতলে বসলেই হয়ে যেত সুন্দর লেখার ডেস্ক। ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিশিস’ এই হাতলযুক্ত চেয়ারে বসেই লেখা!

কক্ষে ঢুকতেই মূল ডেস্ক। এটায় থাকত নতুন আসা চিঠিপত্র, নমুনা, পোস্ট করার জন্য প্রস্তুতকৃত নমুনা, নোট, পত্র ইত্যাদি। এর দুই পাশে বসেই যেন কাজ করা যায়, তার জন্য দুই পাশে বসার ব্যবস্থা। একটা হয়তো এলিজাবেথ ব্যবহার করতেন। কেননা, তিনি ছিলেন আমৃত্যু বাবার গবেষণায় সহযোগী! কক্ষে ছিল একটা ছোট্ট পাঠাগারও। সংক্ষেপে ডারউইনের কর্মপদ্ধতি, নমুনা, আইডিয়া, সমালোচনা আসবে একদিক দিয়ে, সেগুলো তারপর যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হবে অন্য ডেস্কে, তারপর নেওয়া হবে নোট এবং যা থেকে লেখা হবে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ এবং বই।

আমার কাছে স্টাডিরুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস ছিল, ফায়ার প্লেসের পাশের আড়াল করা একটা জায়গা (ছবিতে নেই) এবং সেখানে রাখা এক বড়সড় গামলা। ডারউইনের নানা শারীরিক লক্ষণ দেখা দিত কিছুদিন পরপর, সেটা আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। সে জন্যে কি কাজ বন্ধ থাকবে? মোটেই না। এতই কাজপাগল ছিলেন যে বাড়তি চিকিৎসা হিসেবে হাইড্রো-থেরাপি নিতেন নিজের স্টাডিরুমে বসে, কাজের ফাঁকে!

বর্তমান নিউরোসায়েন্স বলে এ ধরনের থেরাপি, যেখানে আপনাকে শরীরের একটা অংশ পানিতে ডুবিয়ে বসে থাকতে হয় এবং এই বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আবার উঠতেও পারবেন না—এ রকম অবস্থায় লম্বা সময় থাকলে আমাদের মস্তিষ্ক ‘কেন্দ্রীভূত’ চিন্তাভাবনা থেকে ‘বিক্ষিপ্ত’ চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। ফলে বর্তমানের কোনো সমস্যা, যা নিয়ে মস্তিষ্ক ব্যস্ত ছিল, (কেন্দ্রীভূত) তার ফাঁকে ফাঁকে অন্য কিছু আইডিয়া (বিক্ষিপ্ত) উঁকিঝুঁকি দেয় অতীত অভিজ্ঞতা থেকে, যা হতে পারে কোনো পড়া বইয়ের জ্ঞান বা প্রজ্ঞা বা কারও কাছে শোনা কথা ইত্যাদি, যা আমাদের সাহায্য করে নানান অভিজ্ঞতা মিশিয়ে একটা সৃজনশীল সমাধানে পৌঁছাতে।

নির্মল বিনোদন

উদ্বেগসংক্রান্ত শারীরিক ও মানসিক জটিলতার কথা ইতিমধ্যে জেনেছি। তা ছাড়া নতুন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণার কাজ, যা কিনা আরও একঘেয়ে এবং যারপরনাই বিরক্তিকর। তবে হ্যাঁ, সেই বিরক্তি কাটাতে যা প্রয়োজন এবং যা আসলেই খুব সাহায্য করে, তা হলো পরিবারের সহযোগিতা এবং পরিবারের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানো। এ জন্যই সব বিখ্যাত পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপে পারিবারিক সাপোর্টের জন্য আলাদা করে আর্থিক বরাদ্দ থাকে।

ডারউইন যেহেতু নিজে যা বিশ্বাস করেন, তা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সক্ষমতায় গবেষণা করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর কাজিনকে, দুজনের পারিবারিক মূল্যবোধ যেহেতু একই, তাই একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তির উৎস ছিল ড্রয়িংরুম। সেখানে ছিল সংগীতযন্ত্র, ঘরেই খেলা যায় এমন সব আয়োজন, ছোট্ট লাইব্রেরি, বিভিন্ন শিল্পকর্মের সংগ্রহ আর বিশাল জায়গা যেখানে একঝাঁক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হইহুল্লোড় করে মস্তিষ্কের জট দূর করা যায় নিমেষে।

নীরবে-নিভৃতে

কিচেন গার্ডেনের শেষে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত একটা হাঁটার রাস্তা, যা স্যান্ডওয়াক নামে বিখ্যাত। এ অংশ প্রথমে ডাউন হাইসের অংশ ছিল না, পরে ডারউইন পরিবার সেটা কিনে নেয় প্রতিবেশীর কাছ থেকে। এটা মূলত একটা কাঠবাগানের ভেতরে চক্রাকার মাটির পথ, যা কয়েকবার ঘুরে এলে সারা দিনের প্রয়োজনীয় ব্যায়াম হয়ে যায়।

ডাউন হাউসে বেড়াতে এলে সবাই এই স্যান্ডওয়াকে হাঁটার অভিজ্ঞতা নিয়ে যায়। এর একটা বাড়তি সুবিধা আছে, একান্ত নিজস্ব কিছু সময় দেয়, যা ‘মি টাইম’ নামে পরিচিত এখন। এ রকম জানা পথে অবিরাম সময় নিয়ে হাঁটলে বিক্ষিপ্ত আইডিয়াগুলো বিন্যস্ত হয় বা হওয়ার সুযোগ পায়!

অপেক্ষা পরিপূর্ণতার

ডারউইনকে মিস্টার পারফেকশনিস্ট বলা যায়। তাঁর মতে,‘অ্যান আনভেরিফায়েড হাইপোথিসিস ইজ অব লিটিল অর নো ভ্যালু।’ বিবর্তনের তত্ত্বের ধারণা তাঁর মাথায় আসার পর সেটা প্রকাশ করতে তিনি সময় নিয়েছেন ২০ বছর! তা-ও শেষ দিকে আরেক বিজ্ঞানীর, আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস, প্রায় একই রকম মতবাদ প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরেছেন বলেই সেটি প্রকাশ করেছেন, নইলে হয়তো আরও অনেক সময় নিতেন!

মজার বিষয় হলো, ডারউইনের বন্ধু কিংস কলেজ লন্ডনের জিওলজির অধ্যাপক চার্লস লায়েল, ডারউইনের এ ‘বেশি সময় নেওয়া’ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন যে ‘দেখবে একদিন অন্য আরেকজন এই ন্যাচারাল সিলেকশনের মতবাদ নিয়ে হাজির হবে ঠিকই।’ হয়েছিল ঠিক তা-ই।

১৮৫৮ সালে ১৮ জুন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ডারউইনের কাছে তাঁর ন্যাচারাল সিলেকশনের তত্ত্ব নিয়ে চিঠি পাঠান! দুজনের মতবাদের মূল পার্থক্য ছিল, ওয়েলস বলেছিলেন এ সিলেকশন হয় ‘একটা গ্রুপ বা প্রজাতিতে’ আর ডারউইন মনে করতেন সিলেকশন ঘটে ‘আলাদা আলাদা বা একক পর্যায়ে’। পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুজন একসঙ্গে একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

পুরো বাড়ি একটি ‘জীবন্ত গবেষণাগার’

কিসিং বাগ
ছবি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

কিচেন গার্ডেনে আছে নানা প্রজাতির গাছপালা। এর মধ্যে আছে হটহাইস আর গ্রিনহাউস। বিগল সমুদ্রযাত্রার পর ডারউইন লক্ষ করেছিলেন, সব জায়গায় সব গাছ জন্মাতে দেখা যায় না, কিন্তু কেন তা জানতেন না। এর উত্তর খুঁজতেই বাড়িতে বানিয়েছিলেন বৈচিত্র্যময় পরিবেশ, যাতে সেই উত্তর পাওয়া যায়।

কিছু উদ্ভিদ আছে, যারা পোকা মাকড় খায়। এদের আবার আছে নানা আকার। ডারউইনের সংগ্রহে ছিল এ ধরনের উদ্ভিদের বিশাল সম্ভার। মজার বিষয় হচ্ছে, এ শ্রেণির সবচেয়ে ক্ষুদ্র উদ্ভিদটি যেহেতু উদ্দীপনায় নড়াচড়া করতে পারে, তাই এটাকে প্রাণী বলে ভুল হয়।

ডারউইন প্রথম দিকে তা-ই ভেবেছিলেন। নানা রকম প্রাণিকুল এবং গাছপালার সঙ্গে তাঁর সংগ্রহে ছিল মৌচাক! মৌচাকের প্রতিটি কুঠুরি কেন ষড়্‌ভুজাকৃতির, সেটা নিয়েছিল তাঁর বিস্তর আগ্রহ। সেই থেকেই মৌচাকের জায়গা হয় ডাউন হাউসে! অবশেষে তিনি বের করতে পেরেছিলেন, একমাত্র ষড়্‌ভুজাকৃতির কুঠুরিযুক্ত মৌচাকেই সবচেয়ে কম পরিমাণে মোম বা ওয়াক্স লাগে! প্রকৃতির সংরক্ষণশীলতা নীতির কী অপূর্ব উদাহরণ!

পরিশেষে, ডাউন হাউস শুধুই একটা বাড়ি নয়। এর ভেতর দিয়ে গেলে পরিচিত হওয়া যায় ডারউইনের দৈনন্দিন ঘরগেরস্তির সঙ্গে, পাওয়া যায় জীবনের ছোট ছোট সমস্যার চটজলদি সমাধান। যাঁরা অনেক বড় কিছু করতে চান, তাঁদের ডাউন হাউস শুধু ডারউইন সম্পর্কে জ্ঞানই দেবে না, বাড়িয়ে দেবে প্রজ্ঞার ডালা।

  • লেখক: মো. মাহবুব হাসান, কমনওয়েলথ স্কলার, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য ও শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।