চাকরি করতে হলে যোগ্যতাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

জন্মের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ এক স্বপ্নতাড়িত দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই স্বপ্ন অর্জিত হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন, আমরা তা এখনো গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠনের জন্য কোনো কার্যকর ও টেকসই প্রকল্প গ্রহণ করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন রূপকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

বছরের পর বছর শুধু সরকারি চাকরির পেছনে পড়ে থাকলে সফলতা আসবে, তা–ও বলা কঠিন। সে ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে বহুমুখীভাবে। যদিও আয়, সম্মান, নিরাপত্তা আর বাড়তি সুযোগ-সুবিধার বিবেচনায় সরকারি চাকরি নিঃসন্দেহে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় চাকরির ক্যাটাগরিতে পড়ে, বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারের চাকরি। তাই অনেকেই হয়তো এর পেছনে সময় দিচ্ছে। গাইডের পর গাইড মুখস্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কঠিন সত্য হলো, সবার সরকারি চাকরি হবে না। বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হয় গুটিকয়েক মানুষ। তবু এই তীব্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে অন্য সুযোগ নষ্ট করলে ঠিক হবে না। কারণ, চারপাশে সরকারি চাকরিজীবীর চেয়ে কিন্তু বেসরকারি পেশাজীবীর সংখ্যা বেশি।

ব্যবসা করে সফল হওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এমনকি বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং করে অনেকে ভালো উপার্জন করেন। তাঁদের কারও জীবন কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি। সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য ধৈর্য রাখতে পারা ভালো। কিন্তু বয়স ৩০ পার হওয়ার পর সার্টিফিকেট ছাড়া অন্য কোনো যোগ্যতা দেখাতে না পারলে বেসরকারি চাকরির রাস্তাও দেখা গেল বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরীক্ষার ফল ভালো। শিক্ষার গুণ ও মান ভালো। তবু মনঃপূত চাকরি দেশে বা বিদেশে হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? বাংলাদেশে না হয় অন্য কিছুও জড়িত থাকতে পারে কিন্তু বিদেশে? ভাষা, ধর্ম, বর্ণজনিত সমস্যা? মানিয়ে চলা, রেফারেন্স বা অন্য কোনো সমস্যা? নাকি ইন্টারভিউয়ের দুর্বলতা? নানা জনে নানা বিশ্লেষণ দেবে এবং এটাই স্বাভাবিক। আমি চেষ্টা করব একজন কর্মজীবী ও একজন নিয়োগকর্তা হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও মতামত সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে। আশা করি, চাকরিপ্রার্থীরা কিছুটা উপকৃত হতে পারবেন।

প্রথমত, নিজের ওপর একটি ভালো swot-analysis করতে হবে এবং তা সুন্দর করে তুলে ধরতে হবে সিভিতে (Curriculum vitae)। SWOT মানে  Strengths, Weaknesses, Opportunities এবং Threats। নিজের সক্ষমতার পাশাপাশি দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। যেমন ভাষাগত বা সামাজিক দুর্বলতা নিয়ে একটু ভাবনা আসতেই পারে। সে ক্ষেত্রে এর ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, মেনে নিতে হবে ‘Once a Foreigner Always a Foreigner.’ তবে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে যেকোনো সমস্যা চিহ্নিতকরণের দক্ষতার ওপর। সমস্যা নিজের দেশেই হোক বা অন্য দেশেই হোক, তা সমাধান করতে হলে সেটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কারণ, সমস্যা কী তা যদি শনাক্ত করা যায়, তখন সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। কিন্তু সমস্যাই যদি চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে সমাধান কখনোই সম্ভব হবে না।

আমরা আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন অভ্যস্ত তেমন সমন্বয় করার দক্ষতাও ভালো। দক্ষতা তো দক্ষতাই। তাই নিজের দেশের সংস্কৃতির অর্জিত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন আরেকটি দেশের সংস্কৃতিতে মানিয়ে নেওয়া সহজ। তবে নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতিকে বুঝতে একটু সময় লাগে। আর কর্মের ওপর দক্ষতা নির্ভর করবে প্রশিক্ষণের ধরনের ওপর। ভালো প্রশিক্ষণ থাকলে সহজে নতুন কিছু জানা এবং শেখা সহজ হবে। ইতিবাচক মনোভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নতুন কিছু শেখার আগ্রহ থাকতে হবে সারাক্ষণ। দুর্বলতাকে ঢাকতে অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। লুজার খোঁজে অজুহাত আর উইনার খোঁজে সমাধান, এ কথা মনে রাখতে হবে। চাকরির বাজার দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়ছে। নিয়োগ পরীক্ষায় সাক্ষাৎকার (ইন্টারভিউ) পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন ব্যাপার। তাই একবার পৌঁছে গেলে ব্যর্থ হব না, এ মনোভাব শক্তপোক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভাইভায় নিয়োগকর্তাদের সামনে বসে আচমকা কোনো বেফাঁস কথা বলা যাবে না।

ইন্টারভিউয়ের সময় প্রতিটি কথা অবশ্যই ভেবেচিন্তে বলতে হবে। ভিনদেশে কেন চাকরিটি আমাকে দেবে, কী গুণাগুণ আমার আছে, যা অন্য কারও নেই? এমন প্রশ্ন করা হলে জবাবে কারও কৃপাপ্রার্থিতা নয় বরং যোগ্যতাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমি গেস্ট স্টুডেন্ট, গরিব দেশ থেকে এসেছি, মা–বাবার সংগতি নেই আমার ভরণপোষণ জোগানোর, তাই একটি কাজের খুবই প্রয়োজন। এমন ধরনের ইঙ্গিতে বোঝা যায় আমি করুণা নিতে চেষ্টা করছি। যদিও ঘটনা সত্য, তবে অপ্রিয় সত্য কথা ইন্টারভিউয়ে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট বহন করবে। বরং যদি বলা হয় আমি তোমাদের দেশে এসেছি, প্রশিক্ষণের সঙ্গে তোমাদের ভাষা, কালচারসহ কর্মজীবনের সব বিষয় জানতে চাই, যা আমার শিক্ষাকে আরও মজবুত করবে। আমি যখন নিজ দেশে ফিরে যাব, তোমার দেশের টেকনোলজি সহজভাবে আমার দেশে ব্যবহার করতে পারব এবং অন্যকেও উৎসাহিত করব।

কর্মে জটিল সমস্যাকে আমি আমার চিন্তাচেতনায় ভিন্নভাবে দেখতে চেষ্টা করব, যা নিশ্চিত আমাদের যৌথ কাজে ক্রিয়েট সাম এক্সট্রা ভ্যালু। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সে ক্ষেত্রে। গ্লাসে যদি অর্ধেক পানি থাকে বলা যেতে পারে গ্লাস অর্ধেক পরিপূর্ণ বা অর্ধেক খালি। পজিটিভ পরিবেশে তারিফ করে বলা শিখতে হবে গ্লাস অর্ধেক পরিপূর্ণ। এ ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত জবাব নিয়োগকর্তাদের মুগ্ধ করে। পৃথিবীর বহু দেশ এবং দেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি, তাই যতটুকু শিখেছি, তাতে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশিরা কাজে ঢুকতে পারলে ম্যানেজ করে ভালো। যেখানে বাংলাদেশি কাজ করে, সাধারণত সেখানে কাজ পেতে সুবিধা হয়ে থাকে ভালো রেপুটেশনের কারণে। কখনো বলা উচিত হবে না আমি বিদেশি, তাই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাকে কেউ চাকরি দিচ্ছে না। বা আমি আগে যেখানে চাকরি করতাম, সেই প্রতিষ্ঠানটা জঘন্য। এ ধরনের মন্তব্য চারিত্রিক সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ।

নতুন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার আগে চাকরিদাতা আগের কর্মস্থলে যোগাযোগ করতে পারেন, সে বিষয়টি মনে রাখতে হবে। কাজেই নিজের সম্ভাবনাটা নষ্ট হতে পারে, এমন কিছু করা ঠিক হবে না। বিদেশে প্রতিটি বাংলাদেশির গুরুদায়িত্ব রয়েছে তাঁর কর্মে। কারণ, যে কাজই করুন না কেন, তিনি বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দেশকে তুলে ধরেন। অতএব দেশের বাইরে কাজ করার গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অন্যকে সুযোগ করে দেওয়া। জব ইন্টারভিউয়ে শুধু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তা নয়, তাদেরও প্রশ্ন করতে হবে। যেমন কোম্পানির বিষয় বা ক্যারিয়ার পসিবিলিটিজ ইত্যাদির ওপর। মনে রাখতে হবে জব ইন্টারভিউ একটি বেচাকেনার জায়গা। দুই পক্ষকেই ভালো লাগতে হবে। আমার যেমন তাদের দরকার, কোম্পানির তেমন আমাকে দরকার, এ দৃঢ়বিশ্বাস থাকতে হবে। ভয় করলে চলবে না, ভয়কে জয় করার মনোভাব থাকতে হবে, একই সঙ্গে মডেস্টি দেখাতে হবে। যেমন কোনো এক বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে, যা অজানা, সুন্দর করে বলতে হবে বিষয়টি আমার জানা নেই। সিক্রেট বা হিডেন অ্যাজেন্ডা না থাকা ভালো। হয়তো প্রশ্ন করতে পারে, এখানে সুযোগ পেলে চাকরির কোন দিকটা সবচেয়ে ভালো লাগবে।

এমন প্রশ্নের জবাবে কখনোই বলা উচিত হবে না, বেতন, মধ্যাহ্নবিরতি, সহকর্মীদের সঙ্গ অথবা ছুটির দিনগুলো। কারণ, কর্তৃপক্ষ কিছুটা বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর আশা করে, সে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সব সময় হেয়ার অ্যান্ড নাও কনসেপ্টে মনোযোগী হতে হবে, খেয়াল করে সব শুনতে হবে এবং নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। একই সঙ্গে একটি উন্মুক্ত ও সৃজনশীল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে, সর্বোপরি make yourself believe, Job is yours.

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন