বাবানের ছুটি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘মেঘেদের ছুটি কবে শেষ হবে মা?’

‘মেঘ আবার কে? সে কবে তোর বন্ধু হলো? কোনো দিন নাম শুনিনি তো! কোথায় ওর সঙ্গে তোর আলাপ? মেঘ ছুটিতে গেছেই–বা কোথায়? কবে গেছে?’—সুজাতা একসঙ্গে একগোছা প্রশ্ন ছুড়ে দিল বাবানের উদ্দেশে।

‘এ বাবা! মা, তুমি ভেবেছ মেঘ শুধু আমার বন্ধু! মেঘ তো শুধু আমার বন্ধু নয়।’

‘মেঘ শুধু তোর বন্ধু নয়! মেঘ তাহলে আর কার কার বন্ধু?’

‘দাদু বলেছে, মেঘ আমাদের সবার বন্ধু। জানো না বুঝি! মেঘ আছে বলেই জল হয়। আর জল হয় বলেই গাছপালা বাঁচে। আর আমরাও বাঁচি।’

‘ওহ্, তুই এতক্ষণ আকাশের মেঘের কথা বলছিলিস! আর আমি কী না কী ভাবছি। তা দাদু আর কী বলেছে?’

‘দাদু বলেছে, মেঘেরা সব ছুটিতে গেছে।’

‘মেঘেরা ছুটিতে গেছে! তা মেঘেরা ছুটিতে গেল কেন?’

‘ওরা নিজেরা যায়নি, বড়রা নাকি সবাই মিলে ওদের ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

‘কেন?’

‘আমিও দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বড়রা কেন মেঘেদের ছুটিতে পাঠিয়ে দিল? দাদু আমার প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, “লোভ আর স্বার্থকে পোষ মানাতে পারল না বলে।” আমি চুপ করে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাতে দাদু বলল, “দাদুভাই, এখন তুই সব বুঝবি না! বড় হ, নিজেই বুঝতে পারবি”…’

‘তুই দাদুর কাছে জানতে চাইলি না, মেঘেদের ছুটিতে যাওয়ায় কী হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, তা আর জানতে চাইব না! দাদু বলল, “মেঘেরা সব ছুটিতে গেছে বলেই নাকি বৃষ্টি হচ্ছে না। আর বৃষ্টি হচ্ছে না বলে গরমও কমছে না।” তুমি তো জানো মা, গরমে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি গরম একদম সহ্য করতে পারি না। তুমি মেঘেদের বল না মা, তাড়াতাড়ি ছুটি শেষ করে ফিরে আসতে।’

‘সে তো তোর দাদুও বলতে পারে, আমাকে বলতে বলছিস কেন?’

‘দাদু বলেছে, সবাই মিলে যেহেতু পাঠিয়েছে, তা-ই সবাই মিলে বললে তবেই নাকি মেঘেরা ফিরবে। শুধু দাদু বললে ফিরবে না।’

‘মেঘেদের বুঝি ছুটিতে যেতে ইচ্ছা করে না?’ হঠাৎ বাবার গলা শুনে একটু চমকে গেল বাবান। বাবা যে তাদের কথা দরজার আড়াল থেকে শুনছে, তা ও বুঝতে পারেনি। বাবার দিকে ফিরে ও বলল, ‘আমিও তো দাদুকে সেটাই বলেছিলাম। সেটা শুনে দাদু বলল, “মেঘেরা ছুটিতে যায় তো! শুধু যায়-ই না, নিজের ইচ্ছেমতো ছুটি কাটায়। বর্ষায় বৃষ্টি ঝরানোর কাজ শেষ করে ওরা ছুটিতে যায়। ছুটি নিয়ে শরতের নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলার মতো ওরা ঘুরে বেড়ায়। আর উঁকি মেরে দেখে জলে থইথই মাঠঘাট, জলাজমিতে ফুটে ওঠা সাদা কাশফুল।’’’

‘দাদু এটা বলেনি, সে সময় শিউলি ফোটে, বাতাসে হিমের পরশ লাগে, চারদিকে পূজা পূজা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে? আর তারপরই আসে পূজার ছুটি, পূজার ছুটিতে ওরাও সবার সঙ্গে মিশে উৎসবে মেতে ওঠে?’

‘হ্যাঁ, বলেছে তো। কিন্তু তুমি এসব জানলে কী করে বাবা?’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘শুধু এটা নয়, আমি এটাও জানি, দাদু বলেছে, মেঘেদের এখন খুব মন খারাপ। কারণ, ওদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু গাছেদের সঙ্গে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। তাই মানুষ ওদের ছুটিতে না পাঠালেও ওরা অভিমানে নিজেরাই একদিন দূরে চলে যেত।’

‘ওঃ, বুঝতে পেরেছি। দাদু আমাকে বলার আগে তোমাকেও সবকিছু বলেছে। এটা কিন্তু দাদু একদম ঠিক করেনি! দাঁড়াও, দাদুকে গিয়ে আমি ধরছি, কেন আমাকে বলা কথাগুলো তোমাকে আগে বলেছে?’

‘এ কথাগুলো তোর দাদু আমাকে বলেনি। তোকে যখন বলছিল, আমি পাশ থেকে শুনে ফেলেছি।’

‘এটা তাহলে তুমি ঠিক করোনি বাবা। মা আমাকে বলেছে, দুজনে কথা বললে সেটা কখনো লুকিয়ে শোনা উচিত নয়। তা-ই তো মা?’

‘লুকিয়ে তো শুনিনি। কানে আসছিল বলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আর তোর মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, দাদু-নাতির কথা শোনার সময় এ রকম কোনো বাধা আছে কি না?’

বাবা-ছেলের কথা শুনতে শুনতে সুজাতা তখন মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করেছে।

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]