জাহাঙ্গীরনগর জুয়াকের এন্ড অব সামার পিকনিক

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

লন্ডনে প্রকৃতির সান্নিধ্যে হলো জাহাঙ্গীরনগর জুয়াকের এন্ড অব সামার পিকনিক। গত শনিবার লন্ডনের হেইনাল্ট কান্ট্রি পার্কে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্যে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন জাহাঙ্গীরনগর জুয়াকের বার্ষিক পিকনিক।

প্রকৃতিজুড়ে সংক্ষিপ্ত ব্রিটিশ সামারের বিদায়ের সুর। আসন্ন পাতাঝরার দিন। গাছেরা ইতিমধ্যে পাতার রং বদলিয়ে সেজেছে নতুন সাজে। রোদের আলো যেন সোনালি রং ঢেলে দিয়েছে ফ্যাকাশে হলুদ পাতায়। বাতাসে হালকা হিমেল স্পর্শ। আর হেইনাল্ট কান্ট্রি পার্কের লেকের নীল পানিতে সূর্যের বিচ্ছুরণ নীলের মাঝে রুপালি আলোর ঝলকানি। পানিতে রাজকীয় ভঙ্গিমায় গ্রীবা উঁচু করে অবাধ ভেসে বেড়ানো রাজহাঁসেরা মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করছে। ইতিউতি ডুবসাঁতার কাটছে বেশ কিছু পানকৌড়ি। কয়েকটি পাতিহাঁস বাচ্চাকাচ্চাসহ পুরো পরিবার নিয়ে আমাদেরই মতো বেড়াতে এসেছে হেইনাল্ট কান্ট্রি পার্কের লেকে।

চারদিকে শুধুই ব্যস্ততা। না আমাদের না। এই ব্যস্ততা প্রকৃতির মাঝে। যুক্তরাজ্যে প্রকৃতি খুব দ্রুত রং পাল্টায়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সোনালি পাতার রং বদলে হবে কমলা বা লাল। এ সময় পার্কগুলো হয় খুবই নয়নাভিরাম। কিছুদিনের মধ্যেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা জেঁকে বসবে। ধীরে ধীরে বাড়বে শীতের তীব্রতা। প্রকৃতি জৌলুশ হারিয়ে রিক্ত নিঃস্ব রূপ ধারণ করবে। সব গাছের পাতা ঝরে শুধু কাণ্ডটুকু দাঁড়িয়ে থাকবে প্রহরীর মতো।

তীব্র শীতের সময় ছোট ছোট প্রাণী আর পাখিদের খাবারের সমস্যা দেখা দেয়। তাই তো কাঠবিড়ালিরা গাছ থেকে নেমে আসছে খাবারের সন্ধানে। তারা এখন খাবার জমিয়ে রাখবে পুরো শীতকালের জন্য। এখানকার কাঠবিড়ালিরা খুবই মিশুক। মানুষের সমাগম তাদের একটুও বিচলিত করছে না। বরং একটু পরপর গাছের কাণ্ড বেয়ে নিচে নেমে এসে লাজুক লাজুক চোখে আমাদের দেখছে। বাচ্চারা বাদাম দিয়ে খাতির জমানোর চেষ্টা করছে কাঠবিড়ালিদের সঙ্গে। তারাও কম যায় না। বাদাম মুখে পুরেই এক দৌড়ে চলে যাচ্ছে গাছের ওপর। পাখপাখালির বিচিত্র কলকাকলিতে মুখর চারদিক। দর্শনার্থীরা সঙ্গে করে তাদের পোষা কুকুর নিয়ে এসেছে। নানা রঙের নানা জাতের ভিন্ন ভিন্ন আকারের বাহারি সব প্রাণী। আবার একদিকে রয়েছে ছোট্ট চিড়িয়াখানা। সেখানে অনেক ছোট আকারের প্রাণীর সঙ্গে রয়েছে ঘোড়া।

এ রকম এক প্রকৃতির মাঝেই ছিল জাহাঙ্গীরনগর জুয়াকের আয়োজন এন্ড অব সামার পিকনিক। এই মিলনমেলার আয়োজন করা হয় শতাধিক প্রাক্তন ও তাদের পরিবার নিয়ে। ১২টার পর থেকেই একে একে সবাই আসতে থাকে নির্ধারিত স্থানে। শুরু হয়ে যায় আড্ডা গল্প। জাহাঙ্গীরনগর জুয়াকের প্রত্যেক সদস্য আমরা একটি বৃহৎ পরিবারের অংশ। বিলেতে আমাদের সম্পর্ক শুধু আনুষ্ঠানিকতার মাঝে আটকে নেই। আমরা সবার সুখে–দুঃখে একে অন্যের পাশে দাঁড়াই। বাড়িয়ে দিই সহমর্মিতার হাত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র যাঁরা আছেন, তাঁরা পরম স্নেহে আমাদের আগলে রাখেন। আর ছোট যারা আছে, তারাও যথাযথ সম্মান করেন বড়দের। এ এক অলিখিত বন্ধন। বিলেতে থেকেও জুয়াকের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। প্রায় যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বৃত্তি প্রদান করা হয় জুয়াকের পক্ষ থেকে।

সবাই মিলে পেট পুরে পোলাও, রোস্ট, রেজালা, ডালসহ হয় ভূরিভোজন। সঙ্গে ছিল বরই আর আপেলের আচার। শেষ পাতে ঘরে পাতা মিষ্টি দই খাওয়া শেষ করে, মিষ্টি পান চিবোতে চিবোতে সবাই মিলে মেতে ওঠে গল্প কথায়। প্রতিবছরের মতো এবারও পিকনিকের আয়োজন ছিল প্রকৃতির খুব কাছে। খোলামেলা পরিবেশে আড্ডাটা একটু বেশি জমে। আর এ আড্ডাকে আরও জমিয়ে তোলে চেনা গানের সুর। জুয়াকের সেক্রেটারি আলিম আল রাজি ভাই যথারীতি তার গানের মূর্ছনায় বিমোহিত করে রাখে সবাইকে। দূর পরবাসের এই পার্ক যেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্টের সুপারি তলা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন জাকিয়া তাসনিম, সুমি আমিন, পান্না ইকবাল, রুমানা তুলি, এনি জামান, নুরজাহান মুন্না ও নিপা। আমাদের পরের প্রজন্মও কম যায় না। তাদের জন্য ছিল স্কোর দ্য গোল খেলা। বাচ্চারা ছোট গোলপোস্ট লক্ষ্য করে বল দিলে গোল করার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আরিয়ান, জোহান, জাহিন, মহসিন, ওয়ারিযা, ওয়াসিফার অসাধারণ পারফরম্যান্স মুগ্ধ করে উপস্থিত সবাইকে।

তবে সবচেয়ে আকাঙ্খিত খেলা ছিল মিউজিকের তালে তালে মেয়েদের বালিশ খেলা। সর্বোচ্চসংখ্যক অংশগ্রহণকারী ছিল এই ইভেন্টে। তুমুল প্রতিযোগিতা ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর প্রথম স্থান অর্জন করে সাবিয়া, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন মুন্নি ভাবি, তৃতীয় হয় আনিকা।

ছেলেদের জন্য ছিল হিট দ্য ক্যান গেইম। ক্রিকেট বল দিয়ে লক্ষ্যভেদের এ খেলায় প্রথম হন সিকান্দার আলি সিকো, দ্বিতীয় হন শফিকুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, তৃতীয় স্থান লাভ করেন মুফাক্কারুল রহমান সৈকত। খেলা শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

মজার মজার খেলা গান, নাচ, খাওয়াদাওয়া শেষে আসে আরেক আকর্ষণ ঝালমুড়ি–চানাচুর মাখা। আহা! সেই স্বাদ। পেঁয়াজ, মরিচ আর ধনেপাতা দিয়ে খাঁটি শর্ষের তেলে মাখানো ঝালমুড়ির স্বাদ জিবে লেগে আছে এখনো।

দেখতে দেখতে হাসি–আনন্দে কেটে যায় সারা বেলা। সুয্যি মামা ইতিমধ্যে হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। বিকেলের সোনাঝরা আলো আবিরের রং মেখে দিচ্ছে সবার গায়ে। পাতায় পাতায় জড়িয়ে থাকা বাতাসে হিমের আনাগোনা। সবাই গায়ে জড়িয়ে নেয় গরম কাপড়। পাখিদের মাঝে নীড়ে ফিরে যাওয়ার তাড়া। ধবল রাজহাঁসেরা পরিবার নিয়ে পানি থেকে উঠে গা শুকাচ্ছে। ইতিমধ্যে ঘরে ফিরে গেছে কাঠবিড়ালিরা। অবশেষে সাঙ্গ হলো মেলা।

পিকনিকে আসা সবাইকে শুভেচ্ছা জানান জুয়াকের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবা জেবিন। সাধারণ সম্পাদক আলিম আল রাজির পরিচালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য ও স্মৃতিচারণা করেন রানা ইসলাম, রুবিনা আক্তার রেখা, সিনা আকন্দ, হাবিবে আলম চৌধুরী, ওয়াকারুল আমিন রনি, হাবিবে আলম, আশরাফুল আলম, সিকান্দার আলি সিকো, আসমা পারভিন, মহিউদ্দিন টিপু, আনিসুর রহমান, মুকিত শামস জয়, ফারহানা ইয়াসমিন চমন, ইফতেখার ইফতি, ফারহানা খান একা, নীলিমা আহমেদ, আমান ভুঁইয়া, শারমিন লুনা, বুলবুল আহমেদ, শফিকুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, রায়হানুর রহমান গ্রিন, মুফাক্কারুল রহমান সৈকত, হুমাইরা সুলতানা মৌরী, সুস্মিতা জ্যাবিন, মাহামুদুল হাসান অয়ন, জান্নাতুন নেসা চয়ন, রাশেদ রহমান, নিশিসহ আরও অনেকে।

*লেখক: মাহবুবা জেবিন, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, যুক্তরাজ্য